ফিরোজ শাহ তুঘলক
(রাজত্বকাল ১৩৫১-১৩৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)
তুঘলক রাজবংশের সুলতান।
১৩০৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল রজব তুঘলক। উল্লেখ্য রজব
তুঘলক ছিলেন- গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের ছোটো ভাই। কথিত আছে
গিয়াসউদ্দিন
তুঘলক গুজরাটের শাসনকর্তা থাকার সময়, দীপালিপুরের রাজপুত কন্যার সৌন্দর্যে
মুগ্ধ হয়ে, তাঁকে জোরতপূর্বক তুলে আনেন। পরে তিনি তাঁর ছোটভাই রজব তুঘলকের সাথে
বিবাহ দেন। এই কন্যার গর্ভে ফিরোজ শাহ তুঘলকের জন্ম হয়।
গিয়াসউদ্দিন
তুঘলক তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে ফিরোজ
শাহ যুদ্ধবিদ্যা ও শাসনকার্যে দক্ষ হয়ে ওঠেন। ১৩৫১ খ্রিষ্টাব্দে
মুহম্মদ-বিন
তুঘলক সিন্ধুর বিদ্রোহ দমনে গেলে- রোগাক্রান্ত হয়ে মৃ্তুবরণ
করেন। তাঁর অবর্তমানে সুলতানী বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এছাড়া সিন্ধুর
বিদ্রোহী নেতা তাগির সুলতানী বাহিনীকে ক্রমাগত আক্রমণ করে অস্থির করে তোলে। এই
অবস্থায় আমিররা ফিরোজ শাহকে সুলতানকে সিংহাসন গ্রহণের অনুরোধ করেন। আমিরদের এই
আবেদন প্রথমে তিনি অস্বীকার করেন, পরে ভয়ানক পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য,
সিংহাসন গ্রহণ করেন। তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়েছিল সিন্ধুর তট্টা সেনা শিবিরে।
সিংহাসন লাভের পর, ফিরোজ শাহ দিল্লি অভিমুখে রওনা দেন। এদিকে খান-ই-জাহান নামক এক
তুঘলক, এক শিশুকে প্রয়াত সুলতানের পুত্র বলে দাবি করেন এবং এই শিশুকে সিংহাসনের
অধিকার দিয়ে, নিজেই শাসনকার্য চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আমিররা এই শিশুকে অবৈধ
বলে ঘোষণা দেন। ফলে ফিরোজ দিল্লিতে প্রবেশ করলে, খান-ই-জাহান আত্মসমর্পণ করেন।
ফিরোজ শাহ তাঁকে জায়গির দিয়ে অন্যত্র পাঠান। পথিমধ্যে আমিরদের পাঠানো ঘাতক তাঁকে
হত্যা করেন। এরপরে ফিরোজশাহ সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করেন।
সিংহাসন লাভের পরপরই তিনি অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোযোগ দেন। তিনি ভ্রমণকারীদের জন্য বিশ্রামাগার, হাসপাতাল ও পানির চাহিদা মেটানোর জন্য কূপ খনন করেন। তিনি জয়পুর, ফিরোজপুর এবং হিসার-ফিরোজ সহ বিভিন্ন শহরের গোড়াপত্তন করেন। ১৩৫০
খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লির কাছে ফিরোজাবাদ নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এই নগরটি
১৮০২ খ্রিষ্টাব্দে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বর্তমান ধ্বংসপ্রাপ্ত এই নগরটি ফিরোজশাহ কোটলা
নামে পরিচিত।
তিনি আমির ও অভিজাতদের
প্রচুর সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। তিনি তার রাজ্যে পিতার বদলে পুত্র
প্রথা চালু করেন। সেনাবাহিনী কিংবা রাজকার্য যেখানেই হোক পিতা যদি উপস্থিত না হতে
