গোপাল
বাংলার পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। বাংলার
মাৎস্যন্যায় (৬৫০-৭৫০) দশার শেষের দিকে
 বাংলাদেশের প্রবীন ও প্রাজ্ঞ নেতারা আত্মকলহ ত্যাগ করে, গোপাল নামক এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। এই গোপাল থেকেই বঙ্গদেশে পাল বংশের শুরু হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপাল তাঁর রাজত্ব শুরু করেন। মালদহ জেলার অন্তর্গত খালিমপুর গ্রামে আবিষ্কৃত একটি তাম্রশাসনের চতুর্থ শ্লোকে বলা হয়েছে:

            মাৎস্যন্যায়মপোহিতুং প্রকৃতিভির্লক্ষণ্যাঃ করং গ্রাহিতঃ।
            শী গোপাল ইতি ক্ষিতীশ শিবসাং চূড়ামণিস্তৎ সুতঃ।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় এর বঙ্গানুবাদ করেছিলেন: ‘দুর্বলের প্রতি সবলের (অত্যাচারমূলক) মাৎস্যন্যায় (অরাজকতা) দূর করার অভিপ্রায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ যাঁকে রাজলক্ষ্মীর কর গ্রহণ করিয়ে (রাজা নির্বাচিত করিয়ে দিয়েছিল) ".. নরপাল-কুল-চূড়ামণি গোপাল নামক সেই প্রসিদ্ধ রাজা (বপ্যট) হতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিব্বতদেশীয় লামা তারনাথ ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে লিখিত মগধের ইতিহাসে তার উল্লেখ করে বলেছেন, “ওড়িবিশ (উড়িষ্যা) বঙ্গাল এবং সন্নিহিত পূর্বাঞ্চলের আরও পাঁচটি প্রদেশে প্রত্যেক ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য (বণিক) নিজেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের রাজা বলিয়া ঘোষণা করিতেন। সমগ্র দেশের কোন রাজা ছিল না"।

ঐতিহাসিক লামা তারনাথ ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে কাহিনীতে রূপকথার মতো একটি গল্প বলেছেন। গল্পটি হলো"বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাজা ছিল না এবং এজন্য জনসাধারণের কষ্টেরও শেষ ছিল না। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ একত্রে মিলিত হয়ে একজন রাজা নির্বাচন করেন, যিনি আইনসঙ্গতভাবে দেশ শাসন করতে পারেন। কিন্তু প্রতিদিন কেউ রাজা হওয়ার পরবর্তী রাত্রিতেই একজন কুৎসিত নাগা মহিলা, যিনি পূর্ববর্তী রাজার মহিষী ছিলেন, নির্বাচিত রাজাকে হত্যা করত। এভাবে হত্যাযজ্ঞ চলতেই ছিল। এ সময়ে চন্দ্রাদেবীর ভক্ত জনৈক ব্যক্তির পরিবার থেকে সেদিন রাজা নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল। রাত্রিতে আসন্ন মৃত্যুর কথা চিন্তা করে পরিবারের সবাই শোকে মুহ্যমান ছিল। এ সময় গোপাল এ ভক্তের পরিবারের পক্ষ থেকে রাজা হওয়ার অনুরোধ করলে তাকেই সেদিন রাজা নির্বাচিত করা হয়। অনুরূপভাবে গোপাল রাজা নির্বাচিত হয়ে রাজপুরীতে রাত্রিযাপন করতে গেলে সেই নাগা মহিলা রাক্ষস হয়ে তাকে হত্যা করতে আসলে গোপাল একটি কাষ্ঠদণ্ড হাতে নিয়ে সজোরে তার মাথায় আঘাত করে নাগা মহিলাকে হত্যা করে। পরদিন গোপালকে জীবিত অবস্থায় পেয়ে লোকজন আশ্চর্যান্বিত হল এবং এর প্রতিদানস্বরূপ তাকে স্থায়ীভাবে রাজা নির্বাচন করা হয়।"

গোপালকে সকল সামন্তরা মিলে রাজত্ব দান করেছিলেন সেটা সর্বার্থে বিশ্বাস করা যায় না। সামন্তরা নিজেদের অধিকার ত্যাগ করে, অন্যকে প্রতিষ্ঠিত করবে এতটা উদার হয়তো ছিল না। সম্ভবত গোপাল সামন্তদের মধ্যে সামরিক শক্তিতে শ্রেষ্ঠ ছিল। অন্যান্য সামন্তদের সে কৌশলে নিজের দলে টানতে পেরেছিলেন। যেহেতু সামন্তদের মধ্যে নানা ধরনের কলহ ছিল। এই সুযোগে গোপলা কূটনৈতিক তৎপরতায় নিজের দলে টেনে এনে, নিজেকে রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। রাজা হ্‌ওয়ার পর তাঁর রাজস্ব এবং সম্মান বৃদ্ধি পায়। তিনি স্থানীয় সামন্তদের শান্ত রেখে, নিজের সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।

পাল রাজগণের জাতি সম্বন্ধে রামচরিত কাব্যের প্রথম সর্গের সপ্তদশ শ্লোকের টীকায় তাঁদেরকে ক্ষত্রিয় বলা হয়েছে। রামচরিতে এবং তারনাথের ইতিহাসে পাল রাজাদের ক্ষত্রিয়বংশোদ্ভূত বলা হয়েছে; এমন বলা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ, ভারতীয় আর্য-ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাস্ত্রে রাজা মানেই ক্ষত্রিয়। কাজেই, রাজা হিসেবে পালরাজারাও ক্ষত্রিয় ছিলেন। রাষ্ট্রকূট ও কলচুরিবংশীয় রাজগণের সাথে বৈবাহিক সম্বন্ধও পাল রাজগণের ক্ষত্রিয় বংশে জন্ম সমর্থন করে। তিব্বতীয় লামা তারনাথ বলেন যে, রাজা গোপাল এক বৃক্ষ দেবতার ঔরসে ক্ষত্রিয় রমণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। গোপাল কোনো রাজবংশে জন্মগ্রহণ না করলেও সুনিপুণ যোদ্ধা ছিলেন। তিনি কোনো যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়াই ধীরে ধীরে স্থানীয় অন্যান্য সামন্তদের বশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর রাজ্যসীমা এবং রাজত্বকাল সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তারনাথের মতে, তিনি ৪৫ বছর এবং আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প অনুসারে ২৭ বছর রাজত্ব করেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে গোপাল ৭৪০ হতে ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রাজা নির্বাচিত হন এবং আনুমানিক ৭৭০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। গোপালের মৃত্যুর পর রাজ হন তাঁর পুত্র ধর্মপাল


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস (আদিপর্ব)/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।