মহাস্থানগড়,
পুণ্ড্রনগর
বঙ্গদেশের প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্যের রাজধানী পুণ্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে এই
অঞ্চলটি বাংলাদেশের বগুড়া শহর থেকে ১৩ কিমি উত্তরে ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে
অবস্থিত। গড় শব্দের অর্থ উচ্চভূমি বা উচ্চভূমির স্তূপ। মহাস্থানের উচ্চস্থান অর্থে
মহাস্থান গড় বলা হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে খ্রিষ্টীয় ১৫ শতাব্দীর ভিতরে এই নগরীটির বিকাশ
ঘটেছিল। গোড়ার দিকে হিন্দু ও বৌদ্ধ শাসকদের দ্বারা এই নগরী বিকশিত হয়েছিল।
ধারণা করা হয় নগরটি মৌর্যদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেই সূত্রে এখানে
একটি সমৃদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠেছিল । মুসলমানদের শাসনামলের প্রথম থেকেই এই নগরীতে মুসলিম-স্থাপত্যের প্রভাব পড়া শুরু হয়।
হিন্দু, বৌদ্ধ এবং মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন এই নগরীতে প্রচুর পাওয়া যায়।
এর আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ১৫০০ মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৪০০ মিটার বিস্তৃত। এর চারপাশ প্রায় ৬ মিটার উঁচু প্রতিরক্ষা প্রাচীর দ্বারা ঘেরা। এই প্রাচীরের ভিতরে রয়েছে বেশকিছু স্তূপ। স্থানীয়ভাবে এই স্তূপগুলোকে ভিটা বলা হয়। এই স্তূপ বা ঢিবিগুলো প্রাচীন গৃহস্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। ভিটাগুলোকে ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। যেমন বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা, খোদার পাথর ভিটা ইত্যাদি। এর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে শাহ সুলতান মাহীসওয়ারের মাজার এবং মুগল সম্রাট ফররুখ সিয়ার এর একটি মসজিদ আছে। পরে এই মসজিদ ঘিরে একটি আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ পুণ্ডরনগরী ভ্রমণ করেন। কথিত আছে মুসলিম শাসনামলের আগে পরশুরাম নাক একজন অত্যাচারী রাজা এই নগরীর অধিকর্তা ছিলেন। শাহ সুলতাম বলখী এই রাজাকে উৎখাত করে এই নগরী দখল করেন।
ঐতিহাসিকরা মনে করেন, এই সুরক্ষিত নগরটির
উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে একটি গভীর পরিখা ছিল। বর্তমানে উত্তর ও পশ্চিম দিকে এই
পরিখা নিদর্শন পাওয়া যায়। দক্ষিণ দিকে পরিখার আংশিক চিহ্ন পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়
এই পরিখা তৈরি করা হয়েছিল রাজধানী পুণ্ড্রনগরের প্রতিরক্ষার জন্য। সে সময়ে এই নগরীর
পূর্ব দিকে তখন করতোয়া নদী প্রবাহিত ছিল। এখানে প্রাপ্ত ব্রাহ্মীলিপিতে উৎকীর্ণ
একটি শিলালিপিতে ‘পুণ্ডনগল’ (পুণ্ড্রনগর) উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইংরেজ শাসনামলে অনেক পর্যটক ও পণ্ডিত ব্যক্তি এই স্থান পরিদর্শন করেন এবং এর
ঐতিহাসক গুরুত্বের বিষয় উল্লেখ করেন। বিশেষত বুকানন হ্যামিলটন, ও’ডোনেল,
বেভারীজ ও স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম এই স্থান পরিদর্শন করেন এবং তাঁদের
প্রতিবেদনে তা উল্লেখ করেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ ধ্বংসাবশেষকে প্রাচীন পুণ্ড্রনগরের
ধ্বংসাবশেষ রূপে উল্লেখ করেন স্যার আলেকজান্ডার কানিংহামের। পরবর্তী সময় ১৯২৮-২৯
খ্রিষ্টাব্দে কে.এন দীক্ষিতের তত্ত্বাবধানে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ এ
স্থানে প্রথম নিয়মানুগ উৎখনন শুরু করে। প্রাথমিক অবস্থায় এই খননকাজের ক্ষেত্র ছিল মাত্র
তিনটি ঢিবি। এই ঢিবিগুলিকে স্থানীয়ভাবে বলা হতো−
বৈরাগীর ভিটা, গোবিন্দ ভিটা এবং মুনির ঘুন। এর বাইর একটি বুরুজসহ পূর্ব প্রাচীরের
কিছু অংশ নিয়ে গবেষণা করা হয়েছিল। এরপর খননকার্য প্রায় তিন দশক বন্ধ থাকে।
পাকিস্তানা আমলে
ষাটের দশকের প্রথম দিকে পুনরায় এর খননকার্য শুরু হয়। এই নব্য প্রচেষ্টায় খননের
আওতায় আনা হয়− উত্তর দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীর এলাকা, পরশুরামের প্রাসাদ, মাজার
এলাকা, খোদার পাথর ভিটা, মানকালীর কুণ্ডধাপ-সহ কিছু অংশ। এরপর আবার এর খননকাজ বন্ধ
হয়ে যায়। প্রায় দুদশক পর ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দে খননকাজ পুনরায় শুরু হয় এবং ১৯৯১
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় প্রতি বছরই একাজ সচল ছিল। এই সময়ের ভিতরে মাজারের
নিকটবর্তী এলাকা এবং উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীর সংলগ্ন অংশে গবেষণার কাজ
পরিচালিত করা হয়েছিল। এই সময়ের খননকার্যের ফলে নগরটির তিনটি
প্রবেশদ্বার, উত্তর ও পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের উল্লেখযোগ্য অংশ এবং মাজার
এলাকার নিকটে একটি মন্দির-স্থাপনা উন্মোচিত হয়েছে। তিনটি প্রবেশদ্বারের দুটি উত্তর
দিকের রক্ষা-প্রাচীরে অবস্থিত। দুর্গের উত্তর-পশ্চিম কোণের ৪৪২ মিটার পূর্ব দিকে
অবস্থিত একটি প্রবেশদ্বার ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৫.৮ মিটার দীর্ঘ। অন্যটি ৬.৫ মিটার
পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং ১.৬ মিটার প্রশস্ত। ধারণ করা হয়, প্রবেশদ্বার দুটি পালযুগ
এবং তার পরেও ব্যবহৃত হয়েছে। পূর্ব দিকের রক্ষা-প্রাচীরের একমাত্র প্রবেশ
দ্বারটি প্রায় এর মধ্যস্থলে অবস্থিত। পরশুরামের প্রাসাদের ১০০ মিটার পূর্বে অবস্থিত
এই দ্বরাটি
প্রায় ৫ মিটার প্রশস্ত। পাল যুগের শেষের দিকে একটি পুরানো প্রবেশদ্বারের
ধ্বংসাবশেষের উপর এটি নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এই সময়ের সবগুলি
প্রবেশদ্বার-স্থাপনার ভেতর দিকে প্রহরি-কক্ষ এবং রক্ষা-প্রাচীরের বাইরে সমপ্রসারিত
বুরুজ ছিল। মাজার এলাকায় উন্মোচিত মন্দির-স্থাপনায় কোন সুসঙ্গত নির্মাণ
পরিকল্পনা লক্ষ্য করা যায় না। পাল শাসনামলে এটি পাঁচটি পর্যায়ে নির্মিত ও
পুননির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এ এলাকা থেকে উদ্ধারকৃত প্রত্ননিদর্শনের
মধ্যে কয়েকটি নমুনা হলো−বড় আকারের পোড়ামাটির ফলক, খেলনা,
গোলক, অলঙ্কৃত ইট ও মাটির
পাত্র। ধারণা করা হয়, জাহাজঘাটা নগরের রক্ষা-প্রাচীরটি ছয়টি পর্যায়ে নির্মিত
হয়েছিল। এর ভিতর সর্বপ্রাচীন পর্যায়টি ছিল, সম্ভবত মৌর্যযুগে। পরবর্তী পর্যায়
শুঙ্গ-কুষাণ, গুপ্ত, প্রাথমিক পাল, পরবর্তী পাল ও সুলতানি আমলেও নির্মাণকাজ বা
সংস্কার অব্যাহত ছিল। এর অনেক প্রাচীর পর্যায়ক্রমে একটির উপর অন্যটি নির্মিত হয়েছিল। অর্থাৎ এই
নির্মাণকাজের একটি ধারাবাহিকতা ছিল।
এই অঞ্চলের গবেষণার জন্য, ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে বাংলাদেশী ও ফরাসি প্রত্নতাত্ত্বিকদের দল এই অঞ্চলের গবেষণার যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করে। নতুনভাবে নেওয়া এই উদ্যোগে− পূর্ব দিকের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের মধ্যভাগ সন্নিহিত স্থানে প্রতিবছর প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন কাজ চলতে থাকে। অবশ্য এর আগেই বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সুরক্ষিত নগরের বাইরে ভাসুবিহার, বিহার ধাপ, মঙ্গলকোট ও গোদাইবাড়িসহ কয়েকটি স্থানে খনন কাজ করেছিল। এর মধ্যে ফ্রান্স-বাংলাদেশ মিশন কর্তৃক পরিচালিত উৎখনন কার্যক্রমে প্রাথমিক পর্যায়ে ১৮টি নির্মাণ স্তর উন্মোচিত হয়। এখন পর্যন্ত পরিচালিত উৎখননের ফলে যে সকল উপকরণের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেগুলো হলো− বিপুল পরিমাণ উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ পাত্র, রুলেটেড পাত্র, কালো ও লাল রঙের পাত্র, কালো প্রলেপযুক্ত পাত্র, ধূসর বর্ণের পাত্র, পাথরের যাঁতা, মাটির তৈরি মেঝেসহ মাটির ঘর (রান্নাঘর), চুলা এবং খুটির গর্ত। ভূমির সর্বনিম্ন স্তরে উত্তরাঞ্চলীয় কালো মসৃণ পাত্র বেশি পাওয়া গেছে। এসব পাত্রের ভিতর রয়েছে নানা ধরনের থালা, পেয়ালা, গেলাস এবং গামলা ইত্যাদি। এ স্তরে এলাকায় একটি ছোটো ইট বিছানো মেঝে পাওয়া গেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মেঝের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন দেয়াল পাওয়া যায় নি।
মূলত প্লাইস্টোসিন ভূস্তরের উপর এখানে সর্বপ্রথম বসতি গড়ে উঠেছিল। এর উপরের স্তরের কার্বন-পরীক্ষায় থেকে জানা গেছে− সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ ভাগ এই অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠেছিল। তার অর্থ দাঁড়ায় এ স্তরের বসতি ছিল প্রাক-মৌর্য যুগে। খননের ফলে এখন পর্যন্ত যে সকল নমুনা পাওয়া গেছে তাদের বয়স এবং খননস্তরের গভীরতার বিচারে যে কালানুক্রমিক ভাগ পাওয়া যায়, তা হলো−