আসাম
ভারত
প্রজাতন্ত্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশ।
ভৌগোলিক
স্থানাঙ্ক : ২৬°০৯′উত্তর
৯১°৪৬′পূর্ব।
মোট আয়তন : ৭৮৫৫০ বর্গ কিলোমিটার।
রাজধানী : দিসপুর।
ভৌগোলিক অবস্থান : এর উত্তরে ভুটান, উত্তর-পূর্ব সীমান্ত জুড়ে রয়েছে অরুণাচল
প্রদেশ। পূর্বে নাগাল্যান্ড ও মনিপুরি, দক্ষিণে মিজোরাম,
ত্রিপুরা,
মেঘালয়।
দক্ষিণ-পূর্ব এবং পশ্চিমাংশে রয়েছে
বাংলাদেশ।
আসামের প্রশাসন
বর্তমানে পুরো আসাম ২৭টি জেলা এবং
৪৯ মহকুমায় বিভক্ত। জেলাগুলোর নাম হলো-
১. ধুবরি, ২. কোক্রাঝর, ৩. বনগাইগাঁ ৪. গোয়ালপাড়া, ৫. বারপেটা ৬. কামরূপ ৭. নালবাড়ি ৮. দার্রাং ৯. মোরিগাঁও |
১০. শোনিৎপুর
১১. নগাঁও ১২. কারবি আংলং ১৩. উত্তর কাছাড় পাহাড় ১৪. কাছাড় ১৫. হাইলাকান্দি ১৬. করিমগঞ্জ ১৭. গোলাঘাট ১৮. লক্ষ্মীপুর |
১৯. জোরহাট ২০. ধেমাজি ২১. ডিব্রুগড় ২২. শিবসাগর ২৩. তিনসুকিয়া ২৪. বাকশা ২৫. চিরাং ২৬. উদলগুরি ২৭. কামরূপ মেট্রোপলিটান |
আসামের জনসংখ্যা
২০১১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে
আসমের লোকসংখ্যা ৩,১১,৬৯,২৭২।
ধর্ম : ৬৪.৯২% হিন্দু, ৩০.৯৩% ইসলাম, ৩.৭১% খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য .৪৫%।
ভাষা : ৪৯.৪৪% অহমি, ২৭.৯১% বাঙালি, ৪.৯৩% বোড়ো, ২.১৫% নেপালি, হিন্দি ৫.৯৭% এবং ৯.৬% অন্যান্য ।
ইতিহাস
মহাভারতে প্রাগ্জ্যোতিষপুর
হিসাবে আসামের উল্লেখ আছে। এছাড়া খ্রিষ্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে কামরূপ নামে এই
অঞ্চলের পরিচিতি ছিল। আসাম এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলসমূহে প্রস্তর যুগ থেকেই মানুষের
বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যায়। সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে রচিত কালিকাপুরাণ
অনুসারে আসামের প্রাচীনতম শাসক ছিলেন মহীরঙ্গ। আসামের সবচেয়ে প্রাচীন অধিবাসীরা
কিরাত ও সিনা নামেই পরিচিত ছিল, অন্যান্য উপজাতিদের বলা হত ম্লেচ্ছ এবং অসুর।
মহাভারতে ভগদত্ত-র সৈন্যদলের বর্ণনায় সিনা ও কিরাতদের কথা জানা যায়। এদের
সেনাবাহিনী ছিল স্বর্ণোজ্জ্বল বর্ণচ্ছটায় বিভূষিত। পুরাণে কিরাতদের 'অরণ্যচারী',
'বর্বর' ও 'পাহাড়ি' হিসেবে উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমানে কিরাত বলতে ভারতের সীমান্তের
মঙ্গোলীয় ধাঁচের সব অধিবাসীকেই বোঝায়। কালিকাপুরাণে আসামের কিরাতদের বর্ণনায় বলা
আছে, এরা মাথা ন্যাড়া করে রাখে এবং এদের গায়ের চামড়া পীতবর্ণের, এরা শক্তিশালী,
হিংস্র, অজ্ঞ, এবং মদ ও মাংসে আসক্ত।
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে একটি শক্তিশালী নৃগোষ্ঠ, বর্তমান আসাম অঞ্চল দখল করে।
পরে একটি সাম্রাজ্য (১২২৮-১৮২৬) প্রতিষ্ঠা করে। স্থানীয় অন্যান্য আদিবাসীদের মন জয়
করে এরা অসম ('অনন্য' বা 'তুলনাহীন) নামে সম্মানিত হয়। এই থেকে এই জাতি এবং এদের
রাজ্যের এলাকা আসাম নামে পরিচিত লাভ করে। অনেকে মেন করেন পুরোনো আচাম শব্দটাকে
সংস্কৃত করে পরে এটাকে 'আসাম বা অতুলনীয়' করা হয়েছে। তাই ভাষায় 'আচাম' শব্দের অর্থ
'পরাস্ত হওয়া'। অসমিয় ভাষায়, আ-উপসর্গ যোগে 'আ-সাম'-এর মানে হয় 'অপরাজিত', 'বিজয়ী'।
ব্রাডেন-পাওয়েল'-এর মতে 'হা-কম' থেকেই এর উৎপত্তি, যার অর্থ হল নিচু বা সমতল দেশ।
এই অঞ্চলে
মোঙ্গলীয় জাতি প্রবেশ করেছিল।
এই ভাষাভাষীদের আদি বাস ছিল পশ্চিম চীনের
ইয়াংসিকিয়াং ও হোয়াং হো নদীর কাছাকাছি। সেখান থেকে তারা ব্রহ্মপুত্র, চিনদুইন ও
ইরাবতী নদীর অববাহিকা ধরে এগোতে এগোতে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে এবং মায়ানমারে প্রবেশ
করে। এদের ভিতর একটি দল তিব্বত ও আসাম অঞ্চলে প্রবেশ করে। এরা আসামের ধুবড়িতে
ব্রহ্মপুত্রের বিশাল বাঁক বেয়ে এগিয়ে যায়। এদের মধ্যেই একটা অংশ দক্ষিণদিকে গিয়ে
প্রথমে গারো পাহাড় ও পরে টিপ্পেরা পাহাড়ের রাজ্যটিকে দখল করে। অন্যরা মনে হয় কাপিলি
উপত্যকায় উঠে যায় এবং আরেকটা ভাগ উত্তর কাছাড়ের পাহাড়ি অঞ্চলে গিয়ে হাজির হয়।
তিব্বতী-বর্মী ভাষাভাষীদের আরেক ঝাঁক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার মাথায় গিয়ে আটকে যায় এবং
দক্ষিণদিকের পথ ধরে। ওরা নাগা পাহাড় দখল করে আর এরাই হয়ে ওঠে সেই নাগাদের
পূর্বপুরুষ। এই বহিরাগতদের অন্য একটি দল প্রথমে চিনডুইন ও ইরাবতী নদীর উজান ধরে
আসামের দক্ষিণদিকে সরে আসে এবং লুসাই, কাছাড় এবং মণিপুর ও নাগা পাহাড়ের বেশ কিছু
অংশ দখল করে উপনিবেশ গড়ে তোলে। তিব্বতী-বর্মী জাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজাতি
অংশের নাম বড়ো। আসামের অনার্য জনগোষ্ঠীর অসংখ্য উল্লেখযোগ্য অংশ গড়ে উঠেছে এই
বড়োদের থেকেই। বড়ো গোষ্ঠীর মধ্যে যে উপজাতিগুলো পড়ে তার মধ্যে আছে কোচ, কাছারি,
লালুং, ডিমাচা, গারো, রাভা, টিপরা, চুতিয়া ও মারান। বর্তমান কামরূপ জেলার
পশ্চিমদিকে যে বড়ো সমাজ রয়েছে, তাদেরকে হিন্দু জনগোষ্ঠী 'মেচ' নামে ডাকে। সম্ভবত
এটা সংস্কৃত ম্লেচ্ছ শব্দের বিকৃত রূপ। কামরূপের পশ্চিমের ভিতরদিকে যারা থাকে তাদের
কাছারি বলা হয়।
ভারতের পূর্বাঞ্চলের হিমালয়ের নিচু এবং সমতল অঞ্চলে
প্রোটো-অস্ট্রালয়েড
জাতি আগে থেকেই ছিল। এদের পরাজিত করে মোঙ্গলীয়রা সমতলভূমিতে আধিপত্য বিস্তার করতে
সক্ষম হয় নি। আবার
প্রোটো-অস্ট্রালয়েডরাও
মোঙ্গলীয়দের পারজিত করে পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে বসতি স্থাপন করতে সক্ষম হয় নি। কিন্তু
হিমালয়ের দক্ষিণাংশের নিচু পাহাড়ি এলাকা এবং হিমালয় সংলগ্ন সমতল এলাকায় উভয় জাতির
মিশ্রণ ঘটেছিল। এরপরে আর্যরা এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে-
ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং সহযোগী কোম্পানীর স্থানীয় মিত্ররা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার
নবাব সিরাজৌদ্দলাকে পরাজিত করে। কালক্রমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের
প্রশাসনিক পূর্ণ অধিকার লাভে সক্ষম হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা, বিহার, উড়ি্ষ্যা ও
আসাম নিয়ে একটি প্রশাসনিক এলাকায়
তৈরি করা হয়। এর নাম
ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি।
উল্লেখ্য এই সমগ্র এলাকার আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০
বর্গমাইল।
১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বার্মিজ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, আসাম ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির আশ্রিত রাজ্যে পরিণত হয়। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে এই রাজ্যের কাছাড় নামক অঞ্চলকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির খাচি, গারো এবং জয়ন্তীয়া অঞ্চলকে আসামের সাথে যুক্ত করে। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে আসামকে বাংলার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে উড়িষ্যায়
দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে চরম প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। ফলে
'বাংলা
প্রেসিডেন্সি'
থেকে আসামকে পৃথক করে একটি পৃথক প্রেসিডেন্সি তৈরি করা হয়। এই সময় শ্রীহট্ট, কাছাড়
ও গোয়ালপাড়া ইত্যাদি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলও
বাংলা প্রেসেডেন্সির
অংশে পরিণত হয়। এটাই
ছিল প্রথম বঙ্গভঙ্গ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিভাজন
কার্যকরী হয় নাই।
১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আসামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেখানে একটা পৃথক চিফ কমিশনারের
অধীনে শাসন চালানো শুরু হয়। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার
বঙ্গভঙ্গের
চেষ্টা করে। এই সময় আসামকে বাংলার পূর্বাংশের জেলাগুলোর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একজন
লেফটেনান্ট গভর্নরের প্রশাসনভুক্ত করা হয়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আবার আসামকে আলাদা
চিফ কমিশনারের আওতায় নিয়ে আসা হয় এবং ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে পাকাপাকিভাবে এখানে আলাদা
প্রশাসক নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ভাগ হওয়ার সময়ে, সিলেটের মুসলমান
অধ্যুষিত জেলাগুলোর অধিকাংশ পূর্ববাংলার (পাকিস্তান) মধ্যে চলে যায়। অবশিষ্ট অংশ
ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর কামরূপের দেওয়ানগুড়ি
ভুটানকