নারায়ণ পাল
পাল রাজবংশের
তিনিও পিতা বিগ্রহ পাল-এর মতই ন্যায় উদ্যমহীন এবং শান্তিপ্রিয় ছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে কেদার মিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্র তাঁর মন্ত্রী ছিলেন। এই গুরবমিশ্রের লিপিতে ধর্মপাল ও দেবপালের অনেক রাজ্যজয়ের উলেখ আছে। কিন্তু শূরপাল ও নারায়ণপাল সম্বন্ধে সেরূপ কোনো উক্তি নেই। রাজা শূরপাল সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, তিনি কেদার মিশ্রের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে অনেকবার শ্রদ্ধাবনতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করেছিলেন।
নারায়ণ পাল রাজ্য রক্ষার জন্য দিকে নজর ছিল না। ফলে অচিরেই পাল সাম্রাজ্য সামরিক শক্তিতে দুর্বল হয়ে পড়লো। ফলে অচিরেই সীমান্তের অন্যান্য রাজারা পাল রাজ্য আক্রমণ করা শুরু করে। রাষ্ট্রকুটরাজ অমোঘবর্ষের লিপিতে বর্ণিত আছে, অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের অধিপতি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। আনুমানিক ৮৬০ অব্দে অমোঘবর্ষ কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী বেঙ্গী দেশ জয় করেন। সম্ভবত এর কিছুকাল পরেই তিনি পালরাজ্য আক্রমণ করেন। এই সময় অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ তখন পৃথক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। সম্ভবত রাষ্ট্রকূটরাজের আক্রমণে পালরাজ পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রকুটরাজ যে স্থায়ীভাবে পালরাজ্যের কোনো অংশ অধিকার করেছিলেন বলে মনে হয় না। তবে এই পরাজয়ের ফলে পালরাজগণের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অনেক ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। এই সূত্রে অন্যান্য রাজার পাল সাম্রাজ্য আক্রমণে সাহসী হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রকূটরাজের পর এই উড়িষ্যার শুল্কিবংশীয় মহারাজাধিরাজ রণস্তম্ভ বাংলা আক্রমণ করেন এবং রাঢ়ের কিছু অংশ দখল করে নেন।
রাষ্ট্রকূটবাদের আক্রমণ সামাল দিতে নারায়ণ পাল যখন ব্যস্ত, সেই সময়ে প্রতীহাররাজ ভোজ পুনরায় আর্যাবর্তে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করার সচেষ্ট হন। তিনি দ্রুত পালরাজ্য আক্রমণ করে বসেন। নারায়ণপাল এই আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন। এর সাথে যুক্ত হন কলচুরি ও গুহিলোট রাজরা। এদের সমবেত আক্রমণে নারায়ণপাল শোচনীয়ভবে পরাজিত হন। এই জয়ের ফলে ভোজ বঙ্গদেশের আরও অঞ্চল অধিকার করার উদ্যোগ নেন। ভোজের পুত্র মহেন্দ্র পাল পুনরায় পালরাজ্য আক্রমণ করে বিহার প্রদেশ অধিকার করেন। তারপর অগ্রসর হয়ে ক্রমে তিনি উত্তরবাংলায় স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করলেন। বাংলা ও বিহারে মহেন্দ্রপালের যে সমুদয় লিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের তারিখ ৮৮৩ হতে ৮৮৫ অব্দের মধ্যে। রাজশাহী জেলার পাহাড়পুরে প্রাপ্ত তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, প্রতীহাররাজ মহেন্দ্রপালের শাসনামলের প্রথমদিকেই বিহার অধিকার করে। পরবর্তী ৫ বছরের মধ্যে উত্তরবঙ্গ প্রতীহাররাজের অধিকার চলে যায়। কলচুরিরাজ কোক্কলও সম্ভবত এই সময়ে বঙ্গ আক্রমণ করে এর ধনরত্ন লুন্ঠন করেন। এই অবসরে চন্দ্রবংশীয় ত্রৈলোক্যচন্দ্র পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সূত্রে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পূর্ব-দক্ষিণবঙ্গ চন্দ্রবংশীয় রাজা ত্রৈলোক্যচন্দ্র] দখল করে নিয়েছিল। এছাড়া চন্দোল রাজ যশোবর্মণ বাংলাদেশের অনেক অংশ দখল করে নেয়। এই সময় বিজিত কামরূপ ও উৎকলের রাজাগণ এই সময়ে প্রবল হয়ে উঠেন। সম্ভবত তাঁদের সাথেও নারায়ণপালের যুদ্ধ হয়েছিল।
এভাবে নবম শতাব্দীর শেষভাগে শুধু আর্যাবর্তের বিস্তৃত সাম্রাজ্য নয়, পালরাজগণের নিজ রাজ্যও শত্রুর করতলগত হলো। নারায়ণপালের অক্ষমতা ছাড়াও হয়তো এরূপ শোচনীয় পরিণামের অন্য কারণও ছিল আত্মকলহ। এভাবে অভ্যন্তরীণ কলহ ও চতুর্দিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণে পালরাজ্যের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছিল।
নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল রাষ্ট্রকূটরাজ তুঙ্গের কন্যা ভাগ্যাদেবীকে বিবাহ করেন। এই বিবাহের ফলে পালরাজগণের কিছু সুবিধা হয়েছিল কি না জানা যায় না। বিহারে প্রাপ্ত একটি তাম্রলিপি ৫৩৩ যা রাজা নারায়ণপালের শাসনের ৫৪তম বৎসর বর্ণিত হয়, থেকে জানা যায় যে, এর অল্প কিছু পূর্বে বিহার ও বাংলার কিয়দংশ তিনি পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন
৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে নারায়ণ পাল মৃত্যুবরণ করেন। এর পাল-সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র রাজ্যপাল।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস /রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
বাংলার ইতিহাস,
খণ্ড- ১। আর. ডি. ব্যানার্জী।
কালিমপুর প্লেইট: খণ্ড-৪, পৃ. ২৪৮।
তৃতীয় গোবিন্দের রাধনপুর তাম্র লিপির ৮ম শ্লোক।
গোয়ালিয় প্রশস্তির ৮ম শ্লোক।
সঞ্জন (Sanjan) তাম্রলিপ্তির শ্লোক নং- ২৩।
খালিমপুর প্রশস্তি: শ্লোক- ৬-১৩।
Indian Antiquary, vol. 15, p. 309.