শাহজাহান
ফার্সি নাম شاه جهان।
(শাহ্জাহান, অর্থ : পৃথিবীর রাজা)।
ভারতবর্ষের পঞ্চম মোগল সম্রাট। তাঁর পূর্ণ নাম
শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহান।
শৈশবে এঁর নাম ছিল খুররম। সিংহাসনে আরোহণের পর তাঁর নতুন নাম হয়
'আবুল মুজাফফর শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান
সাহিব কিরান-ই-সানী'
।
১৫৯২ খ্রিষ্টাব্দের ৫
জানুয়ারি, তিনি লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন চতুর্থ মোগল সম্রাট
জাহাঙ্গীর। তার মা ছিলেন রাজপুত
রমণী। মায়ের নাম মনমতি। তিনি ছিলেন জাহাঙ্গীরের তৃতীয় পুত্র।
সাহসিকতা ও
বুদ্ধিমত্তায় তিনি অল্প বয়সেই সম্রাট
জাহাঙ্গীরের প্রিয়পাত্র হন। ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি আট হাজারি মনসবদারি পদ লাভ করেন। এই বৎসরেই আসফ খাঁর কন্যা
মমতাজ মহলের সাথে (আরজুমান্দ বানু বেগম)
শাহজাহানের বাগদান হয়। ১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
দশ হাজারি মনসবদারি পদ লাভ
করেন। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে
মমতাজ মহলের সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের অন্যতম পত্নী
নুরজাহান, তাঁর প্রথম
ঘরের সন্তান কন্যার সাথে কনিষ্ঠ যুবরাজ শাহরিয়রের বিবাহ দেন। এই সময়
নুরজাহান শাহারিয়ারকে
সিংহাসনে বসানোর চেষ্টা করেন। ফল শাহজাহানের সাথে
নুরজাহানের বৈরীতা শুরু হয়। আর সম্রাট
জাহাঙ্গীরও প্রিয় পত্নীর মন রক্ষার্থে শাহজাহানের প্রতি বিরক্ত হন।
১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে মেবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধের
সময় শাহাজাহানকে সেনাপ্রধান করে পাঠানো হয়। এই যুদ্ধে শাহজাহান মেবারের রাজা অমর সিংহের
বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে অমর সিংহের সাথে মোগলদের একটি সন্ধিচুক্তি
হয়। এই চুক্তি অনুসারে, অমর সিংহ এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্য মোগল দরবারে পাঠান। ১৬১৬
খ্রিষ্টাব্দে তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযান চালান। তিনি মালিক অম্বরকে
পরাজিত করেন। এই সময় মালিক অম্বর বালাঘাট অঞ্চল এবং আহম্মদনগরের দুর্গ মোগলদের কাছে
অর্পণ করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর, সম্রাট
জাহাঙ্গীর তাঁকে 'শাহজাহান' উপাধি দেন। এর
কিছুদিন পর মোগলবাহিনীর অরাজকতার সুযোগে মালিক অম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে মালিক
অম্বরের বিরুদ্ধে শাহাজাহানকে আবার যুদ্ধে পাঠানো হয়। এবারও মালিক অম্বর পরাজিত হন।
এবারের যুদ্ধে মোগল বাহিনী বিজাপুর, আহম্মদনগর ও গোলকুণ্ডা অধিকার করেন। এই সময়
মালিক অম্বর বিপুল অঙ্কের টাকা নজরানা দিয়ে মোগলদের সাথে সন্ধি করেন।
১৬২২
খ্রিষ্টাব্দে পারশ্য সৈন্য কান্দাহার অবরোধ করলে, সেখানকার সেনাপ্রধান জাহাঙ্গীরের
কাছে সৈন্য প্রার্থনা করেন।
নুরজাহান কান্দাহার জয়ের জন্য শাহজাহানকে পাঠানোর
ব্যবস্থা করলে, শাহজাহান এই অভিযানে যেতে অস্বীকার করেন।
শাহজাহান ভেবেছিলেন কান্দাহারে পাঠিয়ে
নুরজাহান তাঁকে হত্যা করার ব্যবস্থা করবেন।
শাহজাহানের বিদ্রোহের সূত্রে মোগল বাহিনীর সাথে ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি যুদ্ধ হয়।
যুদ্ধে শাহজাহান পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান। এই সময় যুবরাজ পারভেজ ও
সেনাপতি মহবৎ খাঁকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে পাঠালে, শাহজাহান উড়িষ্যা, বিহার ও
