সিপাহি বিপ্লব ১৮৫৭
ভারতের
ইষ্ট-ইন্ডিয়া
কোম্পানির শাসনামলে, ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানির ভারতীয় সৈন্যদের বিদ্রোহের কারণে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, সরকারি ভাষায়
তাকে উল্লেখ করা হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ
(Sepoy Mutiny) । কিন্তু ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ একে
সিপাহি বিপ্লব নামে অভিহিত করে থাকেন।
ইষ্ট-ইন্ডিয়া
কোম্পানির দুঃশাসনের কারণে ভারতের স্থানীয় জনসাধারণের ভিতরে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে ছোটো-বড় বেশকিছু
বিদ্রোহের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। এ সকল বিদ্রোহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- সন্ন্যাসী বিদ্রোহ (১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দ),
চু্যাড় বিদ্রোহ (১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দ), বেরিলীর বিদ্রোহ (১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দ), কোল-বিদ্রোহ (১৭৩১-৩২ খ্রিষ্টাব্দ), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭ খ্রিষ্টাব্দ)।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত হয়েছিল সিপাহি বিদ্রোহ।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড ক্যানিং ভারতের গভর্নর জেনারেল হন।
তাঁর শাসনামলে সংঘটিত এই বিপ্লবকে তিনি কাঠোর হস্তে
দমন করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে এই বিদ্রোহের মূল কারণ ছিল এনফিল্ড রাইফেলের
চর্বিমিশ্রিত কার্তুজ। ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে এই রাইফলে ভারতীয় সৈন্যদের ভিতরে বিতরণ করা
হয়। এই রাইফেলের চর্বিমিশ্রিত কার্তুজ দাঁত দিয়ে কেটে রাইফেলে পূরতে হতো।
জনরব ওঠে যে এই কার্তুজের চর্বিতে ছিল শুকর ও গরুর চর্বি। ফলে হিন্দু ও মুসলমান
সৈন্যদের ভিতরে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। কোম্পানির পক্ষ থেকে একে গুজব হিসেবে বলা হলেও,
এই ক্ষোভকে রোধ করা সম্ভব হয় নি। এই সূত্রে ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ (রবিবার, ১৭ চৈত্র ১২৬৩), কলকাতার বারকাপুরে
মঙ্গলপাণ্ডের নেতৃত্বে
ইষ্ট-ইন্ডিয়া
কোম্পানির ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ করে।
এই বিদ্রোহের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সৈন্যরা বিদ্রোহের
প্রস্তুতি নেয়। এই বিদ্রোহের অনুপ্রেরণায় প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে লক্ষ্ণৌর ভারতীয়
সৈন্যরা। এরপর ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মে (রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১২৬৪) এই বিদ্রোহ মিরাটে ছড়িয়ে পড়ে। এরা
স্থানীয় কারাগার থেকে বন্দী সিপাইদের মুক্ত করে এবং ১১ই মে (সোমবার, ৩০ বৈশাখ
১২৬৪), দিল্লীতে পৌঁছায়। এরা তৎকালীন মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহকে তাঁদের নেতৃত্ব
দেওয়ার অনুরোধ করে। বাহাদুর শাহ অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাজী হয়। এরপর সৈন্যরা
বাহাদুর শাহকে হিন্দুস্তানের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। এই সময় সিপাইরা দিল্লিতে
সাধারণ ইংরেজ নরনারীদের আক্রমণ করে নির্বিচারে হত্যা করে। এরপর সিপাইরা দিল্লি
সেনানিবাস দখল করে নেয় এবং সেখানকার ভারতীয় সৈন্যরা বিদ্রোহীদের দলে যোগদান করে।
সিপাইরা বাহাদুর শাহের আদেশ উপেক্ষা করে, দিল্লিতে লুটতরাজ চালায়।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের
১৩ই মে (বুধবার ১ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৪), ফিরোজপুরের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং ফিরোজপুর
নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ১৪ই মে (বৃহস্পতিবার ২ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৪),
মুজফ্ফরপুরের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং সেখানকার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
১৫ই মে (শুক্রবার ৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৪), আলীগড়ে সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং সেখানকার
নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। এই তিনটি স্থানেই সাধারণ মানুষ সিপাইদের সাথে
যোগদান করে এবং স্থানীয় প্রশাসনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের
২১শে মে (বৃহস্পতিবার ৯ জ্যৈষ্ঠ ১২৬৪), পাঞ্জাবের নৌসেরা ও হতমর্দানে সৈন্যরা
বিদ্রোহ করে। এরই ধারাবাহিকতায় অযোধ্যা ও উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সৈন্যরা
বিদ্রোহ করে। এরা এসব অঞ্চলে বন্দী কয়েদিদের মুক্ত করে দেয় এবং সরকারি খাজাঞ্চিখানা
লুট করে। এই সময় কোম্পানির দ্বারা নিগৃহীত তালুকদাররা সিপাইদের সাথে যোগদান করে।
একই ঘটনা রোহিলাখণ্ডে ঘটলো। সেখানকার তালুকদার ও প্রজারা সৈন্যদের সাথে যোগ দিয়েছিল।
এই সময় কানপুরের নানা সাহেব, ঝাঁসিতে রাণী, বিহারের অন্তর্গত জগদীশপুরে
কুনওয়ার ও অমর সিংহ এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
দক্ষিণ ভারতের সৈন্যরা বিদ্রোহের মেজাজে ছিল না। এরা উত্তর ভারতের বিদ্রোহের সংবাদ
পেয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেয়। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুলাই (শুক্রবার ৩ শ্রাবণ ১২৬৪), মৌলবি
আলাউদ্দিন এবং সর্দার তররাজ খাঁর নেতৃত্বে হায়দ্রাবাদে বিদ্রোহের সূচনা হয়। কিন্তু
এই অঞ্চলের সিপাইদের মধ্যে কোম্পানির অনুগত সৈন্য থাকায়, এই বিদ্রোহ সহজেই দমন করা
সম্ভব হয়েছিল। তবে সাতরা ও কোলাপুরের জমিদাররা এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
রাজস্থানের অনেক জমিদার ইংরেজদের আনুগত্য প্রকাশ করায়, এখানে বিদ্রোহ ততটা তীব্র
আকার ধারণ করে নি।
এই বিদ্রোহে কোম্পানির শিখ ও গুর্খা সৈন্যরা অনুগত ছিল। ফলে এদের সাহায্যে কোম্পানি
ধীরে ধীরে বিদ্রোহী রাজাদের দমন করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রায় চার মাস অবরুদ্ধ থাকার পর,
লরেন্সের নেতৃত্বে কোম্পানির সৈন্যরা দিল্লী দখল করতে সক্ষম হয় এবং বৃদ্ধ মোগল
সম্রাট বাহাদুর শাহকে বন্দী করে। এর ভিতর দিয়ে ভারতে মোগল সাম্রাজ্যের বিলুপ্ত ঘটে।
এই সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামের সৈন্যরা শান্তই ছিল। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই নভেম্বর (বুধবার ৪ অগ্রহায়ণ
১২৬৪) চট্টগ্রামের সৈন্যরা বিদ্রোহ করে। কিন্তু কোম্পানির সৈন্যরা এই বিদ্রোহ সমন
করতে সমর্থ হয়। ফলে বিদ্রোহী সৈন্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২২শে
নভেম্বর (রবিবার ৮ অগ্রহায়ণ ১২৬৪) ঢাকার সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এই বিদ্রোহ
কোম্পানির সৈন্যরা দমন করতে সক্ষম হয়। ফলে পরাজিত সিপাইরা জলপাইগুড়ির দিকে পালিয়ে
যায়।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মার্চ, কোম্পানির সৈন্যরা ঝাঁসী অবরোধ করে। এই সময় ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ
এই অবরোধ ভাঙার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এই সময় প্রায় বিশ হাজার সৈনিকের নিজস্ব একটি দলের নেতৃত্ব
অন্যতম বিদ্রোহী নেতা তাতিয়া তোপে সহায়তা করেছিলেন। ৩১শে মে পর্যন্ত কোম্পানির সৈন্যদের প্রতিরোধ করতে
পারলেও এর পর প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। কোম্পানির সৈন্যদল ঝাঁসী শহর দখল করে।
অবশ্য এর আগের রাতে দুর্গের দেয়াল থেকে সন্তানসহ লাফ দিয়ে লক্ষ্মী বাঈ প্রাণরক্ষা করে।
এরপর আনন্দ রাওকে সাথে নিয়ে রাণী কাল্পীতে যান এবং সেখানকার অন্যান্য বিদ্রোহীদের
সাথে যোগ দেন। এরপর রাণী লক্ষ্মী বাঈ এবং তাতিয়া তোপে গোয়ালিয়রের দিকে রওনা দেন। সেখানে তাদের যৌথবাহিনী গোয়ালিয়রের মহারাজার দলকে পরাজিত করে। পরাজিত বাহিনীর সদস্যরা পরবর্তীতে যৌথবাহিনীর সাথে একত্রিত হয়। তারপর কৌশলগত অবস্থানে থাকা গোয়ালিয়রের কেল্লা দখল করে বাঈ এবং তোপের সম্মিলিত বাহিনী। ১৮৫৮
খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুন, ফুল বাগ এলাকার কাছাকাছি কোটাহ-কি সেরাইয়ে কোম্পানির
সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে রানি শহিদ হন। ২০ জুন সেনাদল গোয়ালিয়র পুণর্দখল করে।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জুলাইয়ের ভিতরে সকল বিপ্লবীরা পরাজিত ও নিহত হলে সিপাহি
বিপ্লবের অবসান হয়।