বা
বাংলাদেশ -এর চট্টগ্রাম বিভাগের একটি জেলা।

এই জেলার নামকরণ নিয়ে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। কথিত আছে এই এলাকায় একসময় অসংখ্য বানর ছিল। এই বানরগুলো শহরের প্রবেশ মুখের বিভিন্ন ছড়ার পাড়ে পাহাড়ে প্রতিনিয়ত লবণ ও পানি খেতে নামত। কোনো এক বছর প্রবল বৃষ্টির কারণে ছড়ার পানি বৃ্দ্ধি পায়। ফলে বানরের দল ছড়া পাড় হয়ে পাহাড়ে যেতে না পরে কিছুদিন অপেক্ষা করে। পরে বানরের দল এক অপরের হাত ধরে সারিবদ্ধভাবে ছড়া পাড় হয়। বানরের ছড়া পারাপারের এই দৃশ্য দেখতে পায় এই জনপদের মানুষ।  এই সময় থেকে এই জায়গাটির পরিচিতি লাভ করে "ম্যাঅকছি ছড়া " হিসাবে । উল্লেখ্য মার্মা ভাষায় 'ম্যাঅক' অর্থ বানর আর ছিঃ অর্থ বাঁধ। কালক্রমে স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে এই শব্দটি বান্দরবান হয়ে যায়।  পরে সরকারি দলিল পত্রেও এই অঞ্চল বান্দরবান নামে লিপিবদ্ধ হয়। তবে মার্মা ভাষায় বান্দরবানের প্রকৃত নাম "রদ ক্যওচি ম্রো"।

ভৌগোলিক অবস্থান ২১১১' উত্তর অক্ষাংশ হতে ২২২২' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২৪০' পূর্ব দ্রাঘিমাংশ হতে ৯২৪১' পূর্ব দ্রাঘিমাংশে। এ জেলার উত্তরে রাঙ্গামাটি জেলার, দক্ষিণে মায়ানমারের আরাকান রাজ্য, পূর্বে ভারত এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম কক্সবাজার জেলা অবস্থিত। চট্টগ্রাম সদর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭৫ কিলোমিটার।

আয়তন: ৪৪৭৯ বর্গ-কিলোমিটার।

ইতিহাস: ৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের চন্দ্রবংশীয় রাজা সু-লা‌-তাইং-সন্দয়া চট্টগ্রাম একটি সামরিক অভিযান পরিচালিত করেন। এই সময় আরাকানের বাহিনী এই অঞ্চল দখল করে।  ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে ত্রিপুরার রাজা এই অঞ্চল দখল করে নেয়। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান ফকরুদ্দিন মোবারক শাহ‌-এর চট্টগ্রাম দখল করেন এবং বান্দরবানও তাঁর অধিকারে আসে। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে আরাকান রাজা চট্টগ্রাম অধিকার করেন এবং ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে থেকে যায়। এই সময় বান্দরবান আরাকান রাজার অধীনে থাকলেও কার্যত তা পর্তুগিজ দস্যুদের কবলে ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বান্দরবান মোগলদের হস্তগত হলে, পর্তুগিজ এবং আরকানদের দখলদারিত্বের অবসান হয়। ১৭২৫ আরাকানরা বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে চট্টগ্রাম এবং বান্দরবান দখল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু মোগলরা দ্রুত এই অঞ্চল পুনরায় দখল করে নিতে সক্ষম হয়।

পলাশীর যুদ্ধের পর,  ইংরেজরা মীরজাফরকে সিংহাসনে বসায়। ইংরেজরা চট্টগ্রাম বন্দরের অধিকার লাভের জন্য নবাব মীর জাফরের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু মীরজাফর ইংরেজদের কাছে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্তৃত্ব দিতে তুলে দেন নি। ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে মীর জাফরকে অপসারণ করে মীর কাশিম বাংলার নবাব বানানো হয়। এই সময়  ইংরেজরা বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রামের অধিকার লাভ করে। চট্টগ্রামের শেষ ফৌজদার রেজা খাঁ সরকারিভাবে চট্টগ্রামের শাসন প্রথম ইংরেজ চিফ ভেরেলস্ট-এর হাতে সমর্পন করেন। শুরু হয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। এই সূত্রে ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই অঞ্চলের অধিকার ব্রিটিশ সরকার। এই সময় পার্বত্য চট্টগ্রামকে জেলা ঘোষণা করা হয় এবং বান্দরবানকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অধীনস্থ করা হয়। এই সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার প্রথম সুপারিনট্যানডেন্ট ক্যাপ্টেন মাগ্রেথ। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সুপারিনট্যানডেন্ট পদটির কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হয় এবং এই পদটির নামকরণ করা হয় ডেপুটি কমিশনার। পার্বত্য চট্ট্রগাম জেলার প্রথাম ডেপুটি কমিশনার ছিলেন টি, এইচ লুইন। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন অনুসারে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়। এই সার্কেল তিনটি ছিল
চাকমা সার্কেল, মং সার্কেল, এবং বোমাং সার্কেল। প্রত্যেক সার্কেলের জন্য একজন সার্কেল চীফ নিযুক্ত ছিলেন। বান্দরবান তৎকালীন সময়ে বোমাং সার্কেলের অর্ন্তভুক্ত ছিলো। বোমাং সার্কেলের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার কারণে এই জেলার আদি নাম ঘোষিত হয়েছিল বোমাং থং।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের অংশীভূত হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে বান্দরবানকে মহকুমা করে প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। এই সময় বান্দরবান রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্গত ছিল। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সময়, বান্দরবান বাংলদেশের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে নতুন মহকুমা খাগড়াছড়ি, লামা ও কাপ্তাই গঠন করার জন্য পুরাতন মহকুমাগুলোও পুনর্গঠন করা হয়।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই এপ্রিল, তৎকালীন লামা মহকুমার ভৌগলিক ও প্রশাসনিক সীমানাসহ সাতটি উপজেলার সমন্বয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। 

১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জেনালের এরশাদ সরকারের সময়ে সারাদেশে প্রশাসনিক সংস্কারের প্রক্রিয়ায় খাগড়াছড়ি ও রামগড় মহকুমা নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্যজেলার আলাদা নামকরণ ও সীমানা নির্ধারিত হয়। বর্তমানে রাঙ্গামাটি জেলার বৃহত্তর অংশ ও খাগড়াছড়ি জেলার কিছু অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেল, খাগড়াছড়ি জেলারবৃহত্তর অংশ নিয়ে মং সার্কেল এবং বান্দরবান জেলার বৃহত্তর অংশ রাঙ্গামাটি জেলার কিয়দংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল রয়েছে।

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় সরকার পরিষদ গঠন করে পরিষদ গুলোকে অনেক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। স্থানীয় সরকার পরিষদের চেয়ারম্যান পদটিকে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন করা হয়। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিচুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার পরিষদের নামকরণ পরিবর্তিত হয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আরও বেশি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। চুক্তির পরে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদও গঠিত হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন। আঞ্চলিক পরিষদের সদর দপ্তর
রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থিত।
 

বর্তমানে এই জেলার উপজেলা সংখ্যা ৭টি। এই উপজেলাগুলো হলো বান্দরবান সদর,  লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যাংছড়ি, রুমা, রোয়াংছড়িথানচি

বান্দরবান সদর: বান্দরবান জেলা সদরটি পৌরসভা হিসেবে স্বীকৃত। এই পৌরসভা কার্যালয় ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ২৫.৮৮ বর্গ কিলোমিটার জায়গা নিয়ে গ শ্রেণীর পৌরসভা হিসাবে গঠিত হয়। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে একে ক শ্রেণির পৌরসভাতে উন্নীত করা হয়।  এটি বান্দরবান প্রধান সড়ক সংলগ্ন, সদর উপজেলার সামনে এবং সাঙ্গু নদীর পাড়ে পৌরসভা কার্যালয় অবস্থিত। জেলা শহরটি চতুরদিকে পাহাড় বেষ্টিত এবং মাঝখানে সাংগু নদী বয়ে গেছে ।

এই জেলায় বাঙালি ছাড়া ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বাস করে। এই  ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হলোমারমা, চাকমা, মুরং, ত্রিপুরা, লুসাই, খুমি, বোম, খেয়াং, চাক, পাংখো ও তংচংগ্যা। এদের ভিতরে সংখ্যাগরিষ্ঠ নৃগোষ্ঠী হলো 'মারমা'। তাদের সংখ্যা ৭৫,৮৮০জন। তারা মূলতঃ ম্রাইমা নামে বার্মা হতে এসে বসতি স্থাপন করেছে অত্র এলাকাতে।

 বগা হ্রদ

এই জেলার উল্লেখযোগ্য পর্যটনস্থান হলো


সূত্র :
http://www.bandarban.gov.bd/
http://www.banglapedia.org/HTB/103465.htm