বঙ্গদেশ দখল করে নেন। কিন্তু এলাহাবাদের কাছে এক যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ
ও সেনাপতি মহবৎ খাঁর সাথে যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে দাক্ষিণাত্যের দিকে যান। এই সময়
তিনি মালিক অম্বরের সাথে যোগ দেন। ১৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে মোগল
বাহিনীর সাথে যুদ্ধে শাহাজাহান পরাজিত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন। জাহাঙ্গীর বিদ্রোহী
শাহজাহানকে ক্ষমা করে দেন।
শাহজাহানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুবরাজ পারভেজ ও
মহব্বৎ খানের সাফল্যে
নুরজাহান শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানোর
জন্য, প্রথমে এই দুই সেনাপতিকে পৃথক করে ফেলেন। তিনি মহব্বৎ খানকে বাংলাদেশের
যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু
নুরজাহান মহব্বৎ খায়ের বিরুদ্ধে গুরুতর কিছু অভিযোগ
তুলে রাজধানীতে আসার ফরমান জারি করেন।
নুরজাহান এবং
জাহাঙ্গীর কাবুলের যাওয়ার পথে
কৌশলে আক্রমণ করে জাহাঙ্গীরকে বন্দী করেন।
নুরজাহান
জাহাঙ্গীরকে উদ্ধারের চেষ্টা
করে ব্যর্থ হয়ে, মহব্বৎ খানের কাছে আত্ম-সমর্পণ করেন। পরে কৌশলে
জাহাঙ্গীরকে উদ্ধার
করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলে, মহব্বৎ খা দাক্ষিণাত্যে শাহজাহানের সাথে মিলিত হন।
১৬২৬ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ পারভেজ মৃত্যুবরণ করেন। কাশ্মীর
থেকে প্রত্যাবর্তনকালে ১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে জাহাঙ্গীর মৃত্যবরণ করেন। ফলে সিংহাসনের
দাবিদার হন শাহজাহান এবং শাহরিয়ার।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর সময়, শাহজাহান দাক্ষিণাত্যে ছিলেন। তাই
আসফ খাঁ (শাহাজাহানের
শ্বশুর) জাহাঙ্গীরের প্রথম পুত্র খসরু (আগেই নিহত হয়েছিলেন)-র প্রথম পুত্র দাওয়ার
বক্সকে অস্থায়ী সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। এই সময় নূরজাহান লাহোরে শাহরিয়ারকে
সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। আসফ খাঁ দ্রুত লাহোর আক্রমণ করে শাহরিয়ারকে বন্দী করেন এবং
চোখ উপরে ফেলেন। শাহরিয়ারের এই বিপর্যয়ের পর
নুরজাহান রাজনীতি থেকে অবসর নেন। অবশ্য তিনি
নুরজাহানকে
ক্ষমা করে দেন এবং তাঁর জন্য বাৎসরিক দুই লক্ষ টাকার বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা
করেন। ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে
নুরজাহান মৃত্যবরণ করেন।
শাহাজাহনের সিংহাসন লাভ এবং জুজার সিংহের
বিদ্রোহ দমন
১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে শাহাজাহান আগ্রায় আসেন। তিনি সিংহাসনের সকল প্রতিদ্বন্দ্বীদের
হত্যা করেন। এই সময় দাওয়ার বক্স পারশ্যে পালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত তিনি মোগল
সিংহাসনের অধিকারী হন। এই বৎসরেই বুন্দেলা নেতা জুজার সিংহ বিদ্রোহ করেন। মাত্র
কয়েকদিনের যুদ্ধের পর জুজার সিংহ মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এই সময় জুজার
সিংহ এই যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৫ লক্ষ টাকা এবং ১ হাজার মোহর মোগল বাহিনীকে দেন।
এর বদলে শাহজাহান তাঁকে জায়গীর প্রদান করেন।
দাক্ষিণাত্যের মোগল শাসনকর্তা খান-জাহান লোদীর বিদ্রোহ
দাক্ষিণাত্যের মোগল শাসনকর্তা খান-জাহান লোদী, আহমদ নগরের সুলতানের সাথে মিলিত হয়ে
বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান এই বিদ্রোহ দমনে দাক্ষিণাত্যে
