সামস্উদ্দিন ইলিয়াস শাহ
বাংলাদেশে ইলিয়াস
শাহী রাজবংশ-এর প্রথম শাসক।
তুঘলকি শাসনামলের
(১৩২৮-১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ) শেষে, ১৩৩৮ সোনারগাঁ-এর শাসনকর্তা
বাহরাম শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় বাহরাম শাহ-এর ফখরুদ্দিন নামক একজন অনুচর
সোনারগাঁও-এ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর লক্ষ্মণাবতীর শাসক কাদর খাঁ এবং সাতগাঁ-এর
শাসক ইজউদ্দিন সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের মুখে ফখরুদ্দিন পালিয়ে যান। এই
বিদ্রোহ দমনের সূত্রে কাদর খাঁ লক্ষ্মণাবতী ও সোনারগাঁও-এর শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন।
এর কিছুদিন পর কাদর খাঁ-এর সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যা করে। এই সুযোগে কাদর
খাঁ-এর আলিমোবারক লক্ষ্মণাবতীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের
বিরুদ্ধে পুরো তুঘলকি সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হলে, আলিমোবারক
'আলাউদ্দিন-আলি-শাহ' উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরে তাঁর
ইলিয়াস শাহ নামক তাঁর এক ভাই দিল্লী থেকে এসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে হাজির হন।
১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ তাঁকে পরাজিত করে
লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসেন। এই সূত্রে বাংলার ইতিহাস একটি নবতর রূপ লাভ করে। তাঁর
মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ।
১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে পাণ্ডুয়াতে স্থানান্তর
করেন।
সুলতান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর, তিনি সামস্উদ্দিন ইলিয়াস শাহ নাম ধারণ করেন। তুঘলকি শাসনামলের শেষের দিকে সমগ্র উত্তর ও পূর্ব ভারতের অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে ইলিয়াস শাহ প্রথমে ত্রিহুত জয় করেন। ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নেপাল আক্রমণ করেন এবং কাঠমুন্ডু জয় করে, লুটতরাজ করেন। তবে তাঁর সেনাবাহিনী দ্রুত নেপাল ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করে জয়লাভ করেন। এখানেও তিনি লুটতরাজের মাধ্যমে সম্পদ সংগ্রহ করে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। এরপর তিনি সোনারগাঁও দখল করে, সেখানে একটি রাষ্ট্রীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও দখল করেন এবং সেখান থেকে মুদ্রা জারি করেন।
দিল্লীর সুলতান ফিরোজ তুঘলক বাংলা আক্রমণের সম্ভাবনা অনুমান করে, তিনি একডালাতে
(একডালা দুর্গ,
বর্তমান বাংলাদেশের কাপসিয়া জেলায় অবস্থিত) অবস্থিত একটি পুরানো দুর্গ সংস্কার
করেন। ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে যখন দিল্লীর সুলতান ফিরোজ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করেন, তখন
ইলিয়াস শাহ কোনো বাধা না দিয়ে এই দুর্গে আশ্রয় নেন। এই সময় বাংলার রাজধানী ফিরোজ
তুঘলক করলেও
একডালা দুর্গ দখল করতে পারেন নি।
কয়েক মাস অবরুদ্ধ থাকার পর, উভয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হলে, বাংলার সৈন্যরা পরাজিত
হয়, কিন্তু তখনও একডালা দুর্গ অপরাজেয় ছিল। অবশেষে হতাশ হয়ে ফিরোজ শাহ দিল্লী ফিরে
যান। পরে উভয়ের ভিতরে শান্তি স্থাপিত হয়। ১৩৫৫ এবং ১৩৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ
দিল্লীর সুলতানকে উপঢৌকন পাঠিয়ে শান্তি বজায় রাখেন। দিল্লীর সাথে শান্তি স্থাপিত হলে, তিনি কামরূপ আক্রমণ করেন। তবে এই আক্রমণের
ফলাফল সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।
১৩৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র
সিকান্দার শাহ বাংলার সিংহাসনে বসেন।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।