আওরঙ্গজেব আলমগীর
ফার্সি নাম
اورنگ‌زیب
ভারতবর্ষের ষষ্ঠ মোগল সম্রাট। তাঁর পূর্ণ নাম আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর

১৬১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ নভেম্বর গুজরাটের দাহোদ-এ জন্মগ্রহণ করেন। এর পিতা ছিলেন পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহান মায়ের নাম মুমতাজ মহল। শাহজাহানের চার পুত্রের নাম দারা, সুজা, আওরঙ্গজেব ও মুরাদ।

১৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মে, এক সামরিক পাগলা হাতি তাঁকে আক্রমণ করে। তিনি সাহসিকতার সাথে দীর্ঘ গদা জাতীয় অস্ত্র দিয়ে হাতির শুঁড়ে আঘাত করে, নিজেকে রক্ষা করেন। এই ঘটনার পর সম্রাট শাহজাহান  তাঁকে বাহাদুর খেতাব দেন।

১৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর আওরঙ্গজেব প্রথম যুদ্ধ পরিচালনা করেন বুন্দেলখণ্ডে। এই যুদ্ধের মূল পরিকলপনাকারী ছিলেন সম্রাট শাহজাহান। আওরঙ্গজেব এই যুদ্ধে একটি বাহিনী পরিচালনা করেছিলেন মাত্র। এই যুদ্ধের প্রতিপক্ষ ছিলেন রাজপুত নেতা জুঝার সিং। জুঝার সিং মোগল বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলে, শাহজাহান তাঁকে জায়গির প্রদান করেছিলেন। কিন্তু পরে তিনি আবার বিদ্রোহ করলে, মোগলদের সাথে যুদ্ধে নিহত হন।

১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের খান্দেশ, বেরার, তেলেঙ্গিনা ও দৌলতাবাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। নাসিকের নিকটবর্তী বাগ্‌লানার শাহকে পরাস্ত করে মোগল অধীকারে আনেন। ১৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সাফাভী রাজকন্যা দিলরাস বানু বেগমকে (অন্য নাম রাবিয়া-উদ্‌-দুররানি) বিবাহ করেন।

১৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আওরঙ্গজেবের বোন জাহানার দুর্ঘটনাক্রমে অগ্নিদগ্ধ হন। এই সময় আওরঙ্গজেব আগ্রাতে আসেন। এই সময় তাঁর ঔদ্ধত্যে ক্ষুব্ধ হয়ে শাহজাহান তাঁকে বরখাস্ত করেন।

১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গুজরাটের প্রশাসকের দায়িত্ব পান। ১৬৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে গুজরাট থেকে বলখ অঞ্চলের প্রশাসক করে পাঠানো হয়। এখানে অবস্থিত মোগল সৈন্যদের ভেঙে পড়া মনোবলকে চাঙ্গা করে তিনি, স্থানীয় জনগণ এবং উজবেকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যুদ্ধে উজবেকরা শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। উজবেকদের নেতা আব্দুল আজিজ মোগলদের সাথে সন্ধি করে। এছাড়া তিনি তুর্কেমেনিয়ানদের আক্রমণের মোকাবেলা করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং কৌশলের মাধ্যমে সাফল্য লাভ করেন। এরপর তিনি মুলতান এবং সিন্ধু অঞ্চলের প্রশাসক হন।

১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয়বারের মতো দাক্ষিণাত্যের শাসনভার পান। ১৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দের চুক্তি অনুসারে গোলকুণ্ডার সুলতান বাৎসরিক কর পরিশোধ করতে অস্বীকার করায় এবং রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করায়, আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে সাফল্য যখন প্রায় নিশ্চিত, সেই সময় দারাশিকোর প্ররোচনায় শাহজাহান যুদ্ধবিরতীর আদেশ দেন। ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে গোলকুণ্ডার সাথে মোগলদের সন্ধি হয়। এই সময় গোলকুণ্ডার অংশবিশেষ মোগলদের অধীকারে আসে। এই সময় বিজাপুরের সুলতান  আদিল শাহ মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর নাবালক পুত্র দ্বিতীয় আলী সিংহাসনে আরোহণ করেন। আওরঙ্গজেব এই সুযোগে বিজাপুর আক্রমণ করেন। ১৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দের এই যুদ্ধে তিনি বিদর, কল্যাণী দখল করেন। কিন্তু বিজাপুরের সুলতানের সন্ধির প্রস্তাবে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়।

১৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৬ই সেপ্টেম্বর এই সংবাদ রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ে। এই সময় আওরঙ্গজেবের চার ভাইয়ের ভিতর সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়।  এই সময় আগ্রাতে ছিলেন যুবরাজ দারাশিকো। শাহজাহান সবার সম্মুখে দারাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করেন। এই সংবাদ শোনার পর মুরাদ, আওরঙ্গজেব এবং সুজা পৃথক পৃথকভাবে সিংহাসন দখলের জন্য প্রস্তুতি নেন। দারা রাজধানী থেকে বাংলার শাসনকর্তা সুজা, গুজরাটের শাসনকর্তা মুরাদ এবং দাক্ষিণাত্যের শাসক আওরঙ্গজেবের সাথে রাজধানীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। তিনি ভলিকলে আওরঙ্গজেবের বাসভবন বাজেয়াপ্ত করেন। অন্যদিকে বিজাপুরের সাথে আওরঙ্গজেবের যুদ্ধের সময়, আওরঙ্গজেবের কর্মচারীদের রাজধানীতে ফিরে আসার আদেশ জারি করেন। শাহজাহান সুস্থ হয়ে উঠার পরও তিনি দারার হাতে শাসনক্ষমতা রেখে দেন। ফলে বাকি তিন যুবরাজ চূড়ান্তভাবে বিদ্রোহী পড়েন। এই অবস্থার ভিতরে, আওরঙ্গজেব তাঁর ছোট বোন রওশনারার কাছ থেকে রাজধানীর সকল সংবাদই সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি সুজা এবং মুরাদের সাথে যোগাযোগ করে স্থির করে করেন যে, এই বিরোধের সময় তিন ভাই একত্রে কাজ করবেন। ইতিমধ্যে সুজা নিজেকে বাংলার নবাব ঘোষণা দিয়ে আগ্রার পথে রওনা হন। অন্যদিকে মুরাদ নিজেকে গুজরাটের নবাব ঘোষণা করে অগ্রসর হন। আওরঙ্গজেব প্রকাশ্যে কোনো ঘোষণা না দিয়ে প্রতীক্ষার পথ বেছে নেন। সুজার সসৈন্যে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ শোনার পর আওরঙ্গজেব দ্রুত নর্মদা নদী অতিক্রম করে উজ্জ্বয়িনীর কাছে মুরাদের সাথে মিলিত হন। উভয়ই দারা এবং সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রতীজ্ঞা করেন। জয়ের পর দুই ভাই রাজ্য সমানভাবে ভাগ করে নেবেন এমন সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। দারা এই সংবাদ পেয়ে তাঁর পুত্র সুলেমানকে সুজাকে প্রতিহত করার জন্য পাঠান। বারণসীর কাছে বাহাদুরপুর নামক স্থানে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত যুদ্ধে সুজা পরাজিত হয়ে বাংলাদেশে ফিরে যান।

অন্যদিকে মুরাদ ও আওরঙ্গজেবের বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য দারা
কাশিম খাঁ এবং যশোবন্ত সিংহকে পাঠান। আওরঙ্গজেবকে দারার বাহিনী বাধা দেন উজ্জয়িনীর নিকটবর্তী ধর্মটি নামক স্থানে। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে উভয়বাহিনীর মধ্য যুদ্ধ হয়। দারার বাহিনীর কাশিমা খাঁ এবং যশোবন্ত সিংহের ভিতর মতানৈক্যের কারণে আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এরপর আওরঙ্গজেব ও মুরাদের বাহিনী আগ্রার পথে অগ্রসর হন।  ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জুন মাসের শুরুতেই উভয় বাহিনী আগ্রার আটমাইল দূরে সামুগড়ে উপস্থিত হন। এই সময় দারা'র অধীনে প্রায় ৫০ হাজার সৈন্য ছিল। এর সাথে রাজপুত যোদ্ধারা যোগ দিয়েছিল। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জুন দারার পক্ষের খলিল-উল্লাহের বিশ্বাঘাতকতায় আওরঙ্গজেব যুদ্ধে জয়লাভ করেন। এই সময় দারা পালিয়ে পাঞ্জাবে চলে যান। এরপর আওরঙ্গজেব রাজধানী প্রবেশ করেন এবং শাহজাহানকে বন্দী করে কারাগারে পাঠান। তিনি নিজেকে দিল্লীর সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর তাঁর সহযোগী মুরাদকে কৌশলে বন্দী করে গোয়ালিয়র কারাগারে বন্দী করে রাখেন। ১৬৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর আওরঙ্গজেবের আদেশে তাঁকে হত্যা করা হয়।

আওরঙ্গজেব দারাকে ধরার জন্য অগ্রসর হলে, তিনি তাঁর পুত্র সুলেমানকে সাথে নিয়ে লাহোর থেকে মুলতানে পালিয়ে যান। পরে সেখান থেকে আবার গুজরাটে পালিয়ে যান। এই সময় যোধপুরের রাজা যশোবন্ত সিংহ দারাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। তারপরেও দারা দেওরাই গিরিবর্ত্মে আওরঙ্গজেবের সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং পরাজিত হয়ে আহমাদেবাদে পালিয়ে যান। এরপর কান্দারহার হয়ে পারস্যের পথে পালিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মালিক জিওয়ান খাঁ নামক এক আফগান সর্দারের ঘরে আশ্রয় নেন। উল্লেখ্য একসময় শাহাজাহান এই আফগান সর্দারকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সে সময় দারা তাঁকে রক্ষা করেছিলেন। ১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দে জিওয়ান খাঁ, দারার এই অসহায় অবস্থায়  দুই পুত্র ও দুই কন্যাসহ বন্দী করে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর হাতে তুলে দেন। শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় তাঁকে দিল্লীর রাজপথ দিয়ে লাঞ্ছিত করতে করতে দরবারে আনা হয়। এরপর ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ আগষ্ট তাঁকে হত্যা করা হয়। এই বৎসরে
আওঙ্গজেবের সম্রাট হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয়। এই অনুষ্ঠানে আলমগীর পাদশাহগাজী উপাধি ধারণ করেন।

এর ভিতরে আওরঙ্গজেব ১৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দাক্ষিণাত্যের সোলাপুর দখল করেন। এই সকল যুদ্ধের কারণে, আওরঙ্গজেব আর্থিক সমস্যায় পড়েন। এছাড়া এই যুদ্ধের পর নিহত সৈন্যদের স্থলে নতুন সৈন্য জোগার করতে ব্যর্থ হন।

আওরঙ্গজেব মূলত ছিলেন গোড়া সুন্নী সম্প্রদায়ের মুসলমান। তিনি মুসলমানদের অন্যান্য গোষ্ঠী এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি বৈরী ভাব বজায় রেখেছিলেন। ১৬৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিয়া সম্প্রদায়ের মোহরমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। তিনি সঙ্গীতের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ইসলামী ফতোয়া জারির মধ্য দিয়ে তিনি মুসলমানদের দাড়ির দৈর্ঘ্যের পরিমাপ করে দিয়েছিলেন এবং মুসলমানদের কারুকার্য  খচিত পোশাকের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন। ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর হিন্দুদের উপর জিজিয়া করা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব আবার তা চালু করেছিল। অনেক প্রদেশে হিন্দু উপসানালয় ধ্বংস করার আদেশ জারি করা হয়েছিল। ১৬৬৮ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু ধর্মমেলাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৬৭১ খ্রিষ্টাব্দ খালিশা অঞ্চলে বিভিন্ন পেশায় হিন্দুদের চাকরীতে নিয়োগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে সরকারী নিয়ন্ত্রণে হোলী বা দেয়ালির মতো উৎসব হতো। শিখদের ধর্মাচরণেও তিনি বাধা দিয়েছেন। শিখ ধর্মগুরু তেগ বাহাদুরকে তাঁর নির্দেশে হত্যা করা হয়েছিল। এই সব কারণে হিন্দু, শিখ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকেই তাঁর প্রতি রুষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। 

ভাতৃবিরোধের মধ্য দিয়ে আওরঙ্গজেব শাসন ক্ষমতা লাভ করেছিলেন। পরিবারের বাইরে ভারতবর্ষের ভিতর প্রথম উল্লেখযোগ্য বিদ্রোহ হলো
জাঠ বিদ্রোহ।

বিবাহ :

প্রথমা স্ত্রী : রাজপুরী জারাল রাজপুত রাজকন্যা । নাম নবাব বাই বেগম।
দ্বিতীয়া স্ত্রী : ইরানের সাফাভী রাজকন্যা। নাম দিলরাস বানু বেগম।

সন্তানাদি

মুহাম্মদ সুলতান। মাতা নবাব বাই বেগম
বাহাদুর শাহ প্রথম। মাতা নবাব বাই বেগম
আজম শাহ। মাতা দিলরাস বানু বেগম
সুলতান মুহাম্মদ আকবর। দিলরাস বানু বেগম
মুহাম্মদ কাম বক্স। মাতা আওরঙ্গবাদী
জেব-উন-নেসা। মাতা দিলরাস বানু
বদর-উন-নেসা। মাতা নবাব বাই বেগম