চালান। যুদ্ধে খান-জাহান লোদী পরাজিত ও নিহত হন। এরপর তিনি দাক্ষিণাত্যে শান্তি
স্থাপনে সক্ষম হন।
১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে উড়িষ্যায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের পরপরই
উড়িষ্যায় ব্যাপক মড়ক দেখা দেয়। এই সময়, শাহাজাহান সাত লক্ষ টাকার রাজস্ব মওকুফ করে
দেন এবং সরকারী ব্যবস্থাপনায় লঙ্গরখানা খোলা হয়।
আহম্মদনগর জয়
১৬১৯ খ্রিষ্টাব্দে মালিক অম্বরের মৃত্যুর পর আহম্মদনগরে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু
হয়। মালিক অম্বরের পুত্র ফতে খাঁ প্রথমে আহম্মদনগর রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। এই
রাজ্যের সুলতান মর্তুজার সাথে দ্বন্দ্ব উপস্থাইত হলে, সুলতান মর্তুজা ফতে খাঁকে
বন্দী করে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। পরে তিনি ফতে খাঁকে মুক্তি দেন। ফতে খাঁ এই
অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মোগলদের সাথে পরামর্শ করে, সুলতান মর্তুজাকে বন্দী
করেন এবং তাঁর নাবালক পুত্র হুসেন শাহকে সিংহাসনে বসান। ফলে ফতে খাঁ এই রাজ্যের
প্রকৃত সুলতানে পরিণত হন। এই সময় শাহজাহান আহম্মদনগর জয় করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে মোগল বাহিনী দৌলতাবাদ দুর্গ অবরোধ করে। এই
সময় আহম্মদনগরের সুলতান ছিলেন এই সময় মালিক অম্বরের পুত্র ফতে খাঁ দশ লক্ষ টাকা
উৎকোচ গ্রহণ করে, দুর্গটি মোগলদের কাছে সমর্পণ করেন। সুলতান হুসেন শাহকে গোয়ালিয়র
দুর্গে পাঠানো হয়। আর ফতে খাঁকে মোগল সরকারের উচ্চপদ দেওয়া হয়।
মমতাজ মহলের মৃত্যু এবং তাজমহলের সূচনা
১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী
মমতাজ মহল (আরজুমান্দ বানু)
চতুর্দশ সন্তান গহর বেগমের প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। এই স্ত্রীর মৃত্যুতে
শাহজাহান প্রচণ্ড শোকাহত হন। এই স্ত্রীর স্মরণে তিনি একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের
উদ্যোগ নেন। এই স্মৃতিসৌধটি
তাজমহল
নামে খ্যাত। উল্লেখ্য মূল
তাজমহল তৈরির কাজ শেষ
হয়েছিল ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। পরিকল্পনা অনুসারে সম্পূর্ণ তাজমহল শেষ হয়েছিল ১৬৫৩
খ্রিষ্টাব্দে।
পর্তুগিজ দমন
সম্রাট আকবর এবং জাহাঙ্গীরের বদান্যতায় হুগলীর সাতগাঁও অঞ্চলে বাণিজ্যকেন্দ্র
স্থাপনের অনুমতি পেয়েছিল। পরে এরা নানাস্থানে কুঠি নির্মাণ করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি
করে। এই সময় তারা ক্রীতদাস ব্যবসা, জলদস্যুতা, স্থানীয়দের ধর্মান্তরিত করার মতো কাজ
শুরু করে। এরই মধ্যে পর্তুগিজরা সম্রাজ্ঞী মমতাজমহলের দুইজন ক্রীতদাসীকে আটক করেল,
শাহাজাহান পর্তুগিজদের দমনের জন্য কাসিম খাঁকে প্রেরণ করেন। প্রায় তিন মাস যুদ্ধের
পর, পর্তুগিজ বাহিনী সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এই যুদ্ধে পর্তুগিজ বাহিনীর বহু সৈন্য
নিহত হয়। প্রায় সাড়ে চার হাজার পর্তুগিজকে বন্দী করে আগ্রায় পাঠানো হয়। এই সময় আরও
কিছু পর্তুগিজ পথিমধ্যে নিহত হয়। ১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজদের ক্ষমাভিক্ষার
কারণে, হুগলিতে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়।
জুজার সিংহের দ্বিতীয় বিদ্রোহ
বুন্দেলা নেতা জুজার সিংহ দ্বিতীয়বার বিদ্রোহ করেন। ফলে শাহাজাহান পুনরায় জুজার
সিংহের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। এই যুদ্ধে শাহজাহান
তাঁর তৃতীয় পুত্র
আওরঙ্গজেবকে নিয়োগ
করেন। ১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩
ডিসেম্বর
আওরঙ্গজেব প্রথম
যুদ্ধ পরিচালনা করেন বুন্দেলখণ্ডে। এই যুদ্ধের মূল পরিকলপনাকারী ছিলেন সাহাজাহান।
আওরঙ্গজেব এই যুদ্ধে একটি বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন মাত্র। এই যুদ্ধে
জুজার সিংহ পরাজিত ও নিহত হন।
বিজাপুর, ও গোলকুণ্ডা অভিযান
শাহাজী নামক জনৈক ব্যক্তি, আহম্মদনগরের নিজামী বংশের একজন বালককে সুলতান ঘোষণা দিয়ে
মোগলদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান। এই সময় শাহাজী গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুরের সুলতানের সাথে
সখ্যতা গড়ে তোলেন। শাহাজাহান প্রথমে শাহাজীর পক্ষ ত্যাগ করে মোগলদের অধীনতা
স্বীকারের জন্য আদেশ করেন। গোলকুণ্ডার সুলতান বশ্যতা স্বীকার করলেও বিজাপুরের
সুলতান সম্রাটের আদেশ অগ্রাহ্য করেন। ফলে শাহজাহান বিজাপুর আক্রমণ করেন। পরে
বিজাপুরের সুলতান মোগলদের অধীনতা স্বীকার করে নেন। আহম্মদনগরের শাহজী শেষ পর্যন্ত
শাহজাহানের বশ্যতা স্বীকার করে নে। ১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান আহম্মদনগরকে বিজাপুর
ও গোলকুণ্ডার মধ্যে ভাগ করে দেন।
শাহজাহানের তৃতীয় পুত্র
আওরঙ্গজেবের ক্রম-উত্থান
১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শাহাজাহান তাঁর তৃতীয় পুত্র
আওরঙ্গজেবকে
দাক্ষিণাত্যের খান্দেশ, বেরার, তেলেঙ্গিনা ও দৌলতাবাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। ১৬৪৪
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত
আওরঙ্গজেব এই পদে
অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময়
আওরঙ্গজেব নাসিকের
নিকটবর্তী বাগ্লানার শাহকে পরাস্ত করে মোগল অধীকারে আনেন।
১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহানের
কন্যা জাহানার
দুর্ঘটনাক্রমে অগ্নিদগ্ধ হন। এই সময়
আওরঙ্গজেব আগ্রাতে আসেন। কিন্তু
আওরঙ্গজেবের ঔদ্ধত্যে
ক্ষুব্ধ হয়ে শাহজাহান তাঁকে বরখাস্ত করেন। ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শাহজাহান
আওরঙ্গজেবকে গুজরাটের প্রশাসকের
দায়িত্ব দেন। এরপর ১৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে গুজরাট থেকে বলখ অঞ্চলের প্রশাসক করে পাঠানো
হয়। এখানে অবস্থিত মোগল সৈন্যদের ভেঙে পড়া মনোবলকে চাঙ্গা করে
আওরঙ্গজেব, স্থানীয় জনগণ
এবং উজবেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধে উজবেকরা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ
করে। উজবেকদের নেতা আব্দুল আজিজ মোগলদের সাথে সন্ধি করে। এছাড়া তিনি
তুর্কেমেনিয়ানদের আক্রমণের মোকাবেলা করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কৌশলের
মাধ্যমে
সাফল্য লাভ করেন। এরপর
আওরঙ্গজেব মুলতান এবং সিন্ধু অঞ্চলের প্রশাসক হন।
১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে কান্দাহার পারশ্যের রাজা দখল করে নিয়েছিল। ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কান্দাহার পারশ্যরাজের অধীনেই ছিল। এই বৎসরে শাহজাহান কান্দাহার অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগে সন্ত্রস্ত হয়ে, পারশ্য-সম্রাটের কান্দাহার প্রশাসক আলীমর্দন খাঁ, পারশ্য-সম্রাটের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু পারশ্য-সম্রাট মনে করেছিলেন, আলীমর্দন খাঁ এইভাবে শক্তি বৃদ্ধি করে, তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। ফলে, পারশ্য-সম্রাট তাঁকে সাহায্যের পরিবর্তে বন্দী করার চেষ্টা করেন। ফলে আলীমর্দন খাঁর সাথে পারশ্য-সম্রাটের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। এই সুযোগে শাহাজাহান উৎকোচ দিয়ে আলীমর্দনকে স্বপক্ষে আনেন এবং কান্দাহার দখল করেন। এরপর আলীমর্দনকে কাশ্মীর এবং কাবুলের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়। এরপর পারশ্য-সম্রাট দ্বিতীয় শাহ্ আব্বাস কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য অভিযান চালান এবং কান্দাহার অবরুদ্ধ করেন। এই সময় মোগলদের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য না পাওয়ায়, প্রায় দুই মাস অবরুদ্ধ থাকার পর, মোগল বাহিনী আত্ম সমর্পণ করে। যতদূর জানা যায় ১৬৪৯ খ্রিষ্টাব্দে কান্দাহার পারশ্য-সম্রাটের অধীকারে চলে যায়। এরপর কান্দাহার উদ্ধারে শাহজাহান সাদুল্লাহ এবং আওরঙ্গজেবকে পাঠান। কিন্তু এই অভিযান ব্যর্থ হয়। এরপর ১৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে আওরঙ্গজেব দ্বিতীয়বার কান্দাহার অভিযান চালান। দুই মাস অবরুদ্ধ করে রাখার পর, পারশ্য-সৈন্যদের গোলান্দাজদের দক্ষতায়, মোগল বাহিনী ফিরে যায়। এরপর ১৬৫২ খ্রিষ্টাব্দে যুবরাজ দারার নেতৃত্বে কান্দাহার দখলের জন্য তৃতীয়বার অভিযান পরিচালিত হয়। কিন্তু কয়েক মাস কান্দাহার অবরোধের পর, মোগল বাহিনী ফিরে আসে। এরপর শাহজাহানের শাসনামলে কান্দাহার দখলের আর চেষ্টা করা হয় নাই।
১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বারের মতো
শাহাজাহান
আওরঙ্গজেবকে দাক্ষিণাত্যের শাসনভার দেন। ১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দের চুক্তি অনুসারে গোলকুণ্ডার সুলতান
বাৎসরিক কর পরিশোধ করতে অস্বীকার করায় এবং রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করায়,
আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে সাফল্য যখন প্রায় নিশ্চিত, সেই সময়
দারাশিকোর প্ররোচনায় শাহজাহান যুদ্ধবিরতীর আদেশ দেন।
১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে গোলকুণ্ডার
সাথে মোগলদের সন্ধি হয়। এই সময় গোলকুণ্ডার অংশবিশেষ মোগলদের অধীকারে আসে। এই সময়
বিজাপুরের সুলতান আদিল শাহ মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর নাবালক পুত্র দ্বিতীয় আলী
সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আওরঙ্গজেব এই সুযোগে বিজাপুর আক্রমণ করেন। ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের
এই যুদ্ধে তিনি বিদর, কল্যাণী দখল করেন। কিন্তু বিজাপুরের সুলতানের সন্ধির প্রস্তাবে
যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়।
শাহজাহানের পুত্রদের মধ্য সিংহাসনের লড়াই
১৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান গুরুতর
অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৬ই সেপ্টেম্বর এই সংবাদ রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় আগ্রাতে
ছিলেন যুবরাজ দারাশিকো। শাহজাহানের চার সন্তানের ভিতর সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতা
শুরু হয়। শাহজাহান সবার সম্মুখে দারাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করেন।
এই সংবাদ শোনার পর মুরাদ,
আওরঙ্গজেব এবং সুজা পৃথক পৃথকভাবে সিংহাসন দখলের জন্য
প্রস্তুতি নেন। দারা রাজধানী থেকে বাংলার শাসনকর্তা সুজা, গুজরাটের শাসনকর্তা মুরাদ
এবং দাক্ষিণাত্যের শাসক
আওরঙ্গজেবের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তিনি
ভলিকলে
আওরঙ্গজেবের বাসভবন বাজেয়াপ্ত করেন। অন্যদিকে বিজাপুরের সাথে
আওরঙ্গজেবের
যুদ্ধের সময়,
আওরঙ্গজেবের কর্মচারীদের রাজধানীতে ফিরে আসার আদেশ জারি করেন।
শাহজাহান সুস্থ হয়ে উঠার পরও তিনি দারার হাতে শাসনক্ষমতা রেখে দেন। ফলে বাকি তিন
যুবরাজ চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহী পড়েন। এই অবস্থার ভিতরে,
আওরঙ্গজেব তাঁর ছোট বোন
রওশনারার কাছ থেকে রাজধানীর সকল সংবাদই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি
সুজা এবং মুরাদের সাথে যোগাযোগ করে স্থির করে করেন যে, এই বিরোধের
সময় তিন ভাই একত্রে কাজ করবেন। ইতিমধ্যে সুজা নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা দিয়ে আগ্রার
পথে রওনা হন। অন্যদিকে মুরাদ নিজেকে গুজরাটের নবাব ঘোষণা করে অগ্রসর হন।
আওরঙ্গজেব
প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা না দিয়ে প্রতীক্ষার পথ বেছে নেন। সুজার সসৈন্যে অগ্রসর হওয়ার
সংবাদ শোনার পর
আওরঙ্গজেব দ্রুত নর্মদা নদী অতিক্রম করে উজ্জ্বয়িনীর কাছে মুরাদের
সাথে মিলিত হন। উভয়ই দারা এবং সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতীজ্ঞা করেন। জয়ের পর
দুই ভাই রাজ্য সমানভাবে ভাগ করে নেবেন এমন সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। দারা এই সংবাদ পেয়ে
তাঁর পুত্র সুলেমানকে সুজাকে প্রতিহত করার জন্য পাঠান। বারণসীর কাছে বাহাদুরপুর
নামক স্থানে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত
যুদ্ধে সুজা পরাজিত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান।
অন্যদিকে মুরাদ ও
আওরঙ্গজেবের বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য দারা−
কাশিম খাঁ এবং
যশোবন্ত সিংহকে পাঠান।
আওরঙ্গজেবকে দারার বাহিনী বাধা দেন উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ধর্মটি
নামক স্থানে। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে উভয়বাহিনীর মধ্য যুদ্ধ হয়। দারার
বাহিনীর কাশিমা খাঁ এবং যশোবন্ত সিংহের ভিতর মতানৈক্যের কারণে
আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এরপর
আওরঙ্গজেব ও মুরাদের বাহিনী আগ্রার পথে অগ্রসর হন। ১৬৫৮
খ্রিষ্টাব্দে জুন মাসের শুরুতেই উভয় বাহিনী আগ্রার আটমাইল দূরে সামুগড়ে উপস্থিত হন।
এই সময় দারা'র অধীনে প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য ছিল। এর সাথে রাজপুত যোদ্ধারা যোগ
দিয়েছিল। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন দারার পক্ষের খলিল-উল্লাহের বিশ্বাঘাতকতায়
আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই সময় দারা পালিয়ে পাঞ্জাবে চলে
যান। এরপর
আওরঙ্গজেব রাজধানী প্রবেশ করেন এবং শাহজাহানকে বন্দী করে
কারাগারে পাঠান। তিনি নিজেকে দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন।
বন্দী অবস্থায় তাঁর দেখাশোনা করতেন, তাঁর বড় মেয়ে জাহানারা। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি শাহজাহানকে বন্দী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যর পর তাজমহলের ভিতরে তাঁর স্ত্রী মমতাজ মহলের কবরের পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়।
শাহজাহানের স্ত্রীসমূহ
আকবরবাড়ি মহল
মমতাজ মহল
আন্দাহারি মহল
হাসিনা বেগম
মুতি বেগম
ফাতেহপুর মহল
সারহিন্দি বেগম
শ্রীমতি মনভবথি বাঈজি লাল
লীলাবতী বাঈজি লাল
শাহাজাহানের পুত্র-কন্যা
জাহানারা
দারাসিকো
শাহ সুজা
রওশানারা
মুরাদ
গওহর বেগম
সূত্র :
ভারতের ইতিহাস। অতুল চন্দ্র রায়, প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়
http://www.britannica.com/EBchecked/topic/537671/Shah-Jahan