ইসলাম খান
(১৫৭০-১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দ)
মোগল সেনাপতি ও বঙ্গদেশের মোগল শাসনামলে রাজধানী ঢাকার প্রথম সুবাদার। তাঁর প্রকৃত নাম শেখ আলাউদ্দিন চিশতি। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁকে ইসলাম খান উপাধি দিয়েছিলেন। ইতিহাসে তিনি ইসলাম খান নামে সর্বাধিক পরিচিত।

তার বাবার নাম শেখ বদরউদ্দিন চিশতি। তিনি ফতেহপুর সিক্রি নিবাসী দরবেশ শেখ সেলিম চিশতির দৌহিত্র ছিলেন। কথিত আছে ইসলাম খান শৈশবকালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের খেলার সাথী ছিলেন। এই সূত্রে তিনি মোগল ঐতিহ্য সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত হতে পেরেছিলেন। বড় হয়ে তিনি মোগল সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। ১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সিংহাসন আরোহণের পর, তাঁকে দু'হাজারী মনসবদারী পদে উন্নীত করেন এবং  ইসলাম উপাধি প্রদান করেন।

দায়িত্বশীল কাজ হিসেবে তিনি বিহার প্রদেশের সুবাদার পদ পান। সিংহাসনে আরোহণের পর, সম্রাট জাহাঙ্গীর ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে বাংলার সুবেদার করেন। তিনি বাংলার রাজনীতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময় বাংলায় ছিল বারো ভুঁইয়াদের রাজত্ব। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন- এদের পরাজিত করা ছাড়া বাংলা দখল সম্ভব নয়। এছাড়া নদী-মাতৃক বাংলা দেশে নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন। তাই তিনি প্রথমে শক্তিশালী নৌবাহিনী গড়ে তোলেন। এরপর তিনি বার-ভুঁইয়াদের অন্যতম ভুঁইয়া মুসা খাঁ-এর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। পথিমধ্যে তিনি খুলনা-যশোহর অঞ্চলে ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যকে আক্রমণের উদ্যোগ নিলে, তিনি বশ্যতা স্বীকার করেন এবং মুসা খাঁ-এর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে সাহায্য করার অঙ্গীকার করেন।

১৬০৯ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান তৎকালীন বাংলার সীমান্ত রাজ্য কুচবিহার দখল করেন।  এই সময় পূর্ববাংলার শাসক ছিলেন, ঈসা খাঁর পুত্র মুসা খাঁ।

১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ইসলাম খাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকেন। এই ক্রমাগত আক্রমণের মুখে, পূর্বঙ্গের মুসা খাঁর সামরিক শক্তি হ্রাস পায়। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে মোগল বাহিনী যাত্রাপুর ও ডাকচারা দুর্গ দখল করে নেয়।
এই সময় বাংলার ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে, তিনি ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। এই সময় ইসলাম খান ঢাকার নাম পাল্টে রাখেন জাহাঙ্গীরনগর।  

১৬১১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোগলরা
ঢাকা থেকে সোনারগাঁও আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুসা খাঁ পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে, মোগলবাহিনীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন।  ধারণা করা হয় এই সময়ে তিনি
খিজিরপুর দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন।


১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেই মোগলরা ময়মনসিংহের ভুঁইয়া উসমানের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। প্রবলভাবে বাধা দেওয়ার পরেও উসমান পরাজিত হন এবং তিনি পালিয়ে শ্রীহট্টের আফগান ভুঁইয়া বায়জিদ কর্‌রানির আশ্রয়ে চলে যান। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। মুসা খাঁর সাথে যুদ্ধের সময় তিনি চুক্তি অনুসারে মোগলদের সাহায্য করেন নি, এই অজুহাতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। বাখেরগঞ্জের ভুঁইয়া রামচন্দ্র ছিলেন প্রতাপাদিত্যের জামাতা। রামচন্দ্র যাতে প্রতাপাদিত্যকে সাহায্য না করতে পারেন, সে কারণে ইসলাম খান একই সাথে রামচন্দ্র-এর বিরুদ্ধে অপর একটি সেনাদল পাঠান।  প্রতাপাদিত্য যশোহর রক্ষার জন্য তাঁর পুত্র উদয়াদিত্যকে নিয়োগ করেন আর নিজে তাঁর রাজ্যের রাজধানী ধুমঘাট প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধে প্রথমে উদয়াদিত্য এবং পরে প্রতাপাদিত্য পরাজিত বন্দী হন। পরে বন্দী অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান পুনরায় উসমানের রাজ্য আক্রমণ করেন। যুদ্ধের প্রথম থেকেই উসমান ক্রমাগত জয়লাভ করতে থাকেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তীরবিদ্ধ হয়ে উসমানের মৃত্যু হলে, আফগান সৈন্যরা মোগলদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। এর ভিতর দিয়ে বাংলার ভুঁইয়াদের রাজত্ব শেষ হয়ে যায়। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান তৎকালীন বাংলার সীমান্ত রাজ্য কুচবিহার এবং কামরূপ রাজ্য দখল করেন। ইসলাম খান ১৬১৫ খ্রিষ্টাব্দে অহোম রাজ্য আক্রমণ করেন কিন্তু সফল হতে পারেন নি।

বার-ভূঁইয়াদের পরাস্ত করার পর ইসলাম খান, বাংলার প্রাদেশিক রাজধানী রাজমহল ঢাকাতে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। এর ফলে মোগল সৈন্যরা বাংলার কেন্দ্রীয় অংশে স্থায়ীভাবে ব্যবহার করার সুযোগ লাভ করে। রাজধানী স্থানান্তরের পরে তিনি ঢাকার নামকরণ করেনজাহাঙ্গীরনগর । যদিও শেষ পর্যন্ত এই নাম স্থায়ী হয় নি। তবে ঢাকার ইসলাম পুর তার নামেই নামকরণ করা হয়েছিল এবং এখনও তা আছে।

উল্লেখ্য,  রমনার একাংশের নাম একসময় তার বংশের নামে মহল্লা চিশতীয়ান বলে পরিচিত ছিল। সে নামও ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেছে। ধারণা করা হয় সৈয়দ আওলাদ হোসেন লেনের মসজিদটি ইসলাম খাঁ নির্মিত। পুরানো ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগার ছিল  একটি প্রাচীন দুর্গ। ইসলাম খান পুননির্মাণ করেছিলেন।

ইসলাম খান ঢাকা এবং বাংলার সুবাদার হিসেবে ছিলেন ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১৬১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা থেকে ২৫ মাইল উত্তরে ভাওয়াল এলাকায় মৃতুবরণ করেন। তাঁকে প্রথম সমাহিত করা হয়েছিল ঢাকার বাদশাহী বাগ (পুরনো হাইকোর্ট এলাকা)। পরে তাঁর দেহাংশ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল  ফতেহপুর সিক্রিতে। সেখানে তাঁর দাদা শেখ সেলিম চিশতি'র পাশে সমাহিত করা হয়।