বাংলার তুর্কি শাসন
এর কিছুদিন পর, উড়িষ্যার হিন্দু রাজাদের সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। প্রথমবারের মতো তিনি উড়িষ্যার রাজাদের কাছে পরাজিত হন। এরপর রাজ্য রক্ষার জন্য তিনি দিল্লীর সুলতানের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে কারা-মাণিকপুর এবং অযোধ্যা থেকে কারা-কাশ খাঁ এবং তমর খাঁ অগ্রসর হন। ইতিমধ্যে উড়িষ্যার রাজার লক্ষ্মণাবতী অবরোধ করেছিলেন। কিন্তু দিল্লীর সুলতানের বাহিনী আসার সংবাদ পেয়ে উড়িষ্যারা রাজার ফিরে যান। এই সময় লক্ষ্মণাবতীর অধিকার নিয়ে তুঘ্রান খাঁর সাথে তমর খাঁর বিবাদ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তুঘ্রান খাঁ পরাজিত হয়ে লক্ষ্মণাবতী ত্যাগ করেন। ফলে গৌড়ের অধিকার লাভ করেন তমর খাঁ। ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ -এবং গিয়াসউদ্দীন বলবনের প্রিয়পাত্র মুঘুসউদ্দিন উজবক বাংলার শাসনক্ষমতা লাভ করেন। ১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজত্ব করেন। এই সময়ে তিনি সুলতান উপাধি ধারণ করে দিল্লীর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এরপর তিনি অযোধ্য আক্রমণ করে জয় করেন। এরপর তিনি কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করেন। কামরূপরাজ তাঁকে কোনো বাধা না দিয়ে পালিয়ে যান। মুঘসউদ্দিন কামরূপে বর্ষাকাল পর্যন্ত কাটান। বর্ষার সময় প্লাবনে বাংলাদেশের সাথে কামরূপ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে, কামরূপ রাজ তাঁর বাহিনীকে আক্রমণ করেন এবং মুঘুসউদ্দিনকে বন্দী ও হত্যা করেন। মুঘুসউদ্দিনের মৃত্যুর পর লক্ষ্মণাবতী আমিরদের অধিকারে চলে যায় এবং তাঁরা ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কয়েকজন শাসক শাসন করেন।
মুঘিশউদ্দিন
তুঘ্রাল ও আমিন খাঁ
১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে
নাসিরুদ্দিন
মাহমুদ মৃত্যুবরণ করলে, দিল্লীর ক্ষমতায় আসেন
গিয়াসউদ্দিন বলবন। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের অধিকার গিয়াসউদ্দিনের ছিল। তিনি আমিন
খাঁকে শাসনকর্তা এবং মুঘিসউদ্দিন তুঘ্রালকে সহকারী-শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন।
এছাড়া বলবন বাংলার ক্ষমতাকে হ্রাস করার জন্য, বাংলা থেকে বিহারকে পৃথক করেছিলেন।
তুঘ্রালকে সহকারী-শাসনকর্তা হলেও, তিনিই মূলত শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি সহকারী পদে
থেকেও ফরিদপুর, ঢাকা এবং ত্রিপুরা দখলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
এছাড়া তিনি বরিশাল অঞ্চলে দনুজ রাই নামক কায়স্থ রাজার সাথে
যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। উড়িষ্যা আক্রমণ
করে সেখানে লুটতরাজ চালান। বাংলদেশের রাঢ় অঞ্চলেও তিনি অভিযান চালিয়ে দখল করেন।
তুঘ্রালের এই সকল বিজয়ের পর তিনি নিজেকে অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক হিসেবে ভাবা শুরু করেন। এর ভিতর গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচারতি হলে, নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন এবং আমিন খাঁকে বিতারিত করেন। ফলে ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুঘ্রালকে শায়েস্তা করার জন্য বাংলা আক্রমণ করেন। তুঘ্রাল দিল্লীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখী না হয়ে লক্ষ্মণাবতী ত্যাগ করেন। সুলতানের বাহিনী লক্ষ্মণাবতী দখল করেন এবং তুঘ্রালকে বন্দী করার জন্য তাঁর পশ্চাদানুসরণ করেন। উড়িষ্যা সীমান্তের কাছে, সুলতান বাহিনী তাঁকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলে, তাঁকে বন্দী করে লক্ষ্মণাবতীতে আনা হয়। ১২৮৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সুলতান তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেন।
বঘরা খাঁ
তুঘ্রালের পতনের পর,
গিয়াসউদ্দিন বলবন
কিছুদিন লক্ষ্মণাবতীতে কাটান। তারপর তাঁর পুত্র বঘরা খাঁর কাছে বাংলার শাসনভার
ন্যস্ত করে তিনি দিল্লীতে ফিরে যান। এরপর বখরা খাঁ সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ উপাধি
ধারণ করে স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন।
১২৮৬ খ্রিষ্টাবব্দে মোঙ্গলরা মুলতান আক্রমণ করে। এই সময় মুলতানের শাসনকর্তা ছিলেন গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর প্রথম পুত্র সুলতান মহম্মদ। সুলতান মহম্মদ মোঙ্গলদের যথাসাধ্য বাধা দিয়েও পরাজিত ও নিহত হন। ফলে বৃদ্ধ বয়সে তিনি নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুলতানের রাজধানী লাহোর পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাহত হন। তিনি বাংলার শাসক বঘরা খাঁকে দিল্লীর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেন। বঘরা খাঁ এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে, তিনি প্রথম পুত্র সুলতান মহম্মদ-এর পুত্র কাইখসরুকে উত্তরাধিকারী করে যান। এরপর ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু
গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর
মৃত্যুর পর, আমিররা কাইখুস্রুকে বাতিল করে বঘরা খাঁ'র পুত্র কায়কোবাদকে সিংহাসনে
বসান। কায়কোবাদ ১৮ বৎসর বয়সে রাজত্ব লাভ করেন। এই সময় কায়কোবাদ বাংলা তাঁর পিতার
বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালান নি। ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঘরা খাঁ-র
উত্তরাধিকারীরা বাংলা শাসন করেন। উত্তরাধিকারীদের ভিতর রুকন্উদ্দিন এবং কাইকাস,
ফিরোজ শাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো সুলতান ছিলেন। তবে
১৩২২ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর
পুত্রদের মধ্যে বাহাদুর শাহ এবং নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম শাহ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে
পড়েন। এই সূত্রে দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলায় আধিপত্য বিস্তার করতে
সক্ষম হন এবং বাংলাদেশ তুঘলকি শাসনে চলে যায়।
ফিরোজ শাহ-এর পুত্রদের ভিতরে বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার
করতে সক্ষম হয়েছিলেন বাহাদুর শাহ এবং নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম শাহ। রাজ্য নিয়ে
অধিকারের লড়াইয়ে বাহাদুর শাহ প্রথমে
সোনারাগাঁও এবং লক্ষ্মণাবতী অধিকার করেন। ১৩২৪
খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে, নাসিরউদ্দিন
শাহ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন
এবং তাঁর ভাই বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন।
গিয়াসউদ্দিন তাঁর এই অনুরোধে, তাঁর অন্যতম সেনাপতি বাহরাম খাঁকে নির্বাচন করেন এবং
নাসিরুদ্দিনকে সাহায্য করার আদেশ দেন। উভয়ের মিলিত বাহিনী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করলে,
বাহাদুর শাহ পরাজিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। সুলতানের বাহিনী তাঁকে অনুসরণ করে
শেষ পর্যন্ত বন্দী করতে সক্ষম হয়। এরপর গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাসিরউদ্দিনকে উত্তরবঙ্গ
এবং বাহরাম খাঁকে সোনারগাঁও-এর শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি বাহাদুর
খাঁকে দিল্লীতে নিয়ে যান। কিছুদিন পর তিনি বাহাদুর খাঁকে মুক্ত করে, দিল্লীর
প্রতিনিধি হিসেবে সোনার গাঁও-এ পাঠান। সেখানে তিনি বাহরাম খাঁ-এর সাথে যুগ্ম-শাসক
হিসেবে প্রশাসনে অংশগ্রহণ করেন। অন্যদিকে লক্ষ্মণাবতী ও সাতগাঁ-এ তিনি কয়েকজন
উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন।
১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁর অধিকৃত বাংলাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেন। এই ভাগ তিনটি হলো− লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও। উচ্চাভিলাষী বাহাদুর শাহ সোনারগাঁ-এর ক্ষমতা দখল করার উদ্যোগ নিলে, বাহারাম খাঁ তাঁকে পরাজিত করেন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর বাহরাম শাহ সোনারগাঁ-এর একমাত্র শাসকে পরিণত হন। ১৩৩৮ বাহরাম শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় বাহরাম শাহ-এর ফখরুদ্দিন নামক একজন অনুচর সোনারগাঁও-এ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর লক্ষ্মণাবতীর শাসক কাদর খাঁ এবং সাতগাঁ-এর শাসক ইজউদ্দিন সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের মুখে ফখরুদ্দিন পালিয়ে যান। এই বিদ্রোহ দমনের সূত্রে কাদর খাঁ লক্ষ্মণাবতী ও সোনারগাঁও-এর শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। এর কিছুদিন পর কাদর খাঁ-এর সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যা করে। এই সুযোগে কাদর খাঁ-এর বাহিনীর আলি মোবারক লক্ষ্মণাবতীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বিরুদ্ধে পুরো তুঘলকি সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হলে, আলি মোবারক 'আলাউদ্দিন-আলি-শাহ' উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরে তাঁর এক ভাই দিল্লী থেকে এসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে হাজির হন। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ তাঁকে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসেন। এই সূত্রে বাংলার ইতিহাস একটি নবতর রূপ লাভ করে। তাঁর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ ।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।