মিন বিন
Min Bin
১৪৯৩-১৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দ।

আরাকান রাজ্য-এর  ম্রায়ুক উ  রাজ্যের ১৩তম রাজা। তিনি মিন বা-গায়ই নামেও পরিচিত। তাঁর মুসলামানি নাম জাবুক শাহ। তিনি ছিলেন ম্রায়ুক উ রাজ্যের অষ্টম রাজা মিন রাজা -র পুত্র। মায়ের নাম ছিল সো নান্দি।

১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এরপর তাঁকে অল্প বয়সে ম্রায়ুক উ রাজ্যের সেনাবাহিনীর একটি অংশের সেনা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। ১৫২১ খ্রিষ্টাব্দে থাজাতা মৃত্যুবরণ করলে, নতুন রাজা হন মিন খায়ুং। এই সময় তিনি রাজাকে সন্তুষ্ট করে, স্যান্ডোওয়ে প্রদেশের সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি স্থল ও নৌবাহিনীর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী সেনাদল গঠন। ১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিদ্রোহ করেন এবং রাজধানী ম্রায়ুক উ-এর দিকে অগ্রসর হন। এই যুদ্ধে মিন খায়ুং-এর অনুগত সৈন্যরা পরাজিত হলে, মিন বিন রাজধানী দখল করেন এবং মিন খায়ং-কে হত্যা করে, ২৭শে মে সিংহাসন দখল করেন।

উল্লেখ্য,
১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে হোসেন শাহ বাংলার সুলতান হোন। তিনি চট্টগ্রামের অধিকার নিতে গেলে
ত্রিপুরার রাজা ধনমানিক্যের সাথে সংঘাত সৃষ্টি হয়। ১৫১৩-১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত উভয় রাজার ভিতর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রাজা ধনমানিক্যের মৃত্যুর পর হোসেন শাহ‌ চট্টগ্রাম তাঁর দখলে আনেন এবং উত্তর আরাকান পর্যন্ত তাঁর রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হন।

১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পোর্তুগিজরা চট্টগ্রামে আসা শুরু করে। এরা প্রথমাস্থায় বাণিজ্য করতে এলেও, পরে তারা জলদস্যু হয়ে যায়। সুলতান এদের দমন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এ সময় আফগান শাসক শের শাহ বাংলা আক্রমণ করতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি পোর্তুগিজদের সহায়তা কামনা করেন।

১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুলতান নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।  এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর ১৬ বছর বয়সী পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ।
ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন। বাংলার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মিন বিন, ১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই অক্টোবর চট্টগ্রাম দখল করে নেন। এরপর ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখে, তাঁর সৈন্যরা ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। এই সময় সুলতানের সৈন্যরা রাকানিদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং প্রায় ১০দিন রাকানিদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুলতানের সৈন্যরা পরাজিত হয় এবং ১১ই ডিসেম্বর এরা রাকানি সৈন্যরা ঢাকা প্রবেশ করে। এরা ঢাকা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ ও হত্যাকাণ্ড চালাতে থাকে। ফলে ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি তরুণ সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজের পক্ষে রানিমাতা, রাজা মিন বিন-কে কর প্রদান করতে বাধ্য হয়। এরপর ১৩ই এপ্রিল মিন বিন- ঢাকা ত্যাগ করে। ১৪ই মে তিনি অধিকৃত অঞ্চলের জন্য একজন গভর্নর নিয়োগ করেন। ফলে চট্টগ্রাম রাকানিদের অধিকারেই থেকে যায়। এরপর তিনি ত্রিপুরা অভিযানে উদ্যোগ নেন। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সফলভাবে ত্রিপুরা আক্রমণ শেষ করেন এবং ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তিনি ম্রায়ুক উ-এ ফিরে আসেন।

বাংলা এবং ত্রিপুরা অভিযানের পর, মিন বিন পর্তুগিজ আক্রমণের মুখে পড়েন। ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগিজ বাহিনী ম্রায়ুক উ-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করে। উন্নত যুদ্ধ জাহাজ এবং যুদ্ধাস্ত্রের সাহায্যে তারা ২২ শে ফেব্রুয়ারি ম্রায়ুক উ-রাজ্যের স্থলভূমি দখল করে নেয়। এরপর এরা ম্রায়ুক উ-এর রাজধানী অভিমুখে অগ্রসর হয়। এরা কালাদান নদী নৌকায় পার হয়ে, ২৬শে ফেব্রুয়ারি ম্রায়ুক উ-এর কয়েক মাইলের ভিতরে পৌঁছে যায়। ২৭শে ফেব্রুয়ারি পরতুগিজরা রাকানিদের  কয়েকটি সৈন্যদলকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। এরপর ২৮শে ফেব্রুয়ারি এরা ম্রায়ুক উ নগরী অবরোধ করে, আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এই সময় মিন বিন স্বয়ং সৈন্য পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তিনি পর্তুগিজদের আক্রমণ প্রতিহত করে, পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। ৭ই মার্চ পর্যন্ত আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে ঘোরতর যুদ্ধ হয়। অবশেষে, আরকানি সৈন্যরা পর্তুগিজদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়।

কিন্তু পর্তুগিজরা আরও শক্তিশালী হয়ে আবার আক্রমণ করবে, এই ভাবনা থেকে মিন বিন তাঁর সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। তিনি যুদ্ধে পর্তুগিজদের উন্নত যুদ্ধাস্ত্র ক্রয় করা শুরু করেন। ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি পর্তুগিজদের তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সেনাবাহিনীকে সজ্জিত করেন।

এসকল যুদ্ধে জয়লাভের পর, তিনি চক্রবর্তী রাজা হিসেবে নিজেকে অভিহিত করেন। তিনি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নতুন বৌদ্ধ মন্দির প্রতিষ্ঠায় হাত দেন। ১৫৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে ৯ই নভেম্বর তিনি শিৎথায়ুং মন্দির তৈরি করেন।

ইতিমধ্যে মিয়ানমারের তৌঙ্গু রাজবংশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। ১৫৩৫ থেকে ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে  এদের সাথে হান্থাওয়াডে রাজ্যের যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে তৌঙ্গুরা জয়লাভের পর নিম্ন বার্মার তাদের দখলে চলে আসে। এর ঘটনাক্রমে মিন বিন তৌঙ্গুদের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন।

১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে, তৌঙ্গুদের চারটি বৃহৎ সেনাদল ৪০০০ হাজার পদাতিক, ১০০ অশ্বারোহী এবং ১০ হস্তীসেনা নিয়ে দক্ষিণ আরকানে পৌঁছায়। এরপর এরা আরাকানের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নগর থান্ডোয়া'র অভিমুখে যাত্রা করে। উল্লেখ্য এই নগরের শাসক ছিলেন সম্রাট মিন বিন-এর ভাই মিন অং হ্লা।  সম্রাট তৌঙ্গুসেনাদের বিতারিত করার জন্য একটি সুদক্ষ সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। তৌঙ্গুসেনারা সাময়িকভাবে অভিযান বন্ধ রাখলেও, তারা ১৫৪৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি বিশাল আকারের সেনাদল নিয়ে স্থল ও নৌপথে আক্রমণ করে। এই দলে ছিল ১৯০০০ পদাতিক, ৪০০ অশ্বারোহী, ৬০টি হস্তীসেনা এবং ৮০টি যুদ্ধ সাধারণ নৌসেনাবাহী জাহাজ, ৫০টি বর্মাবৃত যুদ্ধ জাহাজ দশটি রসদবাহী জাহাজ।  এই আক্রমণের মুখে দক্ষিণ আরকান তৌঙ্গুদের দখলে চলে যায় এবং ১৫৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি তারা আরকানের প্রাচীন রাজধানী ল্যাঙ্গুয়েত দখল করে নেয়। ২৪ শে জানুয়ারি থেকে তৌঙ্গুবাহিনী আরাকানের মূল রাজধান মারায়ুক-উ অভিমুখে অভিযান শুরু করে। মারায়ুক-উ দুর্গ পরিবেষ্টিত সুরক্ষিত নগরী ছিল। তৌঙ্গুসেনারা নগরে ঘিরে রাখা অবস্থায় সম্রাট মিন বিন সুযোগ বুঝে নগরী সকল জলাধার একসাথে খুলে দিয়ে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করে। সম্রাটের সৈন্যদের প্রতি আক্রমণ ও বন্যার কারণ তৌঙ্গুসেনারা বিপর্যয়ে পরে যায়। ফলে তিনদিন পর  তৌঙ্গুসেনারা পশ্চাদপসরণ করে। ২৬ মার্চ সম্রাটের বাহিনী থান্ডোয়া থেকে বিতারিত হয়।

এই যুদ্ধের পর, মিন বিন ত্রিপুরা বাহিনীর হাতে চলে যাওয়া রামু এবং চট্টগ্রাম পুনর্দখল করেন। এরপর তিনি তাঁর বড় ছেলে দীক্ষাকে রাজ্যের পরবর্তী সম্রাট নির্বাচন করেন এবং তাঁর ভাই মিন অং হ্লাকে থান্ডোয়ার শাসক হিসেবে নিয়োগ করেন। এর কিছুদিন পর, তিনি তাঁর অপর পুত্রকে থান্ডোয়ার শাসক হিসেবে নিয়োগ দেন।

মিনবিন ১৫৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন, তাঁর পুত্র দীক্ষা।

তাঁর স্ত্রীরা ছিলেন- সো মিন হ্লা, সো কায়ুক মা, মিনখায়ুং মেডায়ু এবং মিন ফালায়ুং। এই স্ত্রীদের গর্ভে ১০টি সন্তান জন্মলাভ করেছিল।


সূত্র:

https://en.wikipedia.org/wiki/Min_Bin