রাজা মানসিংহ

১৫৫০-১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দ।
মোগল সম্রাট আকবর  অন্যতম সেনাপতি।

১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর রাজস্থানের আম্বরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ভগবান দাসের পালিত পুত্র। উল্লেখ্য ভগবান দাস ভারতের পাঞ্জাবের সুবাহদার অভিষিক্ত হলে, মানসিংহ সিন্ধু নদের তীরবর্তী জেলাগুলোর শাসনের অধিকার পান।

১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে উদয় সিংহের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র রাণা প্রতাপ সিংহ পুনরায় মোগলদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। সম্রাট আকবর এবং আসফ খাঁর অধীনে একটি বিশাল সেনাবাহিনী। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে হলদিঘাটে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। এই যুদ্ধে প্রতাপ সিংহ পরাজিত হয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করেন।

১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে প্রশাসক হিসেবে কাবুলে পাঠানো হয়।
১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহারের সুবাহদার নিযুক্ত হন।
১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে ‘রাজা’ খেতাব এবং পাঁচ হাজারি মনসব প্রদান করা হয়।
১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উড়িষ্যা ও মেদেনীপুরের অধিকাংশ অঞ্চল দখল করে
১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ থেকে তাঁকে বাংলার সুবেদার পদ দেওয়া হয়।

১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি পূর্ববঙ্গকে মোগল শাসনাধীনে আনার জন্য মানসিংহ, বারো ভুইয়াদের  বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সময় তাণ্ডা ছিল মোগল শাসিত বাংলার রাজধানী। তাই তাণ্ডা থেকেই কিছু প্রস্তুতিমূলক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই বছরের ২রা এপ্রিল মানসিংহের পুত্র হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে এরূপ একটি পরীক্ষামূলক অভিযানে কেদার রায়ের ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করেন এবং মোগল অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি ঈসা খাঁ'র বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য, তাণ্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তিনি নতুন এই রাজধানীর নামকরণ করেন আকবরনগর। ৭ই নভেম্বর তিনি নতুন রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মানসিংহ প্রথমে শেরপুর মোর্চায় (বগুড়া জেলায়) শিবির স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি এই স্থানের নামকরণ করেন সেলিমনগর এবং বর্ষাকালটা তিনি সেখানেই কাটান। ইতোমধ্যে ঈসা খানের বন্ধু খাজা সুলায়মান খান নুহানী এবং কেদার রায় যৌথ আক্রমণ চালিয়ে ভূষণা দুর্গ পুনর্দখল করেন।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূষণা দুর্গ পুনর্দখলের জন্য মানসিংহ তাঁর পুত্র দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর, ২০শে জুন দুর্জন সিংহ দুর্গটি পুনর্দখল করতে সক্ষম হন।
 এই যুদ্ধে দুর্গের ভিতরে কামানের গোলা বিস্ফোরিত হওয়ার ফলে সুলায়মান লোহানী নিহত হন এবং কেদার রায় মারত্মকভাবে আহত হন। এরপর তিনি পালিয়ে ঈসা খাঁ'র কাছে আশ্রয় নেন।

এই বছরের বর্ষাকালে মানসিংহ ঘোড়াঘাটে তাঁর শিবির স্থাপন করেন। এখানে পৌঁছে মানসিংহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে সুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঈসা খান ও তাঁর মিত্রদের বিরুদ্ধে হিম্মত সিংহের নেতৃত্বে একটি ছোট সৈন্যদল পাঠান। হিম্মত সিংহ নিকটবর্তী হলে ঈসা খাঁ এগারসিন্ধুর এর দিকে পশ্চাদপসরণ করেন।

১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদীর সম্মিলনস্থলে, বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও উপজেলার সম্পূর্ণ দক্ষিণ প্রান্তের টাঙ্গার গ্রামে হয়।

১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মানসিংহ স্থল ও জলপথে ঈসা খা'র বিরুদ্ধে দুটি বিরাট বাহিনী পাঠান। এই বাহিনী প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য লাভ করে। এই সময় এরঁ ঈসা খানের রাজধানী কাত্রাবো আক্রমণ করে। কিন্তু ৫ই সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর থেকে ২০ কি.মি. দূরে এক নৌ-যুদ্ধে দুর্জন সিংহ নিহত হন এবং মোগল বাহিনী বিধ্বস্ত হয়। এরপর তিনি ঈসা খাঁ'র সাথে সন্ধি করেন। এভাবে ঈসা খাঁ'র বিরুদ্ধে মানসিংহের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং হতোদ্যম মানসিংহ ১৫৯৮ খ্রিষ্টাব্দে আজমীরের উদ্দেশে বাংলা ত্যাগ করেন।

১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে রাণা প্রতাপ সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র অমর সিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আকবর অমর সিংহের বিরুদ্ধে মানসিংহ এবং যুবরাজ সেলিমকে পাঠান। অমর সিংহ পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন। এমন সময় বাংলাদেশে উসমান বিদ্রোহ করেন। ফলে উসমানকে দমন করার জন্য আকবর মানসিংহকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার আদেশ।

১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈসা খাঁ'র মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র মুসা খাঁ ক্ষমতা লাভ করেন।

১৬০১ খ্রিষ্টাব্দেরর প্রথম দিকে মানসিংহ দ্বিতীয়বার সুবাহদার হিসেবে বাংলায় আসেন। এবারে তিনি ১২ই ফেব্রুয়ারি শেরপুর আতাই-এর যুদ্ধে আফগান বিদ্রোহীদের পরাজিত করেন।

১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা অভিমুখে অভিযান পরিচালনা করেন। এই সময় শ্রীপুরের জমিদার কেদার রায়কে মোগলদের পক্ষে আনার চেষ্টা করেন। এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি উত্তরবঙ্গের মালদহ এলাকার হামলাকারী জালাল খানের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। একই সাথে আফগান দলপতিদের কাজী মুমিনের বিরুদ্ধে মানসিংহ ঘোড়াঘাট থেকে তাঁর পৌত্র মহাসিংহের অধীনে এক বাহিনী প্রেরণ করেন। এই অভিযানে মহাসিংহের নেতৃত্বাধীন বাহিনী আফগান দলপতিদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। এরপর তিনি দ্রুত ঢাকা থেকে ভাওয়াল অভিমুখে অগ্রসর হয়ে উসমান খানকে পরাজিত করেন।

১৬০২ খ্রিষ্টাব্দের এক নৌযুদ্ধে রাজা মানসিংহ মুসা খাঁর বাহিনীকে পরাজিত করলেও, শেষ পর্যন্ত তাঁকে বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেন নি। এই সময় রাজধানী সোনারগাঁও ছাড়াও খিজিরপুর, কাত্রাবো, কদমরসুল, যাত্রাপুর, ডাকচর, শ্রীপুর ও বিক্রমপুর তার দূর্ভেদ্য সামরিক ঘাটি ছিল।
 

১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মগ জলদস্যুরা বিশাল নৌবহর নিয়ে জলপথে ঢাকা আক্রমণ করে। বিশেষ করে এরা ত্রিমোহনীতে মোগল দুর্গের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মোগল বাহিনী তাদের তাড়া করলে সংঘর্ষে বহুসংখ্যক মগ নিহত হয়। এই সময় মগদের সহায়তায় কেদার রায় শ্রীনগরে মোগল ঘাঁটি আক্রমণ করেন। বিক্রমপুরের অনতিদূরে দুপক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কেদার রায় আহত ও বন্দি হন। বন্দী অবস্থায় তাঁকে রাজা মানসিংহের নিকট নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়। কেদার রায়ের মৃত্যুর পর শ্রীপুর, বিক্রমপুরের দুর্গ মুসা খাঁ নিজ অধিকারে আনেন। শেষ পর্যন্ত মানসিংহ পুরোপুরি বাংলাকে মোগল সাম্রজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হন। এবং ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে মানসিংহ আগ্রার উদ্দেশে বাংলা ত্যাগ করেন।

১৬০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলার সুবেদার পদে বহাল ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে বাংলা থেকে প্রত্যাহার করে বিহারে পাঠানো হয়।

সম্রাট আকবরের  শাসনামলের শেষ দিনগুলিতে মানসিংহ আগ্রায় অবস্থান করেন এবং তাঁর ভাগ্নে খসরুকে সিংহাসনে বসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। সম্রাট আকবরের পুত্র  সিংহাসনে আরোহণের পর,
সম্রাট জাহাঙ্গীর মানসিংহকে তৃতীয় বারের মতো সুবাহদার হিসেবে বাংলায় পাঠান। তবে তৃতীয়বারে তাঁর সুবাহদারি ছিল স্বল্পস্থায়ী এবং এসময় কোন উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি।

দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুলাই মানসিংহের মৃত্যু হয়।