বিগ্রহ পাল
বাংলার
পাল রাজবংশের পঞ্চম রাজা।

পাল
পাল রাজবংশের তৃতীয় রাজা দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ) -এর মৃত্যুবরণ করার পর, আনুমানিক পাঁচ বৎসর প্রথম শূরপাল (৮৫৫-৮৬০) রাজত্ব করেন। শূরপালের পঞ্চম রাজ্য সংবৎসরের একখানি লিপি পাওয়া গিয়েছে। শূরপাল যে রাজ্য জয় করেছিলেন নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনে তার উল্লেখ আছে। কিন্তু কোনো বিস্তৃত বিবরণ এখনও প্রকাশিত হয় নি। বাদাল প্রস্তরলিপিতেও তাঁর বিজয়যাত্রার উল্লেখ নেই।

পক্ষান্তরে বিগ্রহপাল ছিলেন ধর্মপালের ভাই বাক্পালের পৌত্র ও জয়পালের পুত্র। বিগ্রহপাল শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাঁর পিতা জয়পাল শূরপালকে বিতাড়িত করে পুত্রের হস্তে রাজ্যভার দিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছিলেন। বাদাল-লিপিতে মন্ত্রীপ্রবর কেদার মিশ্র শূরপালের মন্ত্রী এবং কেদার মিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্র নারায়ণপালের মন্ত্রী ছিলেন এইরূপ কথিত হয়েছে। কিন্তু বিগ্রহপালের কোনো উল্লেখ না থাকায় এই সিদ্ধান্তই সঙ্গত মনে হয়। বিগ্রহপাল রাজসিংহাসনে আরোহণ করলেও খুব অল্পকালই রাজত্ব করেছিলেন বলে মনে হয়। ধারণা করা হয়, ৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শূরপাল রাজত্ব করেন।

আনুমানিক ৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বিগ্রহ পাল সিংহাসনে বসেন। বিগ্রহপালের পুত্র নারায়ণ পালের ভাগলপুর তাম্রশাসনে পালরাজগণের যে বংশতালিকা পাওয়া যায়, তাও এই মতের সমর্থন করে। ধর্মপালের বর্ণনা আছে তৃতীয় শ্লোকে। চতুর্থ শ্লোকে তাঁর কনিষ্ঠভ্রাতা বাক্পালের এবং পঞ্চম শ্লোকে তাঁর পুত্র জয়পালের উল্লেখ আছে। এই শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে যে, জয়পাল ধর্মদ্বেষীগণকে যুদ্ধে বশীভূত করে পূর্বজ দেবপালকে ভুবনরাজ্যসুখের অধিকারী করে দিয়েছিল। পরবর্তী ষষ্ঠ শ্লোকে জয়পাল কর্তৃক উৎকল ও কামরূপ জয়ের কথা বর্ণিত হয়েছে। সপ্তম শ্লোকে বলা হয়েছে “তাঁর অজাতশত্রুর ন্যায় বিগ্রহপাল নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন।” বাক্পালের পুত্রই যে জয়পাল, এবং জয়পালের পুত্র বিগ্রহপাল, উক্ত দু’টি শ্লোক হতে এইরূপই সিদ্ধান্ত হয়। অবশ্য কেউ কেউ বলেন যে, দেবপাল জয়পালের পূর্বজ বলে বর্ণিত হয়েছেন, সুতরাং জয়পাল দেবপালের কনিষ্ঠ সহোদর অর্থাৎ ধর্মপালের পুত্র। অতএব পঞ্চম ও সপ্তম শ্লোকের ‘তাঁর’ এই সর্বনাম যথাক্রমে ধর্মপাল ও দেবপালের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। ধর্মপাল বা দেবপালের তাম্রশাসনে বাক্পালের বা জয়পালের কোনও উল্লেখ নেই। সঙ্গত কারণ এই হতে পারে যে, বিগ্রহপাল ও তাঁর বংশধরগণ দেবপালের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ছিলেন না, সুতরাং তাঁদের পূর্বপুরুষগণের কৃতিত্ব দ্বারাই তাঁদের সিংহাসন অধিকারের সমর্থন করার প্রয়োজন ছিল।

ধারণা করা হয়, দেবপালের কোনো পুত্র না থাকায় বিগ্রহপাল সিংহাসন লাভ করেন। এমন বিশ্বাসযোগ্য না হবার কারণ দেবপালের রাজত্বের ৩৩শ বর্ষে অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর অনতিকাল পূর্বে উৎকীর্ণ একখানি তাম্রশাসনে তাঁর পুত্র রাজ্যপালের যুবরাজ হিসেবে অভিষেকের উল্লেখ আছে। অবশ্য পিতার জীবিতকালেই রাজ্যপালের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এটিও অসম্ভব নয় যে, সেনাপতি জয়পাল বৃদ্ধ রাজা দেবপালের মৃত্যুর পর অনুগত সৈন্যদলের সাহায্যে নিজের পুত্রকেই সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। দেবপালের মৃত্যুর পরই যে পালরাজ্য ধ্বংসান্মুখ হয়েছিল, হয়ত এই গৃহবিবাদই তার পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল- এ কথা অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য। বিগ্রহপালের পূর্বে পাল সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে শূরপালের নাম পাওয়া যায়। ইতিহাসে ইনি প্রথম শূরপাল নামে অভিহিত করেছেন। তবে প্রায় সমস্ত পণ্ডিতব্যক্তিগণই ধারণা করেছেন যে, শূরপাল এবং বিগ্রহপাল একই ব্যক্তি। কারণ, দেবপালের পরে এবং নারায়ণপালের পূর্বে শুধু একটি নামেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া মদনপালের মহনহালি দানপত্রে পাল বংশতালিকায় নারায়ণপালের পূর্বে শূরপালের নাম পাওয়া যায়নি। এ দু’টি কারণ বিগ্রহপাল ও শূরপালের পরিচিতি স্পষ্ট করে নি বলেই রমেশচন্দ্র মজুমদারসহ আরও কোনো কোনো পণ্ডিতব্যক্তি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারেন নি। প্রধান কারণ, ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুর জেলায় একটি গ্রামে প্রাপ্ত একটি নতুন তাম্রশাসনে নিম্নলিখিত কয়েকটি তথ্য পাওয়া যায়।

১.এই তাম্রশাসন দ্বারা শ্রীশুরপাল নামে রাজা তাঁর পত্নী মহাদেবী মাহেষোভট্টারিকার অনুরোধে মুদগিরিতে অবস্থানকালে শ্রীনগরভুক্তির অন্তর্গত কয়েকটি গ্রাম বারাণসীর শৈবাচার্যগণকে দান করেন।

[শূরপাল ও বিগ্রহপাল একই ব্যক্তি নন- দুইজন বিভিন্ন রাজার নাম। পালরাজগণের তাম্রশাসনে দেবপালের পরেই বিগ্রহপাল নামক রাজার ও তৎপুত্র নারায়ণপালের নামোল্লোখ করা হয়েছে। ইহা হতে ঐতিহাসিকগণ মাত্রেই বিগ্রহপাল ও শূরপালকে অভিন্ন বলে গ্রহণ করেছিলেন। নবাবিষ্কৃত মির্জাপুর তাম্রশাসন হতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, এই ধারণা ভ্রান্ত। বিগ্রহপালের রানীর নাম ছিল লজ্জা দেবী। কিন্তু শুরপালের রানীর নাম মাহেষোভট্টারিকা দেবী।]

২. শূরপাল গোপালের প্রপৌত্র, ধর্মপালের পৌত্র এবং দেবপালের পুত্র।

[দেবপালের পুত্র শূরপাল তাঁর উত্তরাধিকারী ছিলেন, বিগ্রহপাল নয়। শূরপালের মাতা রানী ভবদেবী রাজা দুর্লভরাজের কন্যা ছিলেন। সুতরাং পূর্বে দেবপালের মৃত্যুর পর যে গৃহবিবাদের উল্লেখ করা হয়েছে ইহাই সম্ভবপর বলে মনে হয়। অর্থাৎ, দেবপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শূরপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অন্তত তিন বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁর পর বিগ্রহপাল রাজা হন।]

৩. শূরপাল, তাঁর পিতা এবং পিতামহ সকলেই “পরম সৌগত পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ” উপাধিতে ভূষিত
হয়েছেন।

[ বিগ্রহপাল বা তাঁর পিতা জয়পাল শূরপালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেন অথবা শুরপালের কোনো পুত্র না থাকায় বিগ্রহপাল রাজ্যলাভ করেন তা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। কিন্তু পালরাজগণের বংশতালিকায় শূরপালের নামোল্লোখ না থাকায় প্রথম অনুমানই সঙ্গত বলে মনে হয়। শূরপালের পঞ্চম রাজ্য সংবৎসরের একখানি লিপি পাওয়া গিয়েছে। শূরপাল যে রাজ্য জয় করেছিলেন নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনে তার উল্লেখ আছে। কিন্তু কোনো বিস্তৃত বিবরণ এখনও প্রকাশিত হয় নি। বাদাল প্রস্তরলিপিতেও তাঁর বিজয়যাত্রার উল্লেখ নেই। বিগ্রহপাল শান্তিপ্রিয় ছিলেন। তাঁর পুত্র নারায়ণপালের ভাগলপুর তাম্রশাসনে কথিত হয়েছে: দুই ব্যক্তি দুই ব্যক্তিকে বলেছিলেন, আমার পক্ষে তপস্যা এবং তোমার পক্ষে রাজ্য, সগর রাজা ভগীরথকে এইরূপ বলেছিলেন। বিগ্রহপালদেবও নারায়ণপালদেরকে এইরূপে বলেছিলেন। সুতরাং মনে হয় যে তিনি শুরপালকে বিতাড়িত করে পুত্রের হস্তে রাজ্যভার দিয়ে বানপ্রস্থ অবলম্বন করেছিলেন। বাদাল-লিপিতে মন্ত্রীপ্রবর কেদার মিশ্র শূরপালের মন্ত্রী এবং কেদার মিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্র নারায়ণপালের মন্ত্রী ছিলেন এইরূপ কথিত হয়েছে। কিন্তু বিগ্রহপালের কোনো উল্লেখ না থাকায় এই সিদ্ধান্তই সঙ্গত মনে হয়। বিগ্রহপাল রাজসিংহাসনে আরোহণ করলেও খুব অল্পকালই রাজত্ব করেছিলেন বলে মনে হয়।]

. শূরপালের মাতা, দেবপালের রাজ্ঞী ভবদেবী রাজা দুর্লভরাজের কন্যা।

৫. তাম্রশাসনখানি শুরপালের তৃতীয় রাজ্য সম্বৎসরে প্রদত্ত হয়েছিল।

বিগ্রহ পাল কলচুরি অথবা হৈহয় রাজবংশের কন্যা লজ্জাদেবীকে বিবাহ করেছিলেন। এঁদের সন্তান ছিলেন নারায়ণ পাল
বিগ্রহ পাল রাজত্ব লাভ করেছিলেন ৮৫০ খ্রিষ্টাব্দে। আর ৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর পুত্র নারায়ণ পাল-এর কাছে রাজ্য সমর্পণ করে সংসারত্যাগী হন।


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস (আদিপর্ব)/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।