সোনারগাঁও
বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনস্থ পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র।

বর্তমানে সোনারগাঁও বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। তবে বাংলাদেশের মধ্যযুগে নগরটির ঠিক কোথায় ছিল তা নির্দেশ করা কঠিন। নানা রকমের বিক্ষিপ্ত নিদর্শনাদি থেকে ধারণা করা হয়, এই নগরীটির পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে
শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত ছিল।  
 
ধারণা করা হয়, প্রাচীন বাংলায় এর নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম নাম। হয়তো এই নাম থেকে মুসলিম আমলের সোনারগাঁও নামের উদ্ভব হয়েছে। এই অঞ্চলের পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দুটি ঐতিহ্যবাহী পবিত্র স্নানতীর্থ লাঙ্গলবন্দ ও পম্পীঘাট অবস্থিত। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সমাচার দেবের ভূমিদান লিপিতে (গোগরাহাটি তাম্রশাসন) উল্লিখিত সুবর্ণবীথি এই অঞ্চলেই ছিল বলে ধারণা করা হয়। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজমাধব দশরথদেব (দনুজ রায়), সম্ভবত ওই সময়ের মাঝামাঝি কোন এক সময়ে বিক্রমপুর থেকে সুবর্ণগ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করে থাকবেন। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নদীয়া দখল করলে, লক্ষ্মণসেন বিক্রমপুর অঞ্চলে পালিয়ে আসেন। এই সময় সোনারগাঁও এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল লক্ষ্মণসেন-এর শাসনাধীন ছিল। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্মণসেনের মৃত্যুর পর তাঁর সন্তান বিশ্বরূপ সেন এবং কেশব সেন ১২০৬ থেকে ১২৩০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের শাসক ছিলেন। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের অধিকার করেছিলেন দিল্লীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবন। তিনি আমিন খাঁকে শাসনকর্তা এবং মুঘিসউদ্দিন তুঘ্রালকে সহকারী-শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন। এছাড়া বলবন বাংলার ক্ষমতাকে হ্রাস করার জন্য, বাংলা থেকে বিহারকে পৃথক করেছিলেন।

তুঘ্রালকে সহকারী-শাসনকর্তা হলেও, তিনিই মূলত শাসনকর্তা ছিলেন। তিনি সহকারী পদে থেকেও ফরিদপুর, ঢাকা এবং ত্রিপুরা দখল করেন। তখন সোনারগাঁও-সহ পূর্ব-বাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাঁর অধিকারে চলে যায়। কিন্তু গিয়াসউদ্দিন-এর মৃত্যুর পর, আমিররা কাইখুস্‌রুকে বাতিল করে বঘরা খাঁ'র পুত্র কায়কোবাদকে সিংহাসনে বসান। কায়কোবাদ ১৮ বৎসর বয়সে রাজত্ব লাভ করেন। এই সময় কায়কোবাদ বাংলা তাঁর পিতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযান চালান নি। ১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বঘরা খাঁ-র উত্তরাধিকারীরা বাংলা শাসন করেন। উত্তরাধিকারীদের ভিতর রুকন্উদ্দিন এবং কাইকাস, ফিরোজ শাহ বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো সুলতান ছিলেন। তবে ১৩২২ খ্রিষ্টাব্দে ফিরোজ শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদের মধ্যে বাহাদুর শাহ এবং নাসিরউদ্দিন ইব্রাহিম শাহ ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।

১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে, নাসিরউদ্দিন শাহ তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেন
এবং তাঁর ভাই বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করেন। গিয়াসউদ্দিন তাঁর এই অনুরোধে, তাঁর অন্যতম সেনাপতি বাহরাম খাঁকে নির্বাচন করেন এবং নাসিরুদ্দিনকে সাহায্য করার আদেশ দেন। উভয়ের মিলিত বাহিনী লক্ষ্মণাবতী আক্রমণ করলে, বাহাদুর শাহ পরাজিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান। সুলতানের বাহিনী তাঁকে অনুসরণ করে শেষ পর্যন্ত বন্দী করতে সক্ষম হয়। এরপর গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নাসিরউদ্দিনকে উত্তরবঙ্গ এবং বাহরাম খাঁকে সোনারগাঁও-এর শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি বাহাদুর খাঁকে দিল্লীতে নিয়ে যান। কিছুদিন পর তিনি বাহাদুর খাঁকে মুক্ত করে, দিল্লীর প্রতিনিধি হিসেবে সোনার গাঁও-এ পাঠান। সেখানে তিনি বাহরাম খাঁ-এর সাথে যুগ্ম-শাসক হিসেবে প্রশাসনে অংশগ্রহণ করেন। অন্যদিকে লক্ষ্মণাবতী ও সাতগাঁ-এ তিনি কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে পর্যবেক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন।

