নুরজাহান, সম্রাজ্ঞী
পিতার নাম মির্জা গিয়াসউদ্দিন বেগ। ইরানী বংশোদ্ভুত গিয়াসবেগ ভাগ্যানুসন্ধানে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথে কান্দাহারে তিনি নুরজাহানের জন্ম হয়। পিতামাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন মেহেরুন্নেসা। মালিক মাসুদ নামক ব্যাবসায়ীর সহায়তায় গিয়াসউদ্দিন আকবরের দরবারে সামান্য পদে চাকরি পান। পরে নিজ কৃত্বিত্বে কাবুলের দেওয়ান পদ লাভ করেন। সতেরো বৎসর বয়সে আলীকুলি বেগ নামক এক পারশিক যুবকের সাথে মেহেরুন্নেসার দেখা হয়। গিয়াসউদ্দিনের সহায়তায় আলীকুলি বাংলাদেশের জায়গির পান। এখানে তাঁর কৃতিত্বের জন্য শের আফগান উপাধি লাভ করেন। বাংলাদেশে মেহেরুন্নেসা আসেন স্বামী আলীকুলির সাথে। বাংলাদেশে থাকার সময়, নুরজাহান একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।
শের আফগান বাংলাতে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, জাহাঙ্গীর বাংলার শাসনকর্তা কুতুবউদ্দিন কোকাকে নির্দেশ দেন, যেন অতি দ্রুত শের আফগানকে বন্দী করে দিল্লীতে পাঠানো হয়। কুতুবউদ্দিন কোকা তাঁকে গ্রেফতার করতে গেলে, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং শের আফগান নিহত হন। এরপর মেহেরুন্নেসা এবং তাঁর শিশু কন্যাকে বন্দী করে আগ্রায় আনা হয়। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে মেহেরুন্নেসার রূপে ও গুণে মুগ্ধ হয়ে, জাহাঙ্গীর তাঁকে বিবাহ করেন এবং নাম দেন নুরজাহান।
নুরজাহান অত্যন্ত বিদুষী এবং অসামান্যা রূপবতী ছিলেন। মোগল দরবারে জাঁকজমক বৃদ্ধিতে তাঁর প্রভাব ছিল। দৈহিক শক্তিতেও তিনি সাধারণ নারীদের চেয়ে অগ্রগামিনী ছিলেন। এছাড়া তাঁর অসীম সাহসী ছিলেন। কথিত আছে, একবার জাহাঙ্গীরের সাথে মৃগয়ায় গিয়ে তিনি নিজে একটি বাঘ শিকার করেছিলেন। এই কারণে, জাহাঙ্গীর তাঁকে একটি মূল্যবান অলঙ্কার উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। দয়া-দাক্ষিণ্যের ক্ষেত্রেও তাঁর সুনাম ছিল।
রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল। কথিত আছে জাহাঙ্গীরের নামে তিনি রাজ্য শাসন করতেন। তিনি নিজের আত্মীয়দের দরবারের উচ্চপদে চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধে জাহাঙ্গীর তাঁর ভাই আসফ খাঁকে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন। তাঁর আগের ঘরের কন্যার সাথে যুবরাজ শাহরিয়ারে বিবাহ দেন।
১৬২২ খ্রিষ্টাব্দে পারশ্য সৈন্য কান্দাহার অবরোধ করলে, সেখানকার সেনাপ্রধান জাহাঙ্গীরের কাছে সৈন্য প্রার্থনা করেন। নুরজাহান কান্দাহার জয়ের জন্য শাহজাহানকে পাঠানোর ব্যবস্থা করলে, শাহজাহান এই অভিযানে যেতে অস্বীকার করেন। শাহজাহান ভেবেছিলেন কান্দাহারে পাঠিয়ে নূরজাহান তাঁকে হত্যা করার ব্যবস্থা করবেন। শাহজাহানের বিদ্রোহের সূত্রে মোগল বাহিনীর সাথে তাঁর ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে জাহাঙ্গীর মহব্বৎ খাঁ নামক একজন সেনাপতিকে পাঠান। যুদ্ধে শাহজাহান পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। এই সময় যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবৎ খাঁকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে পাঠালে, শাহজাহান উড়িষ্যা, বিহার ও বঙ্গদেশ দখল করে নেন। কিন্তু এলাহাবাদের কাছে এক যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ ও সেনাপতি মহবৎ খাঁর সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে যান। এই সময় তিনি মালিক অম্বরের সাথে যোগ দেন। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শাহজাহান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী শাহজাহানকে ক্ষমা করে দেন।
শাহজাহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ ও মহব্বৎ খানের সাফল্যে নুরজাহান শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানোর জন্য, প্রথমে এই দুই সেনাপতিকে পৃথক করে ফেলেন। তিনি মহব্বৎ খানকে বাংলাদেশের যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু নুরজাহান মহব্বৎ খাঁয়ের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ তুলে রাজধানীতে আসার ফরমান জারি করেন। নুরজাহান মহব্বৎ খানের কাছে বাংলা ও বিহার থেকে সংগৃহীত সকল হাতি ও যুদ্ধের সকল খরচের হিসেব চান। শাহজাহান এই সময় পাঞ্জাবে ছিলেন। মহব্বৎ খাঁ প্রায় পাঁচ হাজার রাজপুত সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবের দিকে অগ্রসর হন। এই সংবাদ নুরজাহান পেলে, তিনি আতঙ্কিত হয়ে মহব্বৎ খাঁকে আর অগ্রসর না হওয়ার আদেশ দেন। একই সাথে তিনি এই কৈফিয়ত চান যে, কেন তিনি বিনা অনুমতিতে তাঁর কন্যার সাথে বারমুদার নামক এক আমিরের বিবাহ দিয়েছেন। শাহজাহানের এই আচরণে, মহব্বৎ খাঁ আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং জাহাঙ্গীরকে পাঞ্জাবে বন্দী করেন। নুরজাহান জাহাঙ্গীরকে উদ্ধারের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে, মহব্বৎ খানের কাছে আত্ম-সমর্পণ করেন। পরে কৌশলে জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলে, মহব্বৎ খাঁ দাক্ষিণাত্যে শাহাজাহানের সাথে মিলিত হন। ১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ পারভেজ মৃত্যুবরণ করেন। কাশ্মীর থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর মৃত্যবরণ করেন। ফলে সিংহাসনের দাবিদার হন শাহজাহান এবং শাহরিয়ার।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সময়, শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে ছিলেন। তাই আসফ খাঁ (শাহজাহানের শ্বশুর) জাহাঙ্গীরের প্রথম পুত্র খসরু (আগেই নিহত হয়েছিলেন)-র প্রথম পুত্র দাওয়ার বক্সকে অস্থায়ী সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। এই সময় নুরজাহান লাহোরে শাহরিয়ারকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। আসফ খাঁ দ্রুত লাহোর আক্রমণ করে শাহরিয়ারকে বন্দী করেন এবং চোখ উপরে ফেলেন। জাহাঙ্গীর নুরজাহানকে ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর জন্য বাৎসরিক দুই লক্ষ টাকার বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে নুরজাহান মৃত্যবরণ করেন।
সূত্র: