গিয়াসউদ্দিন তুঘলক
ভারতবর্ষের দিল্লীকেন্দ্রিক রাজত্বের তুঘলক বংশের শাসনের প্রতিষ্ঠাতা।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতা ছিলেন একজন তুর্কি দাস। ভারতে আসার পর তিনি পাঞ্জাবের জাঠ নারীকে বিবাহ করেন। গিয়াসউদ্দিনে ভাই-বোন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

যৌবনের শুরুতে তিনি দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিনের সৈন্যবাহিনীতে সামান্য সৈনিক যোগদান করেন। নিজ যোগ্যতার গুণে সেনাবাহিনীতে বিশেষ স্থান অধিকার করে নেন। ১৩০৫ খ্রিষ্টাব্দে নিজ যোগ্যতায় তিনি পাঞ্জাবের শাসনকর্তা পদ লাভ করেন। এই সময় মোগলদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাঁকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়। কথিত আছে তিনি প্রায় ঊনত্রিশ বার মোগল আক্রমণ সফলভাবে প্রতিহত করেন। এই কারণে তাঁকে 'মালিক গাজী' নামে অভিহিত করা হতো।

সম্রাট আলাউদ্দিনের রাজত্বের শেষভাগে তিনি দিল্লীর দরবারে অন্যতম আমির ছিলেন। আলাউদ্দিন মালিক কাফুর প্ররোচনায়, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খিজির খাঁর পরিবর্তে, তাঁর নাবালক পুত্র সাহাবউদ্দিন ওমরকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করেন। আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে ওমর দিল্লীর সিংহাসনে বসেন। ওমর তাঁর অধীনস্ত কর্মচারী খসরুর পরামর্শে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। পরে খসরুর ষড়যন্ত্রে ওমর নিহত হন এবং খসরু দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন। ক্ষমতা দখলের কিছুদিনের মধ্যেই খসরু অত্যাচারী শাসকে পরিণত হন। এই কারণে দিল্লীর আমিররা খসরুকে শাস্তি দেওয়ার জন্য পাঞ্জাবের শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিনকে আহ্বান করেন। গিয়াসউদ্দিন  দিল্লী আক্রমণ করলে খসরু সাথে তাঁর যুদ্ধ হয় এবং এই যুদ্ধ খসরু নিহত হন। এই সময় সম্রাট আলাউদ্দিনের কোনো বংশধর না থাকায়, দিল্লীর আমিররা গিয়াসউদ্দিন তুঘলককে দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। এই সূত্রে ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক রাজত্ব শুরু করেন এবং তুঘলক বংশের শাসন শুরু।

সিংহাসন লাভের পর তিনি রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন এবং বহু জনহিতকর কাজ করেন।

সে সময়ে দাক্ষিণাত্যের বরঙ্গল রাজ্যের রাজা প্রতাপরুদ্র স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র জুনা খাঁকে প্রতাপরুদ্রকে দমন করার জন্য প্রেরণ করেন। জুনা খাঁ কয়েক মাস অবরুদ্ধ থাকার পর সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। জুনা খাঁ এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে আক্রমণের উদ্যোগ নেন। কিন্তু এই সময় গিয়াসউদ্দিনের মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে, জুনা খাঁ দিল্লীতে ফিরে আসেন। ১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে জুনা খাঁ পুনরায় প্রতাপরুদ্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং বরঙ্গল অধিকার করেন।

ইতিমধ্যে ১৩২২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহের মৃত্যু হয়। এরপর তাঁর পুত্রদের মধ্যে বাহাদুর শাহ এবং নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম শাহ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। শুরুর দিকে বাহাদুর শাহ লক্ষ্মণাবতী ও সোনারগাঁও দখল করে নেয়।

১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে  গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের রাজ্য মোঙ্গলদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। গিয়াসউদ্দিন এই আক্রমণ সাফল্যের সাথে প্রতিহত করেন।

বঙ্গদেশের এই অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখে ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর উদ্যোগ নেন। অভিযানেরর শুরুতেই নাসিরউদ্দিন শাহ গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের কাছে আত্মসমর্পণ করেন এবং তাঁর ভাই বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। গিয়াসউদ্দিন তাঁর এই অনুরোধে, তাঁর অন্যতম সেনাপতি বাহরাম খাঁকে নির্বাচন করেন এবং নাসিরুদ্দিনকে সাহায্য করার আদেশ দেন। উভয়ের মিলিত বাহিনী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করলে, বাহাদুর শাহ পরাজিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। সুলতানের বাহিনী তাঁকে অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত বন্দী করতে সক্ষম হয়। এরপর গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাসিরউদ্দিনকে উত্তরবঙ্গ এবং বাহরাম খাঁকে সোনারগাঁও-এর শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি বাহাদুর খাঁকে দিল্লীতে নিয়ে যান। কিছুদিন পর তিনি বাহাদুর খাঁকে মুক্ত করে, দিল্লীর প্রতিনিধি হিসেবে সোনার গাঁও-এ পাঠান। সেখানে তিনি বাহরাম খাঁ-এর সাথে যুগ্ম-শাসক হিসেবে প্রশাসনে অংশগ্রহণ করেন। অন্যদিকে লক্ষ্মণাবতী ও সাতগাঁ-এ তিনি কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন।

১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে
গিয়াসউদ্দিন বঙ্গদেশ থেকে দিল্লীর পথে রওনা দেন। গিয়াসউদ্দিনের জ্যেষ্ঠপুত্র জুনা খাঁ পিতার অভ্যর্থনার জন্য দিল্লীর ছয় মাইল পূর্বে আফগানপুরে একটি শিবির স্থাপন করেন। গিয়াসউদ্দিন এই শিবিরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরে, শিবিরটি গিয়াসউদ্দিনের উপর ভেঙে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যু ঘটে।

গিয়াসউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যৈষ্ঠপুত্র জুনা খাঁ 'মুহম্মদ তুঘলক' উপাধি গ্রহণ করে দিল্লীর সিংহাসনে বসেন।

সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।