জাহাঙ্গীর, সম্রাট
(১৫৬৯-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ)
মোগল সাম্রাজ্যের চতুর্থ সম্রাট।

১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট আকবর -এর মৃত্যুর পর, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র আকবর সিংহাসনে বসেন। তাঁর জন্ম নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। আকবরের পুত্র সন্তানগুলোর শিশুকালে মৃত্যু হলে, তিনি পুত্রলাভের জন্য আজমীড়ে সেলিম চিস্তির দরগায় মানত করেন। অবশেষে ১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেল, তিনি এঁর নাম রাখেন সেলিম।

১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে আকবর ভগবান দাসের কন্যার সাথে সেলিমের বিবাহ দেন।

১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপ সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র অমর সিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আকবর অমর সিংহের বিরুদ্ধে মানসিংহ এবং যুবরাজ সেলিমকে পাঠান। অমর সিংহ পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন।

অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে আকবরের দুই পুত্র মুরাদ এবং দানিয়েল তাঁর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অবশিষ্ট পুত্র সেলিম ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহ করেছিলেন। তারপরেও আকবর পুত্র স্নেহে তাঁকে ক্ষমা করে দেন। ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের মৃত্যুর পর, সেলিমের পুত্র খসরুকে মোগল সিংহাসনে বসানোর উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে রাজত্ব শুরু করেন। এই সময় খসরু আগ্রায় নজরবন্দী ছিলেন। এরপর খসরু আগ্রা থেকে পালিয়ে পাঞ্জাবে যান এবং সেখানে বিদ্রোহ করেন। এরপর জাহাঙ্গীর তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠান। খসরু পরাজিত হয়ে কাবুলের দিকে রওনা দেন। পথিমধ্যে তিনি মোগল সৈনদের হাতে ধরা পরেন এবং তাঁকে আগ্রাতে আনা হয়। জাহাঙ্গীর তার সকল অনুচরদের মৃত্যুদণ্ড দেন। খসরুকে অর্থ সাহায্য করার জন্য শিখ গুরু অর্জুনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কথিত আছে জাহাঙ্গীর খসরুকে অন্ধ করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। প্রথমাবস্থায় জাহাঙ্গীর রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার দিকে মনোযোগী হন।

১৬০৫-৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে, জাহাঙ্গীর মেবারের বিরুদ্ধে একটি অভিযান চালান। এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যুবরাজ পারভেজ। এই অভিযান শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে মহবৎ খানের অধীনে আবার মেবার অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে মেবারের রাণা অমরসিংহ পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। তারপরেও সম্পূর্ণ মেবার দখল করা সম্ভব হয় নি।

আলীকুল বেগ নামক জনৈক পারশ্যের যুবক কাবুলের দেওয়ান গিয়াসবেগের কন্যা মেহেরুন্নেসার বিবাহ হয়। সেই সূত্রে গিয়াসবেগের তত্ত্বাবধানে আলীকুল বাংলাতে জায়গির লাভ করেন। এই সময় তিনি শের আফগান নাম ধারণ করেন। শের আফগান বাংলাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, জাহাঙ্গীর বাংলার শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন কোকাকে নির্দেশ দেন, যেন অতি দ্রুত শের আফগানকে বন্দী করে দিল্লীতে পাঠানো হয়। কুতুবউদ্দিন কোকা তাঁকে গ্রেফতার করতে গেলে, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং শের আফগান নিহত হন। এরপর মেহেরুন্নেসা এবং তাঁর শিশু কন্যাকে বন্দী করে আগ্রায় আনা হয়। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মেহেরুন্নেসার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে, জাহাঙ্গীর তাঁকে বিবাহ করেন এবং নাম দেন নুরজাহান

রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল। কথিত আছে জাহাঙ্গীরের নামে তিনি রাজ্য শাসন করতেন। তিনি নিজের আত্মীয়দের দরবারের উচ্চপদে চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধে জাহাঙ্গীর তাঁর ভাই আসফ খাঁকে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন। তাঁর আগের ঘরের কন্যার সাথে যুবরাজ শাহরিয়ারে বিবাহ দেন।