পারতেন তাহলে পুত্রকে পাঠিয়ে দেওয়া যেত। তিনি সরকারী কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি
করেন এবং হাত কেটে ফেলা, গর্দান নেওয়া সহ সমস্ত প্রকার কঠোর শাস্তি দেওয়া বন্ধ
করেন। এছাড়াও তিনি
মুহাম্মদ বিন তুগলকের আমলে আরোপিত ভূমির উপর অতিরিক্ত কর প্রত্যাহার করেন।
১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দের বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহ সমগ্র বঙ্গদেশ নিজ অধিকারে আনেন এবং
দিল্লির অধীনস্থ ত্রিহূত অধিকার করেন। এই অবস্থায় ১৩৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ
বঙ্গদেশের উদ্দেশ্যে সসৈন্যে রওনা দেন। ইলিয়স রাজধানী পাণ্ডুয়া ত্যাগ করে একডালা
দুর্গ অবরোধ করেন। কয়েক মাস অবরোধ করার পর, বর্ষার জন্য তিনি দিল্লিতে ফিরে আসেন।
১৩৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। এই সময় বাংলার সুলতান ছিলেন
ইলিয়াস শাহের পুত্র সিকান্দর শাহ। পিতার পথ অনুসরণ করে, সিকান্দর শাহও একডালা দুর্গে
আশ্রয় নেন। এবারে দীর্ঘদিন অবরোধ করার পরও একডালা দুর্গ দখল করতে ব্যর্থ হয়ে, ফিরোজ
শাহ বাংলার সুলতান সিকান্দর শাহের সাথে সন্ধি করে দিল্লির পথে অগ্রসর হওয়ার
সময় উড়িষ্যা আক্রমণ করেন। উড়ুষ্যার রাজা পলায়ন করলে তিনি পুরী দখল করেন। এই সময় তিনি
জগন্নাথ মন্দিরের মূর্তিটি সমুদ্র নিক্ষেপ করেন। এই সময় সৈন্যর নগরীতে ব্যাপক
লুটপাট করে। এই অবস্থায় উড়িষ্যার রাজা অধীনতা স্বীকার করলে, ফিরোজ শাহ দিল্লিতে ফিরে
আসেন।
১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ পাঞ্জাবের নগরকোট নামক রাজ্য আক্রমণ করেন। ছয়মাস
অবরুদ্ধ থাকার পর রাজকোটের রাজা বশ্যতা স্বীকার করেন।
১৩৬১-১৩৬২ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহ সিন্ধু আক্রমণ করেন। সিন্ধুরাজের প্রতিরোধের মুখে
সুলতানে অভিযান রুদ্ধ হয়ে যায়। এই সময় সেনাশিবিরে খাদ্যাভাব ও মহামারী দেখা দিলে
সৈন্য প্রত্যাহার করে গুজরাটে ফিরে আসেন। ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় সিন্ধু আক্রমণ
করেন। এবারে সিন্ধুরাজ বশ্যতা স্বীকার করে করদানে স্বীকৃত হন।
১৩৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লির কুতুব মিনার তৈরি করেন।
১৩৭৭ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটে বিদ্রোহ দেখা দিলে- ফিরোজ শাহ অবিলম্বে তা দমন করেন এবং মালিক মুজাফফর (ফারহাত-উল-মুলক নামেও পরিচিত ছিলেন)
ও রাস্তি খানকে গুজরাটের গভর্নর নিয়োগ দেন। ১৩৮৭ খ্রিষ্টাব্দে গুজরাটের গভর্নর
হিসেবে সিকান্দার খানকে নিয়োগ দেন। ক্ষুব্ধ মালিক মুজাফফর সিকান্দার খানকে
হত্যা
করেন। এই ঘটনার পর, গুজরাটের গভর্নর হিসেবে মালিক মুজাফফর বহাল থেকে যায়।
১৩৮৮ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যবরণ করলে, গিয়াস উদ্দীন তুঘলক দ্বিতীয়,
সিংহাসন অধিকার করেন।
সূত্র: