মহীপাল (প্রথম)
পাল রাজবংশের
দশ রাজা। ৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজবংশের নবম রাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬০-৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র মহীপাল রাজত্ব লাভ করেন।

মহীপাল উত্তরাধিকার সূত্রে অঙ্গ ও মগধ রাজ্য পেয়েছিলেন। সিংহাসন লাভের পর তিনি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলার প্রতি মনোযোগ দেন। কিছুদিন পর তিনি উত্তর ও দক্ষিণাংশ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের বাকি অংশেরর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের কিছু অংশে ধর্মপাল ও রণশূরের রাজত্ব ছিল।

এরপর তিনি পূর্ববঙ্গ অধিকার করেন। কুমিল্লা সদরের নিকটবর্তী বাঘাউরা ও নারায়ণপুর গ্রামে একটি বিষ্ণু ও একটি গণেশ মূর্তির পাদপীঠে যথাক্রমে তৃতীয় চতুর্থ সংবৎসরে উৎকীর্ণ মহীপালের দুখানি লিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, সিংহাসনে আরোহণের দুই-তিন বৎসরের মধ্যেই তিনি পূর্ববঙ্গ পুনরাধিকার করেছিলেন। তাঁর রাজত্বের নবম বছরে উৎকীর্ণ বাণগড়-লিপি হতে প্রমাণিত হয় যে, উত্তরবঙ্গ তাঁর অধীন ছিল। উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজ্যারম্ভেই তিনি উত্তর ও পূর্ববঙ্গ জয় করেন। ‘বেলাব তাম্রশাসন’ হতে জানা যায় যে, তাঁর রাজত্বের পঞ্চম বছরে উত্তরবঙ্গে তাঁর অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ‘বাণগড়-লিপি’তে ব্যক্ত হয়েছে যে, মহীপাল “রণক্ষেত্রে বাহুদর্পপ্রকাশে সকল বিপক্ষ পক্ষ নিহত করে, অনধিকারী কর্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করে, রাজগণের মস্তকে চরণপদ্ম সংস্থাপিত করে অবনীপাল হয়েছিলেন।” সভাকবির এই উক্তি অনেকখানিই সত্যে পরিণত হয়েছিল।

সমগ্র বাংলাদেশ জয় করার পূর্বেই দক্ষিণ ভারতের পরাক্রান্ত চোলরাজ রাজেন্দ্র মহীপালের রাজ্য আক্রমণ করলেন। চোলরাজ্য সেসময়ে ভারতের অদ্বিতীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। উড়িষ্যা থেকে আরম্ভ করে রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্যন্ত ভারতের পূর্ব উপকূল সমস্তই তাঁদের অধীন ছিল। তাঁদের শক্তিশালী নৌবাহিনী সুদূর সুমাত্রা ও মলয় উপদ্বীপের কোনো কোনো রাজ্য জয় করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিপুল বাণিজ্য-ভাণ্ডারের স্বর্ণদ্বার তাঁদের সম্মুখে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। এই বিশাল সাম্রাজ্য ও অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী রাজা রাজেন্দ্রচোল শিবের উপাসক ছিলেন। সুতরাং তাঁর রাজ্য পবিত্র করার উদ্দেশ্যে বঙ্গদেশ থেকে গঙ্গাজল আনার জন্য তিনি এক বিরাট সৈন্যদল প্রেরণ করেন। তাঁর সেনাপতি বঙ্গের সীমান্তে উপস্থিত হয়ে প্রথমে দণ্ডভুক্তিরাজ ধর্মপাল ও পরে লোকপ্রসিদ্ধ দক্ষিণ রাঢ়ের অধিপতি রণশূরকে পরাজিত করেন। এই দুই রাজ্য অধিকার করেন এবং বাংলাদেশ আক্রমণ করে রাজা গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করেন। এরপর মহীপালের সাথে যুদ্ধ হয়। মহীপাল ভীত হয়ে রণক্ষেত্র ত্যাগ করেন। তাঁর দুর্মদ রণহস্তী, নারীগণ ও ধনরত্ন লুণ্ঠনপূর্বক চোলসেনাপতি উত্তর রাঢ় অধিকার করে গঙ্গাতীরে উপনীত হলেন। সম্ভবত ১০২১-২৪ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে চোলরাজের গঙ্গাজলের জন্য অভিযান সংঘঠিত হয়েছিল। সম্ভবত গঙ্গাজল সংগ্রহ করা ছাড়া এই রাজার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তামিল ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করেন যে, এই অভিযানে আর কোনও স্থায়ী ফল লাভ হয় নি। চোল প্রশস্তিতে বাংলায় চোলরাজ্যের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার কোনো উল্লেখ নেই; কেবল বলা হয়েছে, চোল-সেনাপতি বাংলার পরাজিত রাজন্যবর্গকে মস্তকে গঙ্গাজল বহন করে আনতে বাধ্য করেছিলেন।

দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে রাজেন্দ্রচোলের বিরাট সৈন্যবাহিনী এই অভিযান পরিচালনা করে। রাজেন্দ্র চোলের অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ফলাফল যাই হোক, মোটের উপর এ কথা সকলেই স্বীকার করেন যে, ভাগীরথীর পবিত্র বারি সংগ্রহ করে চোলসৈন্যের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশে তাঁদের বিজয় অভিযানের আর কোনো চিহ্ন রইল না। তামিল প্রশস্তিকারের উল্লিখিত বর্ণনা হতেও প্রকাশ পায় দণ্ডভুক্তি, দক্ষিণ রাঢ় ও বঙ্গদেশে তখন ধর্মপাল, রণশূর ও গোবিন্দচন্দ্র স্বাধীনভাবে রাজত্ব করছিলেন; কিন্তু উত্তর রাঢ় মহীপালের অধীন ছিল। চোল আক্রমণের ফলে এই রাজনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছিল কিনা এবং মহীপাল দক্ষিণ রাঢ় ও দক্ষিণ বঙ্গ জয় করে সমগ্র বঙ্গে তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন কিনা তা সঠিক জানা যায় না। তবে চন্দ্র রাজা গোবিন্দচন্দ্রের পতন হলে হয়তো প্রথম মহীপাল বা দ্বিতীয় মহীপালের রাজত্বকালে দক্ষিণবঙ্গ তাদের শাসনাধীনে এসেছিল। ১০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বারণসী, মিথিলা প্রভৃতি গাঙ্গেয়দেবের রাজ্যভুক্ত ছিল, ১০২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঐ দেশগুলি মহীপাল জয় করেন। কিন্তু ১০৩৪ খ্রিষ্টাব্দে অন্তত বারাণসী গাঙ্গেয়দেব পুনরায় অধিকার করেছিলেন।

বারাণসীর নিকটবর্তী প্রাচীন বৌদ্ধতীর্থ সারনাথে ১০২৬ খ্রিষ্টাব্দ উৎকীর্ণ একটি লিপি পাওয়া গিয়েছে। এতে গৌড়াধিপতি মহীপালের আদেশে তাঁর অনুজ শ্রীমান স্থিরপাল ও বসন্তপাল কর্তৃক নতুন নতুন মন্দির নির্মাণ ও পুরাতন মন্দিরাদির জীর্ণসংস্কারের উল্লেখ আছে।

মহীপালের রাজত্বকালে আর্যাবর্তের পশ্চিমভাগে গজনীর সুলতানগণের বার বার ভারত আক্রমণ করে। এর ফলে পরাক্রান্ত সাহি ও প্রতীহারবংশ ধ্বংস হয়। এই সময় অন্যান্য রাজবংশ বিপর্যস্ত হয়। এই আক্রমণে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের প্রসিদ্ধ মন্দির ও নগরগুলি ধ্বংস হয় এবং ধনরত্ন লুণ্ঠিত হয়। আর্যাবর্তের রাজন্যবর্গ একযোগে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও কোন ফল লাভ করতে পারেন নি। এই বিদেশী শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য মহীপাল কোন সাহায্য প্রেরণ করেন নি, এজন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক তাঁর প্রতি দোষারোপ করেছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামপ্রসাদ চন্দ্র তাঁর বিখ্যাত গৌড়রাজমালা গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মহীপাল যে সমরানুরাগী শশাঙ্ক, ধর্মপাল এবং দেবপালের ন্যায় উচ্চাভিলাষী ছিলেন না, শান্তিই ভালবাসতেন, এরকম মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।’

কিন্তু মহীপালের ইতিহাস সম্যক আলোচনা করলে এই প্রকার নিন্দা বা অভিযোগের সমর্থন করা যায় না। পিতৃরাজ্যচ্যুত মহীপালকে নিজের বাহুবলে বাংলায় পুনরাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এই কার্য সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই রাজেন্দ্র চোল তাঁর রাজ্য আক্রমণ করেন। কলচুরিরাজও তাঁর এক শত্রু ছিলেন। তৎকালে রাজেন্দ্র চোল ও গাঙ্গেয়দেবের ন্যায় শক্তিশালী শাসক ভারতবর্ষে আর কেউ ছিল না। এদের ন্যায় শত্রুর হাত হতে আত্মরক্ষা করতেই তাঁকে সর্বদা বিব্রত থাকতে হতো। এমতাবস্থায় সুদূর পঞ্চনদে সৈন্য প্রেরণ করা তাঁর পক্ষে হয়ত সম্ভবপর ছিল না। সুতরাং তৎকালীন বাংলার অভ্যন্তরীণ অবস্থা সবিশেষ না জেনে মহীপালকে ভীরু, কাপুরুষ অথবা দেশের প্রতি কর্তব্যপালনে উদাসীন ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা যুক্তিসঙ্গত নয়।

ইমাদপুর লিপি অনুসারে মহীপাল ৪৮ বছর রাজত্ব করেছেন। কিন্তু লামা তারনাথ বলেছেন ৫২ বছর। অবশ্য বেশিরভাগ পণ্ডিতব্যক্তিগণের অভিমত তিনি ৫০ বছর রাজত্ব করেছেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের রাজত্বকালে মহীপাল যা করেছিলেন, তাই তাঁর শৌর্যবীর্যের যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। পালরাজ্যকে আসন্ন ধ্বংস হতে রক্ষা করে তিনি বঙ্গদেশের পূর্ব সীমান্ত হতে বারাণসী পর্যন্ত ভূভাগ ও মিথিলায় পালরাজ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তারপর ভারতের দুই প্রবল শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি এই রাজ্যের অধিকাংশ রক্ষা করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এটিই মহীপালের কৃতিত্বের শ্রেষ্ঠ পরিচয়।

পালরাজশক্তির পুনরভ্যুদয়ের চিহ্নস্বরূপ মহীপাল প্রাচীন কীর্তির রক্ষণে যত্নশীল ছিলেন। ‘সারনাথ-লিপি’তে শত শত কীর্তিরত্ন নির্মাণ এবং অশোক স্তূপ ‘সাঙ্গ ধর্মচক্র’ ও ‘অষ্ট-মহাস্থান’, ‘শৈলবিনির্মিত-গন্ধকূটী’ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ প্রাচীন বৌদ্ধকীর্তির সংস্কার সাধনের উলেখ আছে। আবদুল মুমিন চৌধুরী মনে করেন, ধর্মীয় পীঠস্থান সারনাথে ধর্মীয় স্থাপনাগুলির সংস্কার, নতুন মন্দির নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ দ্বারা মহীপাল সারনাথ অধিকার করেছিলেন বুঝায় না। একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে এগুলি তাঁর ধর্মীয় কীর্তির অংশ বলেই গণ্য হতো। এগুলি ছাড়াও মহীপাল অগ্নিদাহে বিনষ্ট নালন্দা মহাবিহারের জীর্ণোদ্ধার এবং বুদ্ধগয়ায় দুটি মন্দির নির্মাণ করেন। কাশীধামে নবদুর্গার প্রাচীন মন্দির ও অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীর মন্দিরও সম্ভবত তিনি নির্মাণ করেন।অনেক দীঘি ও নগরী এখনও তাঁর নামের সাথে বিজড়িত হয়ে আছে এবং সম্ভবত তিনিই সেগুলির প্রতিষ্ঠা করেন।  মহীপালের রাজত্বে একাদশ সম্বৎসরে উৎকীর্ণ দুটি শিলালিপিতে অগ্নিদাহের পর নালন্দার একটি মন্দিরের সংস্কার এবং বুদ্ধগয়াতে দুটি মন্দির নির্মাণের উল্লেখ আছে।

মহীপালের নামে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে, অনেক গীত কবিতা ও পল্লীতে লোকসঙ্গীত রচিত হয়েছিল বলে জানা যায়। কিন্তু এগুলি আর শোনা যায় না। পাহাড়পুরের খননকার্য প্রসঙ্গে এর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিখেছেন যে, দশম শতকের শেষভাবে অথবা একাদশ শতকের প্রথম ভাগে এর বিরাট মন্দিরের পুরোপুরি সংস্কার করা হয়েছিল। সুতরাং মহীপালের দ্বারাই তা সাধিত হয়েছিল এরূপ সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে। মোটের উপর মহীপালের রাজত্বকালে বাংলায় সকল দিকেই এক নতুন জাতীয় জাগরণের আভাস পাওয়া যায়।

জৈন গ্রন্থকার হেমচন্দ্র লিখেছেন যে, চৌলুক্য রাজা দুর্লভ এক স্বয়ম্বরসভায় অঙ্গ, কাশী, অবন্তী, চেদী ও মথুরা এবং কুরু ও হুণদেশের রাজাকে পরাজিত করে রানী দুর্লভদেবীকে বিবাহ করেছিলেন। দুর্লভ আনুমানিক ১০০৮ খ্রিষ্টাব্দে অনহিল পাটকের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সুতরাং এই স্বয়ম্বরসভায় উপস্থিত অঙ্গদেশের রাজা নিশ্চয়ই মহীপাল। অতএব হেমচন্দ্রের কাহিনী সত্য হলে রাজা মহীপালের জীবনের একটি নতুন ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায়।

১০৩৮ খ্রিষ্টাব্দে মহীপাল মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র নয়াপাল সিংহাসনে বসেন।


সূত্র :
বাংলাদেশের ইতিহাস /রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।