কুষাণ জাতি
কুষাণরা ছিল মধ্য এশিয়ার একটি যাযাবর গোষ্ঠী।

কুষাণদের আদি বাসস্থান ছিল চীনের কান-সু প্রদেশে। এই বিচারে এরা ছিল মোঙ্গোলীয় মহাজাতিসত্তার
ইউয়েহ চিহ্ বা তুষার (তোখরিয়) শাখার অন্তর্গত। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগে এরা হিউং-নু (হুন) নামক অপর একটি যাযাবর জাতির দ্বারা বিতারিত হয়ে এরা কান-সু প্রদেশে দক্ষিণ দিকে চলে যায়। পথে উ-সুং নামক অপর একটি জাতি এদের আক্রমণ করে। কিন্তু ইউয়েহ চিহ্-রা এদের পরাজিত করে, পুনরায় দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই অগ্রযাত্রায় এরা শকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই যুদ্ধে ইউয়েহ চিহ্-রা শকদের পরাজিত করে। এই সময় পরাজিত শকরা ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। পক্ষান্তরে ইউয়েহ চিহ্-রা শকদের বাসভূমি সিরদরিয়া দখল করে বসতি স্থাপন করে। এই অঞ্চলে ইউয়েহ চিহ্-রা প্রায় ২০ বৎসর শান্তিতে বসবাস করে। কিন্তু উ-সুং জাতির লোকেরা তাদের পূর্ব পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শকদের আবাসভূমিতে হামলা করে। এই হামলা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে ইউয়েহ চিহ্-রা সিরদরিয়া ত্যাগ করে অক্ষু উপত্যাকায় (
Oxus Valley) চলে আসে। এই অঞ্চলে এসে এরা যাযাবর স্বভাব ত্যাগ করে ক্রমে ক্রমে স্থায়ী বসতি স্থাপনে মনোযোগী হয়। কালক্রমে এরা পাঁচটি প্রধান শাখায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এদের একটি শাখা কালক্রমে কুষাণ নামে পরিচিত লাভ করে।

কুষাণ রাজবংশ
অক্ষু অঞ্চলে প্রায় ১০০ বৎসর বসবাস করার পর
ইউয়েহ চিহ্ জাতির কুষাণ শাখার অধিনায়ক কুজুল-কদিফিসেস, অন্যান্য শাখার মানুষদেরকে একত্রিত করে ওয়াং (রাজা উপাধি) উপাধি ধারণ করেন। এঁর রাজত্বকাল ধরা হয় ১৫-৬৫ খ্রিষ্টাব্দ)। ইতিহাসে তিনি প্রথম কদ্‌ফিসেসে নাম পরিচিত। কদ্‌ফিসেস প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে পহ্লবদের পরাজিত করে কিপিন ও কাবুল দখল করেন। এরপর তিনি ব্যাক্টেরিয়াতে স্বীয় অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই সময় তিনি হিন্দুকুশের দক্ষিণে তামার মুদ্রা চালু করেন। তিনি বেশ কিছু যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে পারশ্য সীমান্ত থেকে ঝিলম নদী বা সিন্ধু নদ পর্যন্ত রাজ্য বিস্তারে সক্ষম হন।

প্রথম কদ্‌ফিসেসে-র মৃত্যর পর, দ্বিতীয় কদ্‌ফিসেস রাজা হন ৬৫ খ্রিষ্টাব্দে। রাজত্ব লাভের পর তিনি পাঞ্জাব এবং গাঙ্গেয় উপত্যাকার একটি বিশাল অংশ দখল করেন। তাঁর সময় স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন হয়। ৭৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দ্বিতীয় কদ্‌ফিসেস রাজত্ব করেন। এরপর কুষাণ রাজ্যের রাজা হন সম্রাট কণিষ্ক ধারণা করা হয় কণিষ্ক ১৫১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। তাঁর পরবর্তী রাজা বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ পরবর্তী রাজাদের যোগ্যতা কখনোই কণিষ্কের মতো ছিল না । বিশেষত শেষ দুজনের আমলে কুষাণরা খুবই দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে অসংখ্য আঞ্চলিক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। উত্তরপ্রদেশে নাগ ও মাঘ বংশীয় রাজারা পাঞ্জাবে বৌধেয় প্রমুখরা বিদ্রোহে শামিল হয়। এই সময় পশ্চিম ভারতে শকগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং নিজেদের রাজ্যকে সুসংহিত করে। এছাড়া পারস্যের সাসনীয় সম্রাটদের হাতে কুষাণরা পরাস্ত হয়। অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা, অর্থনৈতিক ক্রমাবনতি, নানা ধরনের আক্রমণের সূত্রে কুষাণ সাম্রাজ্য ক্রমশ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায় ।

কথিত আছে কুষাণরা আল্তাই অঞ্চলের বিস্তর সোনার খনির মালিক ছিল এবং মধ্য এশিয়ার সঙ্গে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। আবার রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্যের ফলে সেখান থেকেও প্রচুর সোনা সংগ্রহ করত। বিখ্যাত 'রেশম পথ'টি (Silk Road) এদের দখলে ছিল। এই বাণিজ্যপথ ধরে চীন থেকে মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, ইরান হয়ে রোম শাসিত পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত এদের বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছিল। 

কুষাণরা বহু ছোটো ছোটো রাজ্যকে করদরাজ্যে পরিণত করেছিল। প্রত্যেক ছোট ছোট রাজ্য দুজন করে সামন্তরাজা কুষাণদের পক্ষে শাসন তদারক করতেন। সে আমলে রাজারা ছিলেন দেবতুল্য। অনেক সময় রাজাকে দেবতার অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হতো। সে আমলে শাস্ত্রকাররা ঘোষণা করেছিলেন 'অষ্টানাং লোকপালানাং মাত্রাভিনির্মিতো নৃপঃ', অর্থাৎ আটটি লোকপালের অংশ দিয়ে (দেবতারা) রাজাকে নির্মাণ করেন। এ ধারণা কুষাণ আমলেই প্রথমবার আসে, রাজার দেবত্ব প্রমাণের জন্যে মূর্তিতে ও চিত্রে রাজার মাথায় জ্যোতির্বলয় থাকত।

কুষাণদের শিল্প ও সাহিত্যঃ
কুষাণদের বিশাল সাম্রাজ্য বহু ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিল। তাদের সংমিশ্রণ ও সমন্বয়ে শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষ্টি-সংস্কৃতির উন্নতি অনেক সহজ হয়েছিল। তারপরও তারা উপমহাদেশের বাইরে থেকে অনেক ভাস্কর, স্থপতি ও অন্যান্য শিল্পী এদেশে আনিয়েছিলেন। এদের সংস্রবে ভারতীয় শিল্পে তিনটি মুখ্য ধারার সৃষ্টি হলো: মধ্য এশীয়, গান্ধার ও মথুরা। বৌদ্ধ প্রভাব মধ্য এশিয়াতে বেশি ছিল, সেখানে পাওয়া কিছু কিছু শিল্পকৃতির মধ্যে ভারতীয় ও মধ্য এশীয় আঙ্গিকের সংমিশ্রণ বেশ বোঝা যায়। গান্ধারে প্রধানত গ্রীক প্রভাবে রচিত ভারতীয় ভাস্কর্য দেখা যায়।

বুদ্ধমূর্তিতে এই প্রভাবের ফলে কোঁকড়া চুলের বিন্যাস, মুখে গোঁফ, কাপড়ে পরতে-পরতে ভাঁজ- এসবই ভারতীয় শিল্পে নতুন। এই প্রভাব মথুরা শিল্পরীতিতেও দেখা যায়, তবু মথুরায় ভারতীয় স্বকীয়তা সবচেয়ে বেশি পরিস্ফুট। লাল বেলে-পাথরে বুদ্ধ ছাড়াও মহাবীরের মূর্তিও এখানে গড়া হতো। আর পাওয়া গেছে কনিষ্কের মুণ্ডহীন মূর্তি, তার নিচে কনিষ্কের পরিচয় দেওয়া আছে। মথুরা কৃষ্ণকাহিনীর পীঠস্থান, তবু ঐ সময়ের কৃষ্ণের কোনো মূর্তি এখানে পাওয়া যায় নি। খ্রিষ্টীয় প্রথম তিনটি শতকেই 'মথুরা শিল্প'-এর বিকাশ ঘটেছিল। মূলত মথুরার শিল্পীদের সৃষ্ট মূর্তির মাধ্যমে বৌদ্ধ মূর্তি পূজার প্রচলন হয়। আর্যাবর্তে বৌদ্ধ শিল্পকলার সমধিক বিকাশ ঘটেছিল খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাঁচি, ভারহুত ও বুদ্ধগয়ার বিস্তৃত স্তূপ, প্রাচীন তোরণ ও মঠের নির্মাণে। এগুলিতে সমকালীন জীবনযাত্রাও সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়ে রয়েছে। শুধু স্থাপত্যে ভাস্কর্যে নয়, সংস্কৃত সাহিত্যেও এ যুগের শিল্পের উৎকর্ষ দেখা যায়। এদের সময় নাট্যকার ভাস তেরোটি নাটক রচনা করেন। ধারণা করা হয় সংস্কৃত ভাষায় তিনিই প্রথম নাটক রচনা করেছিলেন। এছাড়া অশ্বঘোষের রচিত 'বুদ্ধচরিত' ও 'সৌন্দরনন্দ' কাব্য দুটিও এদের সময় রচিত হয়েছিল। অবশ্য অশ্বঘোষের আর দুটি খণ্ডনাট্য পাওয়া যায়। এর ভিতরে একটির প্রভাব পরবর্তীকালের সাহিত্যে বিশেষ লক্ষণীয়। উল্লেখ্য, ভাস ও অশ্বঘোষের রচনাতে তখনকার সমাজচিত্রও পরিস্ফুট হয়েছে।

কুষাণ আমলের লিপি
ব্রাহ্মীলিপির প্রাচীনতম ব্রাহ্মীলিপি একটি আদর্শরূপে পৌঁছেছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ১০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে। কুষাণ আমলে ব্রাহ্মীলিপির সামান্য পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের ধারাকে কুষাণলিপি নামে অভিহিত করা হয়। এই ধারার সময়কাল ধরা হয়, ১০০ থেকে ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ।


সূত্র :