১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁর অধিকৃত বাংলাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেন। এই ভাগ তিনটি হলো
লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও। উচ্চাভিলাষী বাহাদুর শাহ সোনারগাঁ-এর ক্ষমতা দখল করার উদ্যোগ নিলে, বাহারাম খাঁ তাঁকে পরাজিত করেন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর বাহরাম শাহ সোনারগাঁ-এর একমাত্র শাসকে পরিণত হন। ১৩৩৮ বাহরাম শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় বাহরাম শাহ-এর ফখরুদ্দিন নামক একজন অনুচর সোনারগাঁও-এ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর লক্ষ্মণাবতীর শাসক কাদর খাঁ এবং সাতগাঁ-এর শাসক ইজউদ্দিন সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের মুখে ফখরুদ্দিন পালিয়ে যান। এই বিদ্রোহ দমনের সূত্রে কাদর খাঁ লক্ষ্মণাবতী ও সোনারগাঁও-এর শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। এর কিছুদিন পর কাদর খাঁ-এর সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যা করে। এই সুযোগে কাদর খাঁ-এর আলিমোবারক লক্ষ্মণাবতীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বিরুদ্ধে পুরো তুঘলকি সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হলে, আলিমোবারক 'আলাউদ্দিন-আলি-শাহ' উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরে তাঁর ইলিয়াস শাহ নামক এক ভাই দিল্লী থেকে এসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে হাজির হন। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ তাঁকে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসেন। এই সূত্রে বাংলার ইতিহাস একটি নবতর রূপ লাভ করে। তাঁর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও দখল করেন এবং সেখান থেকে মুদ্রা জারি করেন।

ঈসা খান ও তাঁর বংশধরদের শাসনামলে সোনারগাঁও তাদের রাজধানী ছিল।  ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে মোগল শাসকরা বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। মুসা খান এর পতনের পর ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে সোনারগাঁও মোগল সুবাহ বাংলার একটি সরকারে পরিণত হয়। এই সময় সোনারগাঁও-এর পতন শুরু হয়। এবং কালক্রমে একটি বিলুপ্ত নগরীতে পরিণত হয়।

প্রখ্যাত চীনা পরিব্রাজক ইবনে বতুতা ১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দের সোনারগাঁওকে একটি গুরূত্বপূর্ণ বন্দর নগরী রূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁর বিবরণ থকে জানা যায়, সে সময়ে সোনারগাঁও-এর সাথে চীন, ইন্দোনেশিয়া (জাভা) ও মালয় দ্বীপপুঞ্জের সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। চীনের অপর পরিব্রাজক মা হৃয়ান ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দের সোনারগাঁওকে একটি বিরাট বাণিজ্যিক শহররূপে বর্ণনা করেছেন।

সোনারগাঁয়ের প্রস্তুতকৃত মসলিন কাপড়, সাড়া বিশ্বে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সুতিবস্ত্রের জন্য, বিশেষত বিলাতি থান কাপড়ের ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে পানাম নগরের অভ্যুদয় ঘটেছিল। এই সময় সোনারগাঁও বাণিজ্য ক্ষেত্রে কিছুটা প্রাধান্য লাভ করেছিল।

১২৮২ থেকে ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বোখারার মুসলিম পণ্ডিত মওলানা শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা র নেতৃত্বে সোনারগাঁও ইসলামি শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার জন্য একটি খানকাহ ও একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসায় ইসলামি শিক্ষার সকল শাখায় এবং লৌকিক বিজ্ঞানের ওপর শিক্ষাদান ও অধ্যয়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সমগ্র উপমহাদেশে বিহারের বিখ্যাত সুফী শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরী এই মাদ্রাসাতেই শিক্ষালাভ করেছিলেন। ধারণা করা হয় মোগরাপাড়ার বর্তমান দরগাহ-বাড়িতে ই জ্ঞানচর্চা কেন্দ্রটি ছিল। পরবর্তীকালে শেখ আলাউল হক, তাঁর পৌত্র শেখ বদর-ই-ইসলাম ও প্রপৌত্র শেখ জাহিদ সোনারগাঁয়ে ধর্মতত্ত্ব ও সুফীতত্ত্ব বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। আবু তওয়ামা প্রতিষ্ঠিত খানকাহ ও মাদ্রাসা সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর আধ্যাশ্ছিক অনুসারীদের দ্বারা এবং পরবর্তীকালে প্রখ্যাত দরবেশ শাহ ইবরাহিম দানিশমন্দ ও তাঁর বংশধর শাহ কামেল, শেখ মুহম্মদ ইউসুফ ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়।

১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে গোয়ালদি মসজিদ, ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে আবদুল হামিদ মসজিদ নির্মিত হয়।

বর্তমানে সোনারগাঁওকে পর্যটন নগর হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। দর্শনীয় স্থানগুলো হলোঐতিহাসিক পাঁচ পীরের মাজার, মোগড়াপাড়া দরগাহ শরীফ, গ্রান্ডট্রাঙ্ক রোড, লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, লাঙ্গলবন্দের তীর্থ, বাড়ি মজলিশ, শাহছিল্লাপুর, বন্দর, নবীগঞ্জ, পোকাই দেওয়ানের সমাধি, পিঠাওয়ালিরপুল, ঐতিহাসিক মসলিন পাড়ার গ্রাম খাসনগর, খাসনগর দীঘি, মুসা খাঁর প্রাসাদ, গোয়ালদী, আলাউদ্দিন হুসেন শাহের মসজিদ, পানাম সেতু, পঙ্খিরাজ খাল, কোম্পানির সেতুর, ঐতিহাসিক পানাম নগর, ট্রেজার হাউজ, পশ্চিম বঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বাড়ি, হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থভূমি বারদী লোকনাথ ব্রহ্মচারী আশ্রম, বারদি, মহজমপুর, সোনার গায়ের আমিনপুরে প্রায় চারশো বছরের পুরানো ক্রোড়ি বাড়ি, কুড়িপাড়া ইটের পুল ও দেওয়ানবাগ।