ইলিয়াস শাহী রাজবংশের শাসন
ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালের প্রথম পর্যায়
১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দে
হামজা শাহ
মৃত্যবরণ করেন। এরপর গণেশ
নামক একজন জমিদার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। এই সময়
শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ নামে একজন নামে মাত্র সুলতান ছিলেন। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে
আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সুলতান হন। এই সময়
গণেশ ফিরোজশাহকে হত্যা করে সিংহাসন দখল
করেন। এই সূত্রে ইলিয়াস শাহী বংশের প্রথম পর্যায় শেষ হয়। এবং শুরু হয় রাজা গণেশের
রাজত্বকাল। এই সময় বাংলার মুসলমান দরবেশরা হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে মুসলমান প্রজাদের
বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলেন। এই সময়
গণেশ কয়েকজন বিদ্রোহী দরবেশকে হত্যা করেন।
ফলে মুসলমান প্রজাদের বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। এই সময় বিদ্রোহীদের নেতা নূরকুৎব
আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে বাংলা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। ইব্রাহিম
শর্কি বাংলা আক্রমণ করলে, গণেশ সিংহাসন ত্যাগ করেন। এই সময় তাঁর পুত্র যদু সেন
(ভিন্ননাম জিৎমল), ইব্রাহিমের পক্ষে চলে যান। পরে রাজ্য লোভে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে
জালালউদ্দিন নাম ধারণ করেন। ইব্রাহিম শাহ, জালালুদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে জৌনপুরে
ফিরে যান। ইব্রাহিম শাহ ফিরে যাওয়ার পরপরই, গণেশ ক্রম ক্রমে আবার ক্ষমতার শীর্ষে
চলে আসেন এবং পুত্রের ছায়ায় তিনি রাজ্য শাসন করা শুরু করেন। এই সময় তিনি বাংলার
বিদ্রোহী দরবেশদের কঠোর হাতে দমন করেন। এরপর তিনি জালালউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে,
সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় তিনি 'দনুজমর্দনদেব' নাম ধারণ করেন। তিনি মুসলমান
দরবেশদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ করলেও, সাধারণ মুসলমানদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছেন
বলেই জানা যায়। এই কারণে সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন তাঁর প্রতি ছিল। ১৪১৮
খ্রিষ্টাব্দে রাজা গণেশ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রদেব রাজত্ব
লাভ করেন। পরে জালালউদ্দিন মুসলমানদের আমিরদের সহায়তায় মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত
করে সিংহাসন দখল করেন। জালালউদ্দিন ১৪৩১ 'খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর
ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র সামস্উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু তাঁর কুশাসনে দেশে অরাজকতার
সৃষ্টি হয়। এই সময় সাদি খাঁ এবং নাসির খাঁ নামক দুইজন আমির তাঁকে হত্যা করেন। এর
ভিতর দিয়ে রাজা গণেশ-এর
বংশধরদের রাজত্বকালের অবসান হয়।
সামস্উদ্দিন আহমেদ এর দুই
হত্যাকারী আমির পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং উভয়ই নিহত হন। এরপর অন্যান্য
আমিররা ইলিয়াস শাহ বংশের নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসান। এর
ফলে ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকাল দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হয়।
ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকালের দ্বিতীয় পর্যায়
(১৪৪২-১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)
নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দ
পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন তাঁর পুত্র রুকনদ্দিন
বরবক। ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বরবক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য
বিষয় ছিল চট্টগ্রাম, যশোহর, খুলনা ও বাখেরগঞ্জ অঞ্চলকে নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
করেছিলেন।
১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রুকনদ্দিন-এর পুত্র সামসউদ্দিন রাজত্ব লাভ করেন। তিনি রাজত্ব
করেন ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।
সামসউদ্দিনের সাহিত্যে অনুরাগ ছিল প্রবলভাবে। মালাধর বসু 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' রচনা করেছিলেন ১৪৭৩ থেকে ১৪৮০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে। সামসউদ্দিন তাঁর কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে 'গুণরাজ খান' উপাধি দেন। ধারণা করা হয়, কবি জয়নুদ্দিন 'রসুল বিজয়' কাব্য রচনা করেছিলেন তাঁর রাজত্বকালে।
এরপর সিংহাসনে আরোহণ করেন
জালালউদ্দিন। নতুনভাবে ক্ষমতা লাভের পর জালালউদ্দিন
রাজ্যে শান্তি আনেন এবং পরে তিনি পাণ্ডুয়া থেকে গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তর করেন।
তিনি সংস্কৃত পণ্ডিত বৃহস্পতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। রাজসভায় এই পণ্ডিতের বিশেষ
প্রভাব ছিল। তিনি এই পণ্ডিতকে রায়মুকুট উপাধিতে ভূষিত করেন। ধারণা করা হয়, তাঁর
উৎসাহেই কৃত্তিবাস বাঙ্গালায় রামায়ণ রচনা করেছিলেন।
১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করার পর, মুজফ্ফর নামক এক হাবসী
কৃতদাস কর্তৃক তিনি নিহত হন। এবং এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইলিয়াসশাহী রাজবংশের
বিলুপ্তি ঘটে। এবং শুরু হয় হাবসী শাসন।
হাবসী শাসন
(১৪৮৭-১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ)
সিংহাসনের নিরাপত্তার জন্য, রুকনউদ্দিন বরবক্ আফ্রিকা থেকে বহু হাবসী ক্রীতদাস
এনেছিলেন। কালক্রমে এরাই শক্তিশালী হয়ে উঠে।
১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মুজফ্ফর নামক এক হাবসী
ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শেষ সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসে। কিন্তু কুশাসনের জন্য
বাংলায় আবার ঘোরতর অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এই কারণে এদের শাসনামলকেও অন্ধকারযুগ বলা হয়।
১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাবসি শাসন চলে। এই সময় রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী
আলাউদ্দিন হুসেন শাহ-এর
নেতৃত্বে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা মুজফ্ফরকে হত্যা করে। ১৪৯৩
খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে
হুসেন শাহ বসেন। এর দ্বারা সূচিত হয়,
হুসেনশাহী
রাজবংশের।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।