১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ খুররমের অধীনে তৃতীয়বার মেবার অভিযান পরিচালিত হয়। এবারের যুদ্ধে অমরসিংহ সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়ে সন্ধি করেন। এই সন্ধি অনুসারে অমরসিংহ ১০০০ অশ্বারোহী সৈন্য জাহাঙ্গীরকে প্রদান করেন। অমরসিংহের পুত্র যুবরাক করণ সিংহ ৫০০০ সৈন্যের মনসবাদার হন। চিতোর রাণাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এবং রাজপুত কন্যাদের মোগল দরবারে পাঠাবার ক্ষেত্রে কোনো বাধা রইল না।

বাংলাদেশের উপর আধিপত্য অর্জনের জন্য, ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর নির্দেশে বাংলায় মোগল শাসক হিসেবে আসেন ইসলাম খান ইসলাম খান প্রথম বড় ধরনের অভিযান চালান মুসা খাঁর বিরুদ্ধে। পথিমধ্যে ইসলাম খান খুলনা-যশোহর অঞ্চলে ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যকে আক্রমণের উদ্যোগ নিলে, তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন এবং মুসা খাঁ-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সাহায্য করার অঙ্গীকার করেন। ১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান তৎকালীন বাংলার সীমান্ত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন।  ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ক্রমাগত আক্রমণের মুখে, মুসা খাঁর সামরিক শক্তি হ্রাস পায়। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে মোগল বাহিনী যাত্রাপুর ও ডাকচারা দুর্গ দখল করে নেয়। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোগলরা ঢাকা থেকে সোনারগাঁও আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুসা খাঁ পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে, মোগলবাহিনীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেই মোগলরা ময়মনসিংহের ভুঁইয়া উসমানের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। প্রবলভাবে বাধা দেওয়ার পরেও উসমান পরাজিত হন এবং তিনি পালিয়ে শ্রীহট্টের আফগান ভুঁইয়া বায়জিদ কর্‌রানির আশ্রয়ে চলে যান। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে  ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। মুসা খাঁর সাথে যুদ্ধের সময় তিনি চুক্তি অনুসারে মোগলদের সাহায্য করেন নি, এই অজুহাতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। বাখেরগঞ্জের ভুঁইয়া রামচন্দ্র ছিলেন প্রতাপাদিত্যের জামাতা। রামচন্দ্র যাতে প্রতাপাদিত্যকে সাহায্য না করতে পারেন, সে কারণে ইসলাম খাঁ একই সাথে রামচন্দ্র-এর বিরুদ্ধে অপর একটি সেনাদল পাঠান।  প্রতাপাদিত্য যশোহর রক্ষার জন্য তাঁর পুত্র উদয়াদিত্যকে নিয়োগ করেন আর নিজে তাঁর রাজ্যের রাজধানী ধুমঘাট প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধে প্রথমে উদয়াদিত্য এবং পরে প্রতাপাদিত্য পরাজিত বন্দী হন। পরে বন্দী অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান পুনরায় উসমানের রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধের প্রথম থেকেই উসমান ক্রমাগত জয়লাভ করতে থাকেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তীরবিদ্ধ হয়ে উসমানের মৃত্যু হলে, আফগান সৈন্যরা মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর ভিতর দিয়ে বাংলার ভুঁইয়াদের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে  ইসলাম খান তৎকালীন বাংলার সীমান্ত রাজ্য কুচবিহার এবং কামরূপ রাজ্য দখল করেন। ইসলাম খাঁন ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে অহোম রাজ্য আক্রমণ করেন কিন্তু সফল হতে পারেন নি।

 

মেবার এবং বাংলার যুদ্ধের পাশাপাশি, জাহাঙ্গীর দাক্ষিণ্যত্য বিজয়ের উদ্যোগ নেন। আহম্মদনগরের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীর প্রথম সেনাবাহিনী পাঠান ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে। এই আক্রমণ আহম্মদনগর রাজ্যের শাসক মালিক অম্বর প্রতিহত করেন। ১৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর খুরমকে দাক্ষিণাত্যে অভিযানে পাঠান। এবারে মালিক অম্বর পরাজিত হন এবং মালিক অম্বর বালাঘাট অঞ্চল এবং আহম্মদনগরের দুর্গ মোগলদের কাছে অর্পণ করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর, সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে শাহজাহান উপাধি দেন। এর কিছুদিন পর মোগলবাহিনীর অরাজকতার সুযোগে মালিক অম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে শাহজাহানকে আবার যুদ্ধে পাঠানো হয়। এবারও মালিক অম্বর পরাজিত হন। এবারের যুদ্ধে মোগল বাহিনী বিজাপুর, আহম্মদনগর ও গোলকুণ্ডা অধিকার করেন। এই সময় মালিক অম্বর বিপুল অঙ্কের টাকা নজরানা দিয়ে মোগলদের সাথে সন্ধি করেন।

১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনী রাভি ও ঝিলম নদীর মধ্যবর্তী কাংড়া বা নাভিকোট আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে নগরকোট দুর্গের অধিপতি রায় বিক্রমজিৎ মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন।

১৬২২ খ্রিষ্টাব্দে পারশ্য সৈন্য কান্দাহার অবরোধ করলে, সেখানকার সেনাপ্রধান জাহাঙ্গীরের কাছে সৈন্য প্রার্থনা করেন।  নুরজাহান কান্দাহার জয়ের জন্য শাহজাহানকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেল, শাহজাহান এই অভিযানে যেতে অস্বীকার করেন। শাহাজাহান ভেবেছিলেন কান্দাহারে পাঠিয়ে নূরজাহান তাঁকে হত্যা করার ব্যবস্থা করবেন। শাহাজাহানের বিদ্রোহের সূত্রে মোগল বাহিনীর সাথে ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে জাহাঙ্গীর মহব্বৎ খাঁ নামক একজন সেনাপতিকে পাঠান। যুদ্ধে শাহাজাহান পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। এই সময় যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবৎ খাঁকে শাহাজাহানের বিরুদ্ধে পাঠালে, শাহজাহান উড়িষ্যা, বিহার ও বঙ্গদেশ দখল করে নেন।  কিন্তু এলাহাবাদের কাছে এক যুদ্ধে  যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবৎ খাঁর সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে যান। এই সময় তিনি মালিক অম্বরের সাথে যোগ দেন। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শাহাজাহান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী শাহজাহানকে ক্ষমা করে দেন।

শাহাজাহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ ও মহব্বৎ খানের সাফল্যে  নুরজাহান শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানোর জন্য, প্রথমে এই দুই সেনাপতিকে পৃথক করে ফেলেন। তিনি মহব্বৎ খানকে বাংলাদেশের যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু নুরজাহান মহব্বৎ খাঁয়ের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ তুলে রাজধানীতে আসার ফরমান জারি করেন। নুরজাহান মহব্বৎ খানের কাছে বাংলা ও বিহার থেকে সংগৃহীত সকল হাতি ও যুদ্ধের সকল খরচের হিসেব চান। জাহাঙ্গীর এই সময় পাঞ্জাবে ছিলেন। মহব্বৎ খাঁ প্রায় পাঁচ হাজার রাজপুত সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হন। এই সংবাদ  নুরজাহান পেলে, তিনি আতঙ্কিত হয়ে মহব্বৎ খাঁকে আর অগ্রসর না হওয়ার আদেশ দেন। একই সাথে তিনি এই কৈফিয়ত চান যে, কেন তিনি বিনা অনুমতিতে তাঁর কন্যার সাথে বারমুদার নামক এক আমিরের বিবাহ দিয়েছেন। নুরজাহানের এই আচরণে, মহব্বৎ খাঁ আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং জাহাঙ্গীরকে পাঞ্জাবে বন্দী করেন। নূরজাহান জাহাঙ্গীরকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে, মহব্বৎ খানের কাছে আত্ম-সমর্পণ করেন। পরে কৌশলে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলে, মহব্বৎ খাঁ দাক্ষিণাত্যে শাহাজাহানের সাথে মিলিত হন। ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ পারভেজ মৃত্যুবরণ করেন। কাশ্মীর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর মৃত্যবরণ করেন। ফলে সিংহাসনের দাবিদার হন শাহজাহান এবং শাহরিয়ার। শেষ পর্যন্ত দিল্লীর সিংহাসনে বসেন শাহজাহান


সূত্র: