শায়েস্তা খান
মোগল সম্রা্ট শাহজাহান  আওরঙ্গজেব-এর অন্যতম সেনাপতি এবং বাংলার সুবেদার।

১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতা আসফ খান ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। আসফ খান-এঁর কন্যা
মমতাজ মহল-এর সাথে সম্রাট শাহজাহান-এর বিবাহের পর, শাহজাহান আসফ খানকে উজির বা প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত করেন। বৈবাহিক সূত্রে শায়েস্তা খান ছিলেন, সম্রাট শাহজাহানের শ্যালক।

আত্মীয়তার সূত্রে বাল্যকালে শায়েস্তা খানকে ৫০০ পদমর্যাদার মনসব দেওয়া হয়েছিল। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল মির্জা আবু তালিব। সম্রাট
জাহাঙ্গীর তাঁর রাজত্বের একুশতম বছরে তাঁকে 'শায়েস্তা খান' উপাধিতে ভূষিত করেন। ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে তিনি বিভিন্ন প্রদেশের সুবেদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে সেনাপতি হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যের গোলকুন্ডার আব্দুল্লাহ কুতুবশাহের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময়, তাঁর ভাগ্নে শাহজাদা আওরঙ্গজেব-এর সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা জন্মে। সিংহাসনে আরোহণের পর আওরঙ্গজেব তাঁকে উচ্চতর পদমর্যাদা দান করেন এবং উত্তরাধিকার যুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ আমীর-উল-উমারা (আমীরদের বা অভিজাতদের প্রধান) উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে মীরজুমলার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খান বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হন।

তাঁর পিতা ও পিতামহের প্রতি শ্রদ্ধাবশত  ক্রমান্বয়ে পদোন্নতি পেয়ে তিনি বিভিন্ন প্রদেশের সুবাহদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। শাহজাহানের রাজত্বকালে সেনাপতি হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে, বিশেষত গোলকুন্ডার আব্দুল্লাহ কুতুবশাহের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন কালে তিনি তাঁর ভাগ্নে শাহজাদা আওরঙ্গজেবের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। উত্তরাধিকার যুদ্ধে তিনি  আওরঙ্গজেব-কে সহায়তা করেছিলেন।  আওরঙ্গজেব সিংহাসনে বসার পর, তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ আমীর-উল-উমারা (আমীরদের বা অভিজাতদের প্রধান) উপাধিতে ভূষিত করেন।

১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবেদার মীরজুমলার মৃত্যু হয়। তাঁর স্থলে ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে সময় আওরঙ্গজেব তাঁকে বাংলার সুবেদার নিযুক্ত করেন। মীরজুমলার মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। শায়েস্তা খান কঠোর হস্তে প্রশাসনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন।
সে সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে পর্তুগিজদের ঘাঁটি ছিল। এই অঞ্চলের মোগল নৌবাহিনী বেশ দুর্বল ছিল। তিনি নৌযুদ্ধে ব্যবহৃত নৌকা এবং নৌসেনার দক্ষতা বৃদ্ধি করেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে শায়েস্তা খান প্রথমে সন্দ্বীপ জয় করার পরিকল্পনা করেন। সে সময়ে চট্টগ্রামের বিরুদ্ধে তিনি ভুলুয়া  স্থলবাহিনীর ঘাঁটি ব্যবহার করেন। স্থালপথে আক্রমণের জন্য সন্দ্বীপকে নির্বাচন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, একই সাথে স্থল ও নৌবাহিনী দ্বারা আরাকানদের আক্রমণ করা। ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি সন্দ্বীপ আক্রমণ করেন। সে সময়ে সন্দ্বীপের শাসক ছিলেন পলাতক মোগল নাবিক দিলওয়ার খান। তিনি মোগল বাহিনীকে যথাসম্ভব বাধা দিয়েও মোগল বাহিনীর কাছে পরাজিত হন। যুদ্ধের প্রারম্ভে ওলন্দাজদের প্রতি শায়েস্তা খান সাহায্যের আবেদন করেছিলেন। এই সময়ে চট্টগ্রামের মগ রাজা ও পর্তুগিজদের সৈন্যদের মভিতর দ্বন্দ্ব ছিল। আরাকান রাজার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্তুগিজরা তাদের পরিবার, জাহাজ এবং কামান নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে এসে ভুলুয়ার (নোয়াখালী) মোগগল বাহিনীর কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে। শায়েস্তা খান পর্তুগিজ সেনাপতিকে অভ্যর্থনা ও সম্মান জানান। তাঁরর অনুগামীদের উপযুক্ত বেতন-ভাতাসহ মুগল সরকারের চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়। বাটাভিয়ার ওলন্দাজ গভর্নর জেনারেল তার কোম্পানির সাহায্যের ব্যাপারেও শায়েস্তা খানকে আশ্বস্ত করেছিলেন। তারা আরাকানের রাজধানী ম্রোহং-এ তাদের বাণিজ্য কুঠি বন্ধ করে দেয়, তাদের কর্মচারীদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং তাদের জাহাজগুলির গতিপথ আরাকান থেকে অন্যান্য স্থানে পাল্টে দেয়। চট্টগ্রাম অভিযানে কাজে লাগানোর জন্য ওলন্দাজ কোম্পানি শায়েস্তা খানকে দুটি জাহাজ পাঠান।

শায়েস্তা খান ১৬৬৫ খিষ্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি চট্টগ্রাম অভিযান পরিচালনা  করেন। তাঁর পুত্র বুজুর্গ উমেদ খানকে সার্বিক নেতৃত্ব দেওয়া হয় এবং নৌ-সেনাপতি ইবনে হোসেনকে নৌ-বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করা হয়। অন্যদিকে শায়েস্তা খান নিজে রসদ সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী ও নৌ-বাহিনী একই সময়ে একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে স্থল ও সমুদ্রপথে যাত্রা করে। স্থল বাহিনীকে জঙ্গল কেটে রাস্তা তৈরি করে অগ্রসর হতে হয়েছিল। সমুদ্রে এবং পরে কর্ণফুলী নদীতে একটি বড় যুদ্ধে পর্তুগিজদের সাহায্য নিয়ে মোগলরা প্রথম জয় পায়। আরাকানদের চট্টগ্রাম দুর্গ অবরোধ করা হয় ১৬৬৬ খিষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারি। এই যুদ্ধে জয়লাভের পর ২৭শে জানুয়ারি বুজুর্গ উমেদ খান দুর্গে প্রবেশ করেন এবং চট্টগ্রামকে মুগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। সম্রাটের অনুমতি সাপেক্ষে শায়েস্তা খান চট্টগ্রামের নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ করেন।

এরপর শায়েস্তা খান পাশ্ববর্তী পাহাড়ি রাজ্যগুলির গোষ্ঠীপতিদের বিদ্রোহ দমন করেন। তারা মীরজুমলার মৃত্যুর পর অস্থায়ী শাসকদের শাসনামলের বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। শায়েস্তা খানের রাজধানী রাজমহলে পৌঁছার সংবাদ পাওয়া মাত্রই কুচবিহারের রাজা কর প্রদানের অঙ্গীকার করে তাঁর কাছে আনুগত্য পত্র পাঠান। সুবাহদারের পুত্র ইরাদাত খান কামরূপ পুনর্দখল করেন এবং হিজলির বাহাদুর খানকে বন্দি করা হয়। পরে তিনি বিশাল অঙ্কের অর্থ প্রদান করে মুক্তিলাভ করেন। জৈন্তিয়া এবং ত্রিপুরার রাজারাও আনুগত্য স্বীকার করে হাতি ও অন্যান্য উপঢৌকন পাঠান। পার্বত্য রাজ্য মোরাঙ্গও (কুচবিহারের পশ্চিমে এবং পূর্ণিয়ার উত্তরে) আনুগত্য স্বীকার করেন এবং কর দিতে অঙ্গীকার করেন।

এরপর শায়েস্তা খাঁ হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কার্যক্রমের উপর নজর দেন। াংলায় ইংরেজ কুঠি স্থাপনের পর থেকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ইংরেজরা বিশেষ সুবিধা লাভ করতে পারে নি। মোগল কর্মকর্তারা নানাভাবে কোম্পানির কর্মচারীরাদের কাছ থেকে কর আদায় করতো। ফলে ইংরেজদের সাথে মোগলদের সংঘাত সৃষ্টি হয়। মোগলরা হুগলীর ইংরেজ কুঠি আক্রমণ করে। ইংরেজরা জব চার্নকের নেতৃত্বে হুগলী ত্যাগ করে সুতানটিতে আশ্রয় নেয়। মোগলরা পুনরায় আক্রমণ করলে, জব চার্নক সুতানটি পরিত্যাগ করে বালেশ্বরে চলে যায়। এরপর মোগলবাহিনী বালেশ্বর অধিকার করে।

১৬৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা হুগলী দখলের চেষ্টা করে। এর ফলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজ সৈনিকদের যুদ্ধে হয়। এই যুদ্ধে ইংরেজরা পরাজিত হয়ে হুগলী ত্যাগ করে। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ, কোম্পানির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জব চার্নককে, কলকাতার ২০ মাইল দক্ষিণে উলুবেড়িতে বাণিজ্যকুঠি নির্মাণের অনুমতিও দেন। ১৬৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজরা তাদের বাণিজ্যিক কেন্দ্র সুরাট থেকে বোম্বাইতে স্থানন্তরিত করে। বোম্বাই উপকূলে মোগল সৈন্যদের সাথে ইংরেজদের যুদ্ধ শুরু হলে শায়েস্তা খান, জব চার্নককে দেওয়া অনুমতি প্রত্যাহার করে নেন। এছাড়া এই সময় কোম্পানির সৈন্যরা ক্যাপ্টেন হিথ-এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম দখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মোগল যুদ্ধ জাহাজ সিদি ইয়াকুবের নেতৃত্বে বোম্বাই নগরী অবরোধ করে। প্রায় ১ বৎসর অবরুদ্ধ থাকার পর, কোম্পানির সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে। ইংরেজরা সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মোগল সম্রাট তাদের ক্ষমা করেন এবং ইংরেজদের পুনরায় বাণিজ্য করার অনুমতি প্রদান করেন। এই সময় কোম্পানির পক্ষ থেকে সম্রাটকে দেড় লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রদান করা হয়।

তিনি রাজধানী শহর ঢাকা ও তার বাইরে বেশ কয়েকটি মসজিদ, সমাধি এবং অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর নির্মিত অট্টালিকাগুলির মধ্যে রয়েছে: অনাবাসিক বণিক, পথিক ও দর্শনার্থীদের জন্য ১৬৬৪ খিষ্টাব্দে ছোট কাটরা নির্মাণ করেন। এর সীমানার ভিতরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি ছোট মসজিদ রয়েছে, যাতে যথেষ্ট স্থাপত্য শিল্পবিষয়ক রুচিবোধ দেখতে পাওয়া যায়। শায়েস্তা খান একটি প্রাসাদ, মসজিদ এবং মিটফোর্ড থেকে লালবাগ পর্যন্ত বিস্তৃত বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি পোশতা নামে অভিহিত একটি বড় বাঁধ নির্মাণের বিশাল পরিকল্পনা করেছিলেন। কাটরা এবং মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। কাটরার প্রাঙ্গণে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট বর্গাকার পুরাতন কবর রয়েছে। এটিকে শায়েস্তা খানের কন্যা চম্পা বিবির কবর বলে মনে করা হয়।
মিটফোর্ড হাসপাতালের (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ) কাছে বুড়িগঙ্গার তীরে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ তৈরি করান। লালবাগ দুর্গকে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামানুসারে আওরঙ্গাবাদ দুর্গ নাম দেন এবং তা  সম্প্রসারণ করেন। শাহজাদা মুহম্মদ আজম এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন, তবে তিনি এটি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। দুর্গের প্রাচীরঘেরা প্রাঙ্গণে শায়েস্তা খান বিবি পরীর সমাধি নির্মাণ করেন। কথিত আছে যে, ইরান দুখ্ত নামে পরিচিত বিবি পরী ছিলেন শায়েস্তা খানের কন্যা। শাহজাদা আজমের সঙ্গে তাঁর বাগদান হয়েছিল, কিন্তু তার অকালে মৃত্যু হয়েছিল। প্রিয় কন্যার সমাধি নির্মাণের জন্য শায়েস্তা খান প্রচুর অর্থব্যয় করে উত্তর ভারত থেকে দামি নির্মাণ-সামগ্রী আমদানি করেছিলেন। এ সমাধি ঢাকার এবং শায়েস্তা খানের আমলের স্থাপত্যশিল্পের এক চমৎকার নিদর্শন। এছাড়া তিনি চকবাজার মসজিদ, সাতগম্বুজ মসজিদ এবং নারায়ণগঞ্জের অদূরে লক্ষ্যার তীরে খিজিরপুর মসজিদের মতো ঢাকা ও তার পাশ্ববর্তী এলাকার অন্য আরো কয়েকটি মসজিদের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত।

১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।


তথ্যসূত্র: