আকবর, সম্রাট
১৫৪২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই অক্টোবর অমরকোটে জন্মগ্রহণ করেন। ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ-এর কাছে হুমায়ুন-এর পরাজয়ের পর, হুমায়ুনআশ্রয়ে জন্য নানা স্থান ঘুরে অমরকোটে এলে, সেখানে আকবরের জন্ম হয়। কথিত আছে পারশ্যের পথে হুমায়ুন পলায়নের সময় জানতে পারেন যে, তাঁর ভাই আশকরী পথে আক্রমণ করতে পারেন। তাই তিনি আকবর এবং তাঁর মা হামিদা বানুকে অমরকোটে রেখে একাই পারশ্যের পথে চলে যান। কিন্তু আশকরী এঁদের সন্ধান পাওয়ার পর সযত্নে আশ্রয় দেন। ১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন কান্দাহার এবং কাবুল উদ্ধার করার পর, তিনি পরিবার পরিজনকে উদ্ধার করেন। ১৫৫১ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন-এর অপর ভাই হিন্দোলের মৃত্যুর পর, আকবরবকে আনুষ্ঠানিকভাবে গজনীর শাসনকর্তা করা হয়। ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন দিল্লীর সিংহাসন দখল করার পর, আকবরকে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা করা হয়। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হুমায়ুন-এর মৃত্যুর পর, আকবর সিংহাসনে বসেন। এই সময় আকবরের অভিভাবক হিসেবে বৈরাম খান তাঁর অভিভাবক ছিলেন।
আকবরকে দিল্লীর সিংহাসন থেকে অপসারিত করার জন্য, মহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু বিশাল সেনাদল নিয়ে আগ্রা অভিমুখে রওনা দেন এবং সহজেই আগ্রা দখল করেন। এরপর তিনি দিল্লী দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে, দিল্লীর শাসনকর্তা তার্দিবেগ তাঁকে বাধা দেন। কিন্তু তিনি পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন। ফলে দিল্লী হিমুর অধিকারে আসে। তিনি বিক্রমাদিত্য নাম ধারণ করে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিমুকে শায়েস্তা করার জন্য, বৈরাম খান দিল্লীর পথে অগ্রসর হন। পাণিপথে উভয়ে মিলিত হন। ইতিহাসে এই যুদ্ধকে পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে হিমুর হস্তিবাহিনী বৈরাম খানের বাহিনীকে প্রায় তছনছ করে ফেলে। মোগল বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কিন্তু চোখে তীরবিদ্ধ হিমু সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে, নেতৃত্বের অভাবে হিমুর বাহিনী অসহায় হয়ে পড়ে। এই সময় বৈরাম খান সুযোগ বুঝে আক্রমণ করে হিমুকে বন্দী করেন। এই সময়, বৈরাম খান প্রায় ২৫০০ হাতি সহ বিপুল পরিমাণ যুদ্ধোপকরণ অধিকার করতে সক্ষম হন। এরপর বৈরাম খান আহত হিমুকে হত্যা করে, দিল্লীর রাজপথে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে রাখে।
শেরশাহের বংশধরদের একজন শাসক আহমদ শাহ সুর, পাঞ্জাবে সিকন্দর শাহ নাম ধরণ করে রাজত্ব করতেন। পাণিপথের যুদ্ধের আগেই উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দিকে সিকন্দর সুরের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠান। সে সময় সিকন্দর শাহ পালিয়ে সিওয়ালিক পর্বতে আশ্রয় নেন। পাণিপথের যুদ্ধে জয়লাভের পর, বৈরাম খান পুনরায় তাঁর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী পাঠান। এই সময় সিকন্দর শাহ বশ্যতা স্বীকার করে একটি জায়গির লাভ করেন।
বৈরাম খানের শত্রুদের প্ররোচনায়, ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে আকবর তাঁকে পদচ্যুত করেন এবং নিজের হাতে শাসনভার তুলে নেন। বৈরাম খানকে মক্কা যাওয়ার সুযোগ দেন। কিন্তু পথিমধ্যে জনৈক আফগান তাঁকে হত্যা করেন। ১৫৬১ খ্রিষ্টাব্দে আফগান সর্দার বাজবাহাদুরকে দমন করার জন্য আদম খাঁকে পাঠান। আদম খাঁ বাজবাহাদুরকে পরাজিত করে, আকবরকে অবজ্ঞা করা শুরু করেন। ফলে আকবর নিজেই আদম খাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাঁকে দমন করেন। এরপর তিনি পীর মহম্মদকে মালবের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। প্রশাসক হিসেবেপীর মহম্মদ অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন। তাই তাঁকে অচিরেই পরাজিত করে রাজবাহাদুর মালব দখল করেন।
এরপর ভারতে আধিপত্য
বিস্তারের ক্ষেত্রে রাজপুতদের সহাযোগিতা দরকার, এই বিবেচনায় তিনি রাজুতদের সাথে
আত্মীয়তা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। ১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে জয়পুরের রাজপুত নৃপতি বিহারীমলের
কন্যাকে বিবাহ করেন।
১৫৬২ খ্রিষ্টাব্দে আইন করে হিন্দু যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানোর আইন বন্ধ করেন।
১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দুদের উপর থেকে তীর্থকর তুলে নেন।
যোধা বাঈ |
১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে আকবর
মধ্য-প্রদেশের গণ্ডোয়ানা রাজ্য দখলের জন্য আসফ খাঁকে পাঠান। এই সময় গণ্ডোয়ানায় রানী
দুর্গাবতী তাঁর নাবলক পুত্র বীরনারায়ণের অভিভাবকরূপে রাজত্ব করতেন। এই যুদ্ধে
পরাজয়ের পর রানী দুর্গাবতী আত্মহত্যা করেন। ফলে এই রাজ্য আকবরের অধিকারে আসে।
এই বৎসরেই
মালবের বিদ্রোহী শাসনকর্তা আব্দুল্লাহ খাঁ উজবেকে দমন করার জন্য আকবর মালব-অভিযানে
বের হন। পথে খান্দেশ রাজ্যের শাসক মীরন মুবারকের সাথে তাঁর সরাসরি যোগাযোগ হয়। তিনি
মীরন মুবারকের কন্যাকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। পরে এই বিবাহ সম্পন্ন হয়।
এই বৎসরে (১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি হিন্দুদের উপর থেকে
জিজিয়াকর তুলে নেন।
আকবরের আমলে প্রচলিত মুদ্রা
১৫৬৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মেবারের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করেন। মেবারের রাজা রাণা উদয়
সিংহ আকবরকে ঘৃণার চোখে দেখতেন এবং তিনি মালবের রাজা বাজবাহাদুরকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
তাছাড়া গুজরাটে আক্রমণ পরিচালনার জন্য চিতোর দখল করাটা জরুরি ছিল। আক্রমণের শুরুতেই
উদয় সিংহ পালিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় নেন। কিন্তু জয়মল এবং পত্ত নামক দুই জন
প্রায় চার মাস ব্যাপী মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে এই সেনাপতিদ্বয় নিহত
হলে, দুর্গের ভিতরের রমণীরা অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করেন। ১৫৬৮ খ্রিষ্টাব্দে
চিতোর আকবরের দখলে আসে।আসফ খাঁকে মেবারের শাসনকর্তা নিয়োগ করা হয়।
১৫৬৯ খ্রিষ্টাব্দে আকবর
রথোম্ভর রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধে রাজপুত রাজা সারজন্হারা পরাজিত হয়ে সন্ধি
প্রার্থনা করেন। এবং তাঁর দুই পুত্র ভোজ ও দুদাকে মোগল দরবারে পাঠান। সারজন্হারাকে
পরে ভবারানসী ও চুনারের জায়গির করা হয়। এরপর কালিঞ্জর দখলের জন্য আকবর সৈন্য পাঠান।
কালিঞ্জরের রাজা বিনা বাধায় আত্ম সমর্পণ করেন। পরে কালিঞ্জরের রাজাকে এলাহাবাদের
কাছে জায়গির দেওয়া হয় এবং কালিঞ্জরের শাসনভার দেওয়া হয় সেনাপতি মাজনুর খাঁর হাতে।
১৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিকানীর রাজকন্যাকে বিবাহ করেন।
এরপর আকবর গুজরাটের দিকে দৃষ্টি
দেন। সে সময়ে গুজরাটের সুলতান ছিলেন তৃতীয় মুজফফর খাঁ। আকবরের বিদ্রোহী আত্মীয় সজন
তখন গুজরাটে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা নানাভাবে গুজরাটে অশান্তির সৃষ্টি করছিল।
গুজরাটের শান্তির জন্য মুজফফর খাঁ'র
মন্ত্রী ইমদাদ খাঁ আকবরের
সাহায্য কামনা করেন। ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে আকবর এই আবেদনে সাড়া দিয়ে গুজরাটে আক্রমণ
চালান। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মুজফফর খাঁ আত্মগোপন করেন। ১৬ই নভেম্বর মুজফফর খাঁ
বন্দী হন। ১৭ই নভেম্বর ইমদাদ খাঁ আকবরের হাতে নগরের চাবি তুলে দেন। আকবর
ইমদাদ খাঁর হাতে গুজরাটের একটি অংশের শাসনভার তুলে দেন। অপর অংশের শাসন ভার দেন
মীর্জা আজিজ কোকার হাতে। এরপর আকবর ক্যাম্বে গমন করেন। সেখানে তুর্কি, সিরিয়, ইরানি
ও পর্তুগিজ বণিকরা তাঁর সাথে দেখা করেন। সেখানে বণিকদের সবরকম সাহায্য করার
প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি সুরাট যান। সেখানে হুমায়ুনের এক বিশ্বস্ত অনুচর হামজাবান
স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। আকবর ১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সুরাট অবরোধ করেন। হামজাবান
আকবরকে বাধা দেওয়ার জন্য পর্তুগিজদের কাছ থেকে কামান সংগ্রহ করেন। আকবরের তীব্র
আক্রমণে হামজাবান এবং পর্তুগিজ গোলান্দাজ বাহিনী পরাজিত হয়। মোগল সৈন্যরা
হামজাবানকে বন্দী করে। অন্যদিকে পর্তুগিজরা প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে আকবরের কাছে
আত্মসমর্পণ করে। আকবর তাঁদের ক্ষমা করে দেন। কারণ ভারতের পশ্চিম উপকূলে পর্তুগিজদের
আধিপত্য ছিল। পর্তুগিজরা ভারত থেকে যে সকল মুসলমান হজ করার জন্য মক্কায় যেতেন
তাঁদের উপর অত্যাচার করতো। আকবর চুক্তির দ্বারা তাঁদের চলাচলে পর্তুগিজরা যাতে
বিঘ্ন না ঘটায় তার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। এরপর কুলিজ খাঁকে সুরাট দুর্গের অধিপতি
করেন। খান-ই আজম-কে গুজরাটের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেন। আর মুজফফর খাঁকে মালবের
শানকর্তা নিয়োগ করেন।
১৫৭৩ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে আকবর ফতেপুর সিক্রিতে চলে আসেন।
এই বছরে তিনি উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী এবং গুণী ব্যক্তিদের জন্য মন্সবদারী প্রথা চালু
করেন।
১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আকবর
ভাকার দুর্গ দখল করেন। এর মাধ্যমে তিনি সিন্ধুর বিশাল অংশ দখলে আনতে সক্ষম হন। উদয় সিংহের মৃত্যুর পর, তাঁর পুত্র রাণা প্রতাপ সিংহ পুনরায় মোগলদের বিরুদ্ধে আক্রমণের
প্রস্তুতি নেন। আকবর মানসিংহ এবং আসফ খাঁর অধীনে একটি বিশাল সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। ১৫৭৬
খ্রিষ্টাব্দে হলদিঘাটে উভয় বাহিনী মুখোমুখী হয়। এই যুদ্ধে প্রতাপ সিংহ পরাজিত হয়ে
পার্বত্য অঞ্চলে আত্মগোপন করেন।
মোগল শাসনাধীনে থাকা
অবস্থায় বাংলাদেশে আফগান বংশোদ্ভূত
কররানী রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয় ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে। এই রাজবংশের
সুলতান সুলেমান আকবরের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ফলে বাংলা তখন ছিল
মোগলদের করদ রাজ্য। সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দাউদ বাংলার স্বাধীন সুলতান
হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। আকবর দাউদকে দমন করার জন্য, সেনাপতি
টোডরমল
এবং মুনিম খাঁকে পাঠান।
মুনিম খান ২০,০০০ সৈন্য নিয়ে বাংলার দিকে অগ্রসর হন এবং বিনা বাধায় সুরজগড়, মুঙ্গের, ভাগলপুর ও কহলগাঁও অধিকার করেন।
এরপর তিনি তেলিয়াগড়ি গিরিপথে এসে পৌঁছালে,
দাউদ প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করেন। মুনিম খান স্থানীয় জমিদারদের সাহায্যে রাজমহল পবর্তমালার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়।
এরপর ১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন বাংলার রাজধানী তান্ডায় প্রবেশ করেন। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩ মার্চ সুবর্ণরেখা নদীর নিকট সংঘটিত তুকারয়ের যুদ্ধে দাউদ পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান।
এরপর রাজা
টোডরমলের
ভিন্ন পথে ভদ্রকে উপস্থিত হন। দাউদ আত্মরক্ষার জন্য কটক দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। রাজা
টোডরমলের কটক অবরোধ
করলে দাউদ নিরুপায় হয়ে সন্ধির প্রস্তাব দেন। ১২ এপ্রিল তিনি মুনিম খানের কাছে
আত্মসমর্পণ করেন। উভয়পক্ষে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয়। মুনিম খান রাজধানী তান্ডা থেকে
গৌড়ে সরিয়ে নেন।
১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ অক্টোবর মুনিম খান প্লেগ রোগে মারা যান।
এরপর সম্রাট
হোসেনকুলী বেগকে
সুবেদারে হিসেবে নিয়োগ দেন। ইতিমধ্যে দাউদ খান পুনরায় বিদ্রোহ ঘোষণা করলে-
হোসেনকুলী বেগ
এই বিদ্রোহী দমনে যত্নবাম হন।
দীর্ঘদিন যুদ্ধ করার
পরে ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে তিনি আফগানদের পরাজিত করেন এবং বাংলার আফগান
কররানী রাজবংশ সুলতান দাউদ খান কররানীকে বন্দী করে শিরশ্ছেদ করেন।
এরপর তিনি আরও অগ্রসর হয়ে দাউদ খানের অবশিষ্ট অনুসারীদের পরাজিত করেন এবং সাতগাঁও মুগল সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।
১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে আকবর খান্দেশ রাজ্য
আক্রমণ করেন। সে সময়ে খান্দেশের শাসক ছিলেন রাজা আলি খাঁ। মোগল বাহিনী কর্তৃক
অবরুদ্ধ হয়ে, তিনি প্রচুর অর্থ প্রদান করে মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন। এবং
খান্দেশ মোগলদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়।
এরপর আকবর কাবুলের দিকে নজর দেন। ১৫৮১
খ্রিষ্টাব্দে তিনি কাবুলে সামরিক অভিযান চালান এবং বিনা বাধায় কাবুল দখল করেন।
কিন্তু মীর্জা হাকিমের আকবরের অধীনতা অস্বীকার করলে, আকবর মীর্জা হাকিমের বোনের
হাতে কাবুলের শাসনভার দিয়ে দিল্লীতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি দীর্ঘদিনের চিন্তা প্রসূত
দীন-ই-ইলাহী নামে একটি ধর্মমত প্রচারের উদ্যোগ নেন।
১৫৮২ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাটের নির্দেশে টোডরমল রাজস্বনীতি প্রণয়ন
করেন। এই রীতির মূল বিষয় ছিল-
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে
বিহারীমলের পুত্র ভগবান দাসের কন্যার সাথে আপন পুত্র জাহাঙ্গীরের বিবাহ দেন।
দীন-ই-ইলাহি ও ইলাহি সন
এই সময় মোগলদের শত্রু উজবেক নেতা আব্দুল্লাহ
খাঁ মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের উদ্যোগ নেন। ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে আব্দুল্লাহ
খাঁ তৈমুর বংশীয়দের শাসনাধীন বাদাখশান দখল করেন। এই সময় ওই অঞ্চলের শাসক
এবং মীর্জা হাকিম আকবরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। আকবর
এঁদের সাহায্য করার জন্য সিন্ধুনদের উপকুলে পৌঁছান। এই সময় মীর্জা হাকিম মৃত্যুবরণ
করেন। ফলে কাবুল ও বেলুচিস্তানে আকবর একই সময়ে দুটি বাহিনী পাঠান।
১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে
বৎসরে আকবর একটি সমন্বিত নতুন ধর্ম প্রচারের উদ্যোগ নেন। এই ধর্মের নাম
দেওয়া হয়েছিল দীন-ই-ইলাহি বা তৌহিদ-ই-ইলাহি। এই ধর্মের আদর্শে তিনি মুদ্রা থেকে
কালিমা তুলে দেন। মুদ্রা ও শিলালিপি থেকে আরবি ভাষা তুলে দিয়ে ফারসি ভাষার
প্রবর্তন করেন। একই সাথে তিনি আরব দেশীয় চান্দ্র মাসের পরিবর্তে পারস্যের সৌর
বৎসরে প্রচলন করেন। প্রাথমিকভাবে এই বৎসর-গণন পদ্ধতির নাম দেন তারিখ-ই-ইলাহি বা
সন ই ইলাহি। এই ইলাহি সনকে ভারতবর্ষের আদর্শে নতুন করে সাজানোর জন্য আকবর ৯৯২
হিজরি সনে, তাঁর রাজসভার রাজ জ্যোতিষী আমির ফতেউল্লাহ শিরাজীর উপর দায়িত্ব
অর্পণ করেন। আকবর ৯৬৩ হিজরি সনের রবিউল আখির মাসের ২ তারিখে [১৪ ফেব্রুয়ারি,
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ] সিংহাসনে আরোহণ করেন। হিজরি সনের মর্যাদা দেখিয়ে, ৯৬৩
সংখ্যাকে ইলাহি সনের প্রথম বৎসরের মর্যাদা দেন। এর পরবর্তী বৎসর থেকে সৌরবৎসর
হিসাবে গণনা শুরু করেন। এই সূত্রে হিজরি চান্দ্র-মাস তুলে দিয়ে সৌরমাস গণনা
শুরু করেন। আকবর এই নতুন বর্ষ-গণন পদ্ধতি প্রচলনের আদেশ জারি করেন ৯৯২ সালের ৮ই
রবিউল তারিখ। খ্রিষ্টাব্দের বিচারে এই তারিখ ছিল ১০ মার্চ ১৫৮৫। যদিও আকবরের
সিংহাসন আরোহণের দিন থেকে ইলাহি বর্ষের শুরু হওয়ার আদেশ জারি হয়েছিল, কিন্তু
কার্যত দেখা গেল, পারস্যের পঞ্জিকা অনুসারে বৎসর শেষ হতে ২৫ দিন বাকি রয়ে যায়।
তাই ইলাহি সন চালু হলো– আকবরের সিংহাসন আরোহণের ২৫ দিন
পর। এই নির্দেশানুসরে বিষয়টি কার্যকরী হয়– ২৮ রবিউল আখের ৯৬৩ হিজরী, ১১ মার্চ,
১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ।
ইলাহি সনের প্রথম দিনটিকে প্রাচীন পারস্যের রীতি অনুসারে নওরোজ (নতুন দিন)
হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। এছাড়া ইলাহি সনের মাসগুলোর নাম গ্রহণ করা হয়েছিল প্রাচীন
পারস্যের পঞ্জিকায় প্রাপ্ত নামগুলো থেকে। পারস্যের এই মাসগুলোর নাম ছিল-
ফারওয়ারদীন (فروردین), আর্দিবিহশ্ত (اردیبهشت), খুরদাদ (خرداد), তীর (تیر),
মুরদাদ (مرداد), শাহরীয়ার (شهریور), মেহ্র (مهر), আবান (آبان), আজার (آذر), দে
(دی), বাহমান (بهمن) এবং ইসপন্দর (اسفند)। এই নামগুলো বঙ্গাব্দ কেন কোনো
ভারতীয় সংবৎ-এর সাথে যুক্ত হয় নি।
সম্রাট আকবর পারস্যের সৌরবৎসরের অনুকরণে
যে ইলাহি সন প্রবর্তন করেছিলেন, তা ছিল সর্বভারতীয় রাষ্ট্রীয় সন। কিন্তু এই সন
ধরে একই সময়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজস্ব আদায় করাটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
কারণ রাজস্ব আদায়ের জন্য, সম্রাটকে কৃষকের ফসল ঘরে উঠার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা
করতে হতো। ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে একই সময় সকল স্থানের কৃষকরা ফসল কাটতো না।
সেই কারণে ফসল কাটার সময়কে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথক পৃথক সনের
প্রচলন করা হয়েছিল। এই বিচারে ফসলি সন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ফসল-নির্ভর আঞ্চলিক বর্ষ
গণন পদ্ধতি। এই কারণে তৎকালীন বঙ্গদেশে ফসলি সনের শুরু হতে অগ্রহায়ণ মাস থেকে।
পক্ষান্তরে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে ফসলি সন শুরু হতো আষাঢ় মাস থেকে। তবে এই সকল
ফসলি সনগুলো ছিল সৌর-বৎসর ভিত্তিক ইলাহি সন।
১৫৮৬
খ্রিষ্টাব্দের দিকে কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এরই ভিতর ১৫৮৫ খ্রিষ্টাব্দে
আহম্মদ নগরের মীর মুর্তজা এবং অন্যান্যা অভিজাত ব্যাক্তিবর্গ, প্রধানমন্ত্রী সালাবৎ
খাঁ'র বিরুদ্ধে মোগল দরবারে আর্জি পেশ করেন, আক্রমণ করার অনুরোধ করেন। আকবর মালবের
শাসনকর্তা খান-ই-আজম-কে আহম্মদনগর দখল করে, সেখানে বিদ্রোহী নেতাদের প্রতিষ্ঠিঁত
করার আদেশ দেন্। খান্দেশের শাসক রাজা আলী খাঁ মোগলদের অনুকূলে থাকলে, আহম্মদনগর
আক্রমণের ক্ষেত্রে তিনি মোগলদের বিরোধিতা করেন। এই কারণে তাঁর রাজ্যের ভিতর দিয়ে
মোগল সৈন্যের চলাচলে বাধা দেন। ফলে ১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সৈন্য প্রত্যাহার করা
হয়।
১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আহম্মদনগরের শাসক মুর্তজা নিজাম শাহের বিরুদ্ধে
কয়েকজন অভিজাত বিদ্রোহীর হয়ে নিজাম শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে−
নিজাম শাহের ভাই বারহানউদ্দিনকে সিংহাসনে বসানো ষড়যন্ত্র করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত
এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে যায়। বারহানউদ্দিন পালিয়ে মোগল দরবারে আশ্রয় নেন। আকবর তাঁর
প্রতি বিশেষ সদয় ব্যবহার করেন। এরপর আকবর বারহানউদ্দিনকে অধিনায়ক করে একটি
শক্তিশালী সেনাদল পাঠান। একই সাথে তিনি মালবের শাসনকর্তা খান-ই আযম এবং খান্দেশের
শাসক রাজা আলী খাঁক নির্দেশ দেন, যেনো তাঁরা বারহানউদ্দিনকে সাহায্য করেন। শেষ
পর্যন্ত বারহানউদ্দিন আহমমদনগর দখল করতে সক্ষম হন। পরে তিনি মোগলদের প্রতি আনুগত্য
ত্যাগ করে নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন।
১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের আদেশে মুলতানের
মোগল শাসনকর্তা আব্দুর রহমান নিম্ন সিন্ধু এলাকা আট্টা দখল করার জন্য অভিযান চালান।
আট্টার অধিপতি মীর্জা জানিবেগ আত্মসমর্পণ করলে, সম্পূর্ণ সিন্ধু অঞ্চল
মোগল অধিকারে আসে।
১৫৯১ খ্রিষ্টাব্দে আকবর খান্দেশ, আহম্মদনগর,
গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুরের শাসকদের কাছে কর দাবি করেন। প্রথমে খান্দেশের সুলতান রাজা
আলী আকবরের এই দাবি মেনে নেন। কিন্তু অন্য তিন সুলতান তা অস্বীকার করেন। আকবর আপাতত
দক্ষিণের এই তিন সুলতানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে, বেলুচিস্তানের
দিকে নজর দেন। তিনি বেলুচিস্তানের আফগান শাসকরা
আকবরের বশ্যতা স্বীকার করতে রাজি না হলে, ১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের আদেশে মীর মাসুম
বেলুচিস্তানের সিরি দুর্গ আক্রমণ করে দখল করে নেন। এর দ্বারা সমগ্র বেলুচিস্তান
মোগলদের অধিকারে আসে। এই সময় কান্দাহার শাসন করতে পারশ্যের শাসনকর্তা হুসেন মীর্জা।
তাঁর সাথে পারশ্যের সম্রাটের সুসম্পর্ক ছিল না। এই সুযোগে আকবর কান্দাহার
আক্রমণ করেন। এই অবস্থায় পারশ্যের শাসনকর্তা কান্দাহার
দুর্গ মোগলদের হাতে তুলে দেন। এই জয়ের ফলে কান্দাহার মোগলদের অধিকারে আসে।
১৫৯৫-৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মন্সবদারী পদকে তিনটি
ভাগে ভাগ করেন। এই সময় অশ্ব ও অশ্ব সওয়ারির সংখ্যা নির্ধারণ করে দেন।
১৫৯৫ খ্রিষ্টাব্দে আহম্মদনগর-এর শাসক
বারহানউদ্দিন মৃত্যবরণ করেন। প্রথামতে বারহানউদ্দিনের পুত্র বাহাদুর সুলতান হওয়ার
কথা। বিজাপুরের সুলতান দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহ বাহুদুরের পক্ষে ছিলেন। এই সূত্রে
বিজাপুরের ভূতপূর্ব সুলতানের বিধবা পত্নী এবং বারহানউদ্দিনের ভগ্নী চাঁদবিবি। তিনি
ইব্রাহিম আদিল শাহের নাবালককালে, প্রায় দশ বৎসর অভিভাবিকা হিসেবে রাজত্ব করেন। তিনি
আহম্মদনগরে এসে ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুরের পক্ষালম্বন করেন। এই অবস্থায় আহম্মদনগরের
বিরোধীপক্ষ মোগলদের সাহায্য প্রার্থনা করেন। এই সুযোগে আকবর গুজরাটের শাসনকর্তা
যুবরাজ মুরাদ এবং সেনাপতি আব্দুর রহিম খানের নেতৃত্বে সৈন্য পাঠান। মোগল বাহিনী
আহম্মদনগর দুর্গ অবরোধ করেন। চার অবরোধ করে থাকার পরও মোগলরা এই দুর্গের পতন ঘটাতে
ব্যর্থ হন। ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে মীমাংশা হয়। এই মীমাংশা মতে, বাহাদুরকে আহম্মদ
নগরের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং বেরার অঞ্চল মোগলদের কাছে হস্তান্তর করা
হয়। বেরার মোগলদের হস্তগত হওয়ায়, দক্ষিণের অন্যান্য সুলতানরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফলে
বিজাপুর, গোলকুণ্ডা এবং আহম্মদনগর মিলিতভাবে মোগলদের আক্রমণ করার উদ্যোগ নেয়। ১৫৯৭
খ্রিষ্টাব্দে সম্মিলিত বাহিনীর বিরুদ্ধে মোগলদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে সম্মিলিত বাহিনী
পরাজিত হলে, বিজাপুর এবং গোলকুণ্ডার বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। ফলে চাঁদ বিবি
একা মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। অবশেষে চাঁদবিবি মোগলদের সাথে আলোচনা করার
উদ্যোগ নেন। কিন্তু আহম্মনগরের অভিজাতরা চাঁদবিবিকে বিশ্বাঘাতক নামে অভিহিত করে,
তাঁক হত্যা করে। এই সময় মোগল শিবিরে অভ্যন্তরীণ গোলমালের কারণে, আহম্মদনগর থেকে
মোগল বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। ফলে আহম্মদনগরের সৈন্যরা আবার রাজ্যের অধিকার গ্রহণ
করে।
১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতাপ সিংহ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র অমর সিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আকবর অমর সিংহের বিরুদ্ধে মানসিংহ এবং যুবরাজ সেলিমকে পাঠান। অমর সিংহ পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন। এমন সময় বাংলাদেশে উসমান বিদ্রোহ করেন। ফলে উসমানকে দমন করার জন্য আকবর মানসিংহকে বাংলাদেশে প্রেরণ করেন।
আহম্মদনগরের ঘটনায় আকবর ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই
অমর সিংহকে পরাজিত করে তিনি নিজেই ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আহম্মদনগর আক্রমণ করেন।
আক্রমণের শুরুতেই মোগলরা দৌলতাবাদ দখল করে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে আহম্মদনগরের একটি অংশ
মোগলদের অধিকারে আসে। কিন্তু এর ভিতর খান্দেশের রাজা আলি খাঁ মৃত্যবরণ করলে, তাঁর
উত্তরাধিকারী মীরণ বাহাদুর শাহ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই কারণে আকবর আহম্মদনগর থেকে
খান্দেশে চলে আসেন এবং আসীরগড় অবরোধ করেন। ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে আকবর এই দুর্গটি দখল
করেন। এরপর যুবরাজ দানিয়েলের হাতে রেবার, আহম্মদনগর ও খান্দেশের শাসনভার অর্পণ করে,
রাজধানীতে ফিরে আসেন।
বাংলার বার ভূঁইয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
১৫৮৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উড়িষ্যার লোহানী রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা লোহানী বংশের আফগান
শাসকরা আকবরের অধীনে ছিলেন। এই বছরে শ্রীপুরের শাসক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
১৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে খাজা সুলায়মান লোহানীর
সহায়তায় কেদার রায় এবং চাঁদ রায় ভূষণা দুর্গ দখল করেন। তবে যুদ্ধে চাঁদ রায় নিহত
হন। এই অবস্থায় বাংলাকে দমন করার জন্য,
১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই মার্চ মানসিংহকে বাংলার সুবেদার হিসেবে পাঠানো হয়। ১৫৯৫
খ্রিষ্টব্দের ২রা এপ্রিল মানসিংহের পুত্র হিম্মত
সিংহের নেতৃত্বে ভূষণা দুর্গ আক্রমণ
করেন এবং মোগল অধিকারে নিয়ে আসেন। এরপর তিনি
ঈসা খাঁ'র বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য, তাণ্ডা থেকে রাজমহলে রাজধানী
স্থানান্তরিত করেন। তিনি নতুন এই রাজধানীর নামকরণ করেন আকবরনগর। ৭ই নভেম্বর তিনি
নতুন রাজধানীর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। মানসিংহ প্রথমে শেরপুর মোর্চায় (বগুড়া জেলায়)
শিবির স্থাপন করেন এবং সেখানে একটি মাটির দুর্গ নির্মাণ করেন। তিনি এই স্থানের
নামকরণ করেন সেলিমনগর এবং বর্ষাকালটা তিনি সেখানেই কাটান।
১৫৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ভূষণা দুর্গ পুনর্দখলের জন্য মানসিংহ তাঁর পুত্র দুর্জন সিংহের
নেতৃত্বে এক অভিযান প্রেরণ করেন। এই যুদ্ধে দুর্গের ভিতরে কামানের গোলা বিস্ফোরিত
হওয়ার ফলে সুলায়মান লোহানী নিহত হন এবং কেদার রায় মারত্মকভাবে আহত হন। এরপর তিনি
পালিয়ে ঈসা খাঁর কাছে আশ্রয় নেন।
১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে মগ জলদস্যুরা বিশাল নৌবহর নিয়ে জলপথে ঢাকা আক্রমণ
করে। বিশেষ করে এরা ত্রিমোহনীতে মোগল দুর্গের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মোগল বাহিনী
তাদের তাড়া করলে সংঘর্ষে বহুসংখ্যক মগ নিহত হয়। এই সময় মগদের সহায়তায় কেদার রায় শ্রীনগরে
মোগল ঘাঁটি
আক্রমণ করেন। বিক্রমপুরের অনতিদূরে দুপক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কেদার রায়
আহত ও বন্দি হন। বন্দী অবস্থায় তাঁকে রাজা মানসিংহের নিকট নেওয়ার পর তার মৃত্যু
হয়। কেদার রায়ের মৃত্যুর পর শ্রীপুর, বিক্রমপুরের দুর্গ মুসা খাঁ নিজ অধিকারে আনেন।
শেষ পর্যন্ত মানসিংহ পুরোপুরি বাংলাকে মোগল সাম্রজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যর্থ হন।
১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর মৃত্যু বরণকরেন।
অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মুরাদ এবং দানিয়েল
তাঁর জীবদ্দশাতেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। অবশিষ্ট পুত্র সেলিম ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে
বিদ্রোহ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর মোগল সিংহাসনে আরোহণ
করেন সেলিম। ইতিহাসে তিনি সম্রাট
জাহাঙ্গীর নামে পরিচিত।