বরেন্দ্র ও পুণ্ড্রবর্ধন
উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ। ঐতিহাসিকেদের মতে
বর্তমান রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদের কিছু অংশ এবং দার্জিলিং ও কোচবিহারসহ গঠিত সমগ্র অঞ্চল বরেন্দ্র এলাকা। সন্ধ্যাকর নন্দীর 'রামচরিত-কাব্য'-এ গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যভাগকে বরেন্দ্রী নামে অভিহিত করা হয়েছে। আ, কা, ম, যাকারিয়া কর্তৃক সম্পাদিত বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস নামক পুস্তকে সমগ্র রাজশাহী বিভাগকেই বরেন্দ্র অঞ্চল নামে অভিহিত করা হয়েছে। এই বিচারে বৃহত্তর দিনাজপুর, মালদহ, রংপুর, বগুড়া পাবনা এবং বৃহত্তর রাজশাহী জেলা বরেন্দ্র ভূমির ভিতরে ধরা হয়ে থাকে। এই হিসেবে এর আয়তন ১৩,৩৬৯ বর্গমাইল বা ৩৪,৬৫৪ বর্গ কিলোমিটার।

গঙ্গানদীর পূর্বভাগে পুণ্ড্রবর্ধন নামে একটি জনপদ ছিল। এর রাজধানীর নাম পুণ্ড্রনগর। বর্তমানে এই স্থানটি মহাস্থানগড় নামে খ্যাত। এই জনপদের দক্ষিণে পদ্মা, পূর্বে করতোয়া (মতান্তরে যমুনা) এবং পশ্চিমে গঙ্গা নদী ছিল। এই বিচারে পুণ্ড্রবর্ধনের ভিতরে প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলই পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই বিচারে রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম- বাংলার ভূতপূর্ব এই চারিটি বিভাগ কোন না কোন সময়ে পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের অর্ন্তগত ছিল।

রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে পুণ্ড্র একটি প্রাচীন জাতিমূলক নাম। এরা উত্তরবঙ্গে বাস করতো। এই কারণে এ অঞ্চল পুণ্ড্রদেশ ও পুণ্ড্রবর্ধন নামে খ্যাত ছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ মতে পুণ্ড্ররা আর্যভূমির প্রাচ্য-প্রত্যন্ত দেশে বসবাস করতো। বৌধায়ন ধর্মসূত্রে  উল্লেখ আছে, পুণ্ড্ররা বঙ্গ এবং কলিঙ্গ দেশের প্রতিবেশী ছিল। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন, পূণ্ড্রদের আবাসভূমি ছিল মুঙ্গেরের পূর্বদিকে এবং কোশীতীর সংলগ্ন।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০ অব্দের দিকে এই অঞ্চল নন্দরাজের শাসনাধীন ছিল। পরো নন্দরাজকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্ত পাটালীপুত্রের রাজা হন। এই সময় পুণ্ড্রবর্ধন চন্দ্রগুপ্ত-এর শাসনধীনে আসে। গুপ্তবংশের রাজত্বকালে পুণ্ড্রবর্ধন একটি প্রদেশে পরিণত হয়। প্রশাসনিক সুবিধার জন্য পুরো পুণ্ড্রবর্ধনকে কয়েকটি বিষয় (জেলা) ভাগ করা হয়। প্রতিটি বিষয় আবার বীথি ও মণ্ডল নামক প্রশাসনিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। এই সময় পুণ্ড্রবর্ধন শাসিত হতো প্রাদেশিক শাসনকর্তার দ্বারা।

রাজা শশাঙ্ক (৬০৬ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্তবংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। গঞ্জামের তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, শশাঙ্কের ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজ্যের রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ। ধারণা করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় রাজবাড়িডাঙ্গা'র (রক্তমৃত্তিকা মহাবিহারের প্রত্নস্থল অথবা আধুনিক রাঙ্গামাটি) সন্নিকটে চিরুটি রেলস্টেশনের কাছে কর্ণসুবর্ণ ছিল।

শশাঙ্কের মৃত্যুর পর গৌড় রাজ্য সম্রাট হর্ষবর্ধন ও তাঁর মিত্র কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার অধীনে চলে যায়। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর বহিঃশত্রুর ক্রমাগত আক্রমণের ফলে গৌড়ের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ‘মাৎস্যন্যায়’ নামের শতবর্ষব্যাপী এক অন্ধকার ও অরাজক যুগের সূচনা হয়। অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে গৌড় রাজ্যে মাৎস্যন্যায় যুগের অবসান ঘটে প্রথম পাল রাজা গোপালের (আনুঃ ৭৫০-৭৭০ খ্রি) ক্ষমতারোহণের মাধ্যমে। বাংলায় পাল শাসন প্রায় তিন শতাব্দীকাল স্থায়ী হয়েছিল। এরপর কর্ণাটক থেকে আগত ও রাঢ় অঞ্চলে বসবাসকারী সেন বংশ গৌড়ের সিংহাসন অধিকার করে।

তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খলজী ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে নদীয়া জয় করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসনামলে বাংলাভাষী সমগ্র ভূখণ্ড ‘বাঙ্গালা’ নামের একক রাষ্ট্রের অধীনে আসে। তবে গৌড় তথা বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ ধরা হয় হোসেন শাহী বংশের শাসনকালকে। মধ্যযুগের বাংলার শ্রেষ্ঠ নরপতি সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি) রাজত্বেই বরেন্দ্র অঞ্চল গৌরবের সর্বোচ্চ শিখরে উপনীত হয়।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবরের সময় সমগ্র বরেন্দ্র অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এই সময় শাহাজাদা মুহম্মদ সুজার (১৬৩১-৫৯ খ্রি) বেশ কিছু কীর্তি চাঁপাইনবাবগঞ্জে রয়েছে। তাঁর কাছারী বাড়ির ধ্বংসাবশেষ রয়েছে শিবগঞ্জ উপজেলার ফিরোজপুরে। তাঁর সময় গৌড়ের পূর্বাঞ্চলে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (রঃ) এখানে আসেন। সুবাদার সুজা তাঁকে অত্যন্ত সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানান। পরে শাহ নেয়ামতুল্লাহ গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুরে স্থায়ীভাবে আস্তানা স্থাপন করেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রি) পর থেকে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে, বাংলা নবাবরা প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করে। নবাব মুর্শিদকুলি খানের (১৭১৭-১৭২৭ খ্রি) সময় বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা হয়। সে সময় বরেন্দ্র অঞ্চল বাংলার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে পরিণত হয়।

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশী নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের বীজ রোপিত হয়। ধীরে ধীরে কলকাতা কেন্দ্রিক শাসন ব্যস্থার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চল কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পরিণত হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের সময় বরেন্দ্র অঞ্চল বিভাজিত হয়ে যায়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশর স্বাধীনতার পর, খণ্ডিত বরেন্দ্র অঞ্চল বাংলাদেশের অধিকারে আসে।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।
http://www.banglapedia.org/HTB/102800.htm