তাজমহল
প্রখ্যাত স্মৃতিসৌধ। স্থানাঙ্ক ২৭
.°উত্তর ৭৮.০° পশ্চিম । এটি ভারতের উত্তর প্রদেশের আগ্রা নগরীতে অবস্থিত।

ভারতবর্ষের পঞ্চম মোগল সম্রাট শাহজাহান এই স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন। ১৬৩১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী মমতাজ মহল (আরজুমান্দ বানু) চতুর্দশ সন্তান গওহর বেগমের প্রসবের সময় মৃত্যুবরণ করেন। এই স্ত্রীর মৃত্যুতে শাহজাহান প্রচণ্ড শোকাহত হন। এই স্ত্রীর স্মরণে তিনি একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এই স্মৃতিসৌধটি তাজমহল নামে খ্যাত। উল্লেখ্য তাজমহল তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল ১৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে, মূল সৌধের অংশ শেষ হয়েছিল ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে। আর পরিকল্পনা অনুসারে সম্পূর্ণ তাজমহল শেষ হয়েছিল ১৬৫৩ খ্রিষ্টাব্দে। 

তাজমহল তৈরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের গুণী প্রকৌশলী নিয়োগ করা হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রকৌশলীদের যে তালিকা পাওয়া যায়, তা হলো

শাহজাহান তাজমহলের জন্য যমুনা নদীর তীরে আগ্রা শহরের দক্ষিণে একটি জায়গা নির্বাচন করেন। এই জায়গাটির মালিক ছিল মহারাজা জয় শিং। শাহজাহান তাঁকে আগ্রা শহরের মাঝখানে একটি বিশাল প্রাসাদ দেওয়ার বদলে জমিটি অধিগ্রহণ করেন। এর ভিত্তি তৈরির জন্য প্রায় ৩ একর জায়গাকে খনন করে তাতে আলগা মাটি ফেলা হয়। সম্পূর্ণ এলাকাকে নদীর পাড় থেকে প্রায় ৫০ মিটার উঁচু করা সমান করা হয়। এরপর পুরো তাজমহলের জন্য ৫৫ মিটার লম্বা জায়গা তৈরি করা হয়। এর ভিতরে সমাধি স্থানের জন্য ১৮ মিটার ব্যাসের জায়গা নির্বাচন করে। এরপর ২৪ মিটার উচ্চ সমাধিভবন তৈরি করা হয়।

পরিকল্পনা অনুসারে, তাজমহলের সামনের চত্বরে একটি বড় চারবাগ (মুঘল বাগান পূর্বে চার অংশে বিভক্ত থাকতো) করা হয়েছিল। ৩০০ মিটার X ৩০০ মিটার জায়গার বাগানের প্রতি চতুর্থাংশ উচু পথ ব্যবহার করে ভাগগুলোকে ১৬টি ফুলের বাগানে ভাগ করা হয়েছিল। এর ভিতর মাজার অংশ এবং দরজার মাঝামাঝি আংশে এবং বাগানের মধ্যখানে একটি উঁচু মার্বেল পাথরের পানির চৌবাচ্চা বসানো হয়েছিল। এছাড়া তাজমহলের প্রতিফলন দেখার জন্য উত্তর-দক্ষিণে একটি সরল রৈখিক চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়েছিল। তাজমহলকে অধিকতর সৌন্দর্যমণ্ডিত করার জন্য বাগানের নকশায় যমুনা নদীটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

দেওয়ালের ভিতরের একটি মসজিদ

তাজমহল এর চত্বরটি বেলে পাথরের দুর্গের মত দেয়াল দিয়ে তিন দিক থেকে বেষ্টিত। নদীর দিকের পাশটিতে স্বল্প উচ্চাতার দেয়াল আছে। এই দেয়াল বেষ্টনির বাইরে আরও সমাধি রয়েছে যার মধ্যে শাহজাহানের অন্য স্ত্রীদের সমাধি এবং মমতাজ মহলের প্রিয় পরিচারিকাদের একটি বড় সমাধি রয়েছে। এ স্থাপত্যসমূহ প্রধানতঃ লাল বেলে পাথর দ্বারা তৈরি, দেখতে সেসময়কার ছোট আকারের মুঘল সাধারণ সমাধির মতন। দেওয়ালের ভিতরের দিকটা হিন্দু মন্দিরে আদলে তৈরি। দেয়ালগুলোয় বিচিত্র গম্বুজাকৃতির ইমারত দিয়ে সংযুক্ত। এগুলোকে পর্যবেক্ষণ চৌকি হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে এই অংশ জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তাজমহলে ঢোকার প্রধান ফটক মার্বেল পাথরে তৈরি। এর উপরে রয়েছে অনেকগুলো ছোটো গম্বুজ। দরজাটির নকশা ও ধরন মুঘল সম্রাটদের স্থাপত্যরীতির। এর খিলানসমূহের আকৃতি সমাধির খিলানসমূহের অনুরূপ।  ছাদে বেলে পাথরের উপর সুন্দর সুন্দর জ্যামিতিক নকশা আছে। এর ভিতরে পূর্ব ও পশ্চিম বরাবর দুটো মসজিদ আছে। মুঘল আমলে অনেক সময় পুরুষ মেহমানদের থাকার জন্য এই ইমারত দুটি ব্যবহৃত হত। এই মসজিদের মেঝেতে ৫৬৯ জন্য মুসল্লি নামাজ পড়ার জন্য কাল পাথর দিয়ে দাগ কাটা আছে। মসজিদের দেওয়াল লাল রঙের।

তাজমহলের প্রধান ফটক

মূল সমাধির উপরের মার্বেল পাথরের বিশাল গম্বুজ রয়েছে। এর আকার প্রায় প্রায় ৩৫ মিটার। গম্বুজটি একটি ৭ মিটার উচ্চতার সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম এর উপরে বসানো। এর আকৃতির কারণে, এই গম্বুজকে কখনো পেয়াজ গম্বুজ অথবা পেয়ারা গম্বুজ বলেও ডাকা হয়। গম্বুজের উপরের দিক সাজানো হয়েছে একটি পদ্মফুল দিয়ে। বড় গম্বুজের উপর মুকুটের মত একটি পুরনো মোচাকার চূড়া রয়েছে। কথিত আছে চূড়াটি ১৮০০ শতকের আগে স্বর্ণের নির্মিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এটি ব্রোঞ্জ দিয়ে তৈরি। এই চূড়াটিতে পারস্যদেশীয় এবং হিন্দু স্থাপত্যের সংমিশ্রণে সৃষ্ট। চূড়ার উপরের অংশে আছে ইসলামিক উপাদান হিসেবে রয়েছেএকটি চাঁদ। এর সাথে একটি শিং যুক্ত আছে। উভয় মিলে হিন্দু দেবতা শিব-এর ত্রিশূলের মতো। বড় গম্বুজটির চার কোণায় আরও চারটি ছোট গম্বুজ রয়েছে। ছোট গম্বুজগুলোও দেখতে বড় গম্বুজটির মতই। এদের স্তম্ভগুলো সমাধির ভিত্তি থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে। ছোট গম্বুজগুলোতেও কাসা বা তামার পুরনো দণ্ড আছে।

তাজমহল তৈরির জন্য নানা দেশ থেকে নানা ধরনের উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর ভিতরে ছিল মাখরান নামক আলো-প্রবাহী অস্বচ্ছ সাদা মার্বেল পাথর। এই পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে। পাঞ্জাব থেকে আনা হয়েছিল লাল, হলুদ বা বাদামী রঙের মধ্যম মানের পাথর। চীন থেকে আনা হয়েছিল ইয়াশ্‌ম্‌ নামক কঠিন, সাদা, সবুজ পাথর এবং স্ফটিক টুকরা, তিব্বত থেকে সবুজ-নীলাভ (ফিরোজা) রঙের বৈদূর্য রত্ন এবং আফগানিস্তান থেকে নীলকান্তমণি আনা হয়েছিল। এছাড়া নীলমণি (উজ্জ্বল নীল রত্ন) আনা হয়েছিল শ্রীলঙ্কা থেকে। নির্মাণ কাজের সময় এসকল সামগ্রী বহনের জন্য ১,০০০ এরও বেশি হাতি ব্যবহার করা হয়েছিল। আর ২০,০০০ শ্রমিক এই নির্মাণ কাজে অংশ নিয়েছিল।

মূল সমাধিকক্ষের ভিতরে রয়েছে শাহজাহান আর মমতাজ মহলের কবর। শাহজাহানের কবরটির উপরের আবরক-বাক্সটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চাতায় অপেক্ষাকৃত বড়।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিপ্লবের সময় ইংরেজ সৈন্যরা তাজমহলের বিকৃতি সাধন করে। এই সময় সরকারী কর্মচারীরা বাটালি দিয়ে তাজমহলের দেয়াল থেকে মূল্যবান পাথর, বিশেষ করে দামী নীলকান্তমণি খুলে নেয়। ১৯ শতকের শেষ দিকে লর্ড কার্জন তাজমহল পুণঃনির্মাণের একটি বড় প্রকল্প হাতে নেন। প্রকল্পের কাজ ১৯০৮ সালে শেষ হয়। ১৯৪২ সালে যখন জার্মান বিমান বাহিনী এবং পরে জাপানি বিমান বাহিনী দ্বারা আকাশপথে হামলার আশঙ্কায়, তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাজমহল রক্ষার জন্য এর উপর একটি ভারা তৈরি করেছিল। ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের সময়, বিমান চালকদের দৃষ্টিভ্রম ঘটানোর জন্য তাজমহলকে ভারা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।

তাজমহল সম্প্রতি যে হুমকির মুখে পড়েছে তা হল যমুনা নদীর তীরের পরিবেশ দূষণ। সাথে আছে মাথুরাতে তেল পরিশোধনাগারের কারণে সৃষ্ট এসিড বৃষ্টি।
১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস। অতুল চন্দ্র রায়, প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়
http://www.britannica.com/EBchecked/topic/537671/Shah-Jahan