মুসা খাঁ

১৫৬৬-১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ।
পূর্ব-বাংলার স্বাধীন বার ভুঁইয়াদের অন্যতম ঈসা খাঁ'র পুত্র।

১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে ঈসা খাঁ'র মৃত্যুর পর, মুসা খাঁ উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল রাজত্ব লাভ করেন। তাঁর রাজত্বে ছিল বৃহত্তর ঢাকা ও কুমিল্লা জেলার প্রায় অর্ধেক, প্রায় সমগ্র বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং রংপুর, বগুড়া, পাবনা জেলার কিয়াদংশ। তিনি পিতার মত সিংহাসন দখলের পর মসনদ-ই-আলা উপাধি ধারণ করেছিলেন।

১৬০২ খ্রিষ্টাব্দের এক নৌযুদ্ধে রাজা মানসিংহ মুসা খাঁর বাহিনীকে পরাজিত করলেও, শেষ পর্যন্ত তাঁকে বশ্যতা স্বীকার করাতে পারেন নি। এই সময় রাজধানী সোনারগাঁও ছাড়াও খিজিরপুর, কাত্রাবো, কদমরসুল, যাত্রাপুর, ডাকচর, শ্রীপুর ও বিক্রমপুর তার দূর্ভেদ্য সামরিক ঘাটি ছিল।

১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব বঙ্গের অন্যতম ভূঁইয়া কেদার রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর অধিকৃত স্থানগুলি এবং শ্রীপুর, বিক্রমপুরের দুর্গ মুসা খাঁ এর হস্তগত হয়।

 

সিংহাসন আরোহণের পর, তিনি রাজধানী সোনার গাঁও থেকে ঢাকাতে স্থানান্তের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই কারণে বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জনহল এলাকায় প্রাসাদ ও মসজিদ নির্মাণ করেন। একই সাথে পুরো এলাকাতে সুশোভিত বাগান তৈরি করেন। এর নাম ছিল 'বাগ-ই-মুসা'। 

১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাগ-ই-মুসা এলাকা অর্থাৎ ঢাকা এলাকা রাজধানী সোনারগাঁওয়ের পরিবর্তে ভাটি অঞ্চলের অর্থাৎ বাংলার রাজধানী স্থাপনের ঘোষণা দেন। এবং মুসা খাঁ এর প্রাসাদ বাটি দালান-কোটা রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের পরে পূর্ব বাংলা সরকারে সরকারি ভবন তৈরির সময় মুসা খাঁ তৈরি দালান-কোটাগুলি ধ্বংশ করা হয়।

১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ইসলাম খাঁ পূর্ববঙ্গ দখলের জন্য ক্রমাগত আক্রমণ পরিচালনা করতে থাকেন। এই ক্রমাগত আক্রমণের মুখে, মুসা খাঁর সামরিক শক্তি ধীরে ধীরতে হ্রাস পেতে থাকে। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে মোগল বাহিনী যাত্রাপুর ও ডাকচারা দুর্গ দখল করে নেয়। এই সময় মুসা খাঁ সোনার গাঁ থাকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে থাকেন।  তিনি শীতলক্ষা নদীকে প্রতিরোধের ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করেন। বিক্রমপুর ও শ্রীপুরে স্থাপন করেন ছোট ছোট চৌকি। বন্দর খালের তীরে তিনি নিজে অবস্থান করেন। মীর্জা মোমিনের ঘাটি ছিল তার পশ্চাদে এবং আল আওয়াল খাঁর ঘাটি ছিল খালের অপর তীরে। তিনি আব্দুলস্নাহ খাঁকে কদম রসুলে, দাউদ খাঁকে কাতরাবোতে, মাহমুদ খাঁকে ডেমরার কালে এবং বাহাদুর গাজীকে ছাওরায় নিযুক্ত করেন।

১৬১১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোগলরা ঢাকা থেকে সোনারগাঁও আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুসা খাঁ পরাজিত ও বন্দী হন। পরে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হলে, মোগলবাহিনীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করে বাকি জীবন অতিবাহিত করেন।
ইসলাম খাঁ মোঘল সেনাপতি মীর্জা নাথানকে পাঠান দাউদ খাঁ এর বিরুদ্ধে কাতরাবোতে, শেখ রুকুন উদ্দীন কে মাহমুদ খাঁর বিরুদ্ধে ডেমরা খালে, এবং আব্দুল ওয়াহিদকে পাঠান বাহাদুর গাজীর বিরুদ্ধে ছাওরায়। মীর্জা নাথান সূর্যাস্তের আগেই কাওরাবুর বিপরীত দিকে অবস্থিত একটি স্থানে এক রাতের মধ্যেই একটা সুদৃঢ় কেল্লা গড়ে তোলেন। সেখানে তিনি স্থাপন করেন বড় বড় কামান। এই যুদ্ধে দাউদ খাঁর বাহিনীকে পরাজিত করেন। 

এই সংবাদ পাওয়ার পর তিনি তৎক্ষণাৎ প্রতিরোধের জন্য নৌবহর কাতরাবুর দিকে পাঠান। কিন্তু দাউদ খাঁর দূর্গের পতন রোধ করতে ব্যার্থ হন। এরপর মোঘল বাহিনী মুসা খাঁর দূর্গ আক্রমণ করেন। এই সময় তিনি দূর্গ ত্যাগ করে নৌকাযোগে পালিয়ে যান। এদিকে মীর্জা মোমিন তার নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে কতিপয় নির্বাচিত অশ্বারোহি নিয়ে বন্দর খাল পাড় হয়ে যান। খালের অপর তীরে মুসা খাঁ নৌবহর অবস্থান করছিল। মীর্জা মোমিনের সৈন্যদের দেখে আল-আওয়াল খাঁ তার দূর্গ ত্যাগ করে মুসা খাঁ নৌবহরের সহিত মিলিত হন। এই সময় ছোটো ছোট কিছু যুদ্ধে জয় করে- মুসা খাঁ সোনারাগাঁও এর দিকে চলে যান এবং সেখানে অবস্থান গ্রহণ করেন।

১৬১১ খ্রিষ্টাব্দে ১২ই মার্চ এই আক্রমণ শুরু হয়। যথাসাধ্য প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেও সোনার গাঁ মোগলদের দখলে চলে যায়। এই সমব ইব্রাহীমপুরের দ্বীপে পালিয়ে যান। এরপর তিনি অনিয়মিত বাহিনী নিয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে থাকেন। এবং এই ধরনের যুদ্ধ করে তিনি কয়েকদিনের মধ্যে তিনি কোদালিয়া ফাঁড়ি দখল করেন। এরপর তিনি মীর্জা নাথানের দূর্গও দখল করেন। কিন্তু এই যুদ্ধের মুসা খাঁ সৈন্যহীন দশায় পৌঁছান। বিশেষ করে, মোগল বাহিনী পুনরায় আক্রমণ শুরু করলে, মুসলমান জরিদাররা ইসলাম খাঁ কাছে আত্ম-সমর্পণ করেন। এরপর নিরুপায় হয়ে মুসা খাঁ আত্মসমর্পন করেন। এরপর মুসা খাঁ ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে ইসলাম খাঁ এর নির্দেশে বাগ-ই-মুসাতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। এরপর সুবাদার ইসলাম খাঁ ও  মুসা খাঁ-এর ভিতরে সহিত সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।

১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৯ শে অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার বাগ-ই-মুসা অবস্থিত মুসা খাঁ মসজিদের সন্নিকটে তিনি সমাহিত আছেন। যা নিতান্ত অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহ হল এবং কার্জন হল প্রাঙ্গনে অবস্থিত)।

মুসা খাঁ'র 'বাগ-ই-মুসা' বিনষ্ট হয়ে গেলেই, তাঁর নির্মিত মুসা খাঁ মসজিদটির অস্তিত্ব আছে। অবশ্য এই মসজিদটির স্থাপত্য রীতি অনুসারে অনেকে মনে করেন, এটি নির্মিত হয়েছিল শায়েস্তা খাঁর আমলে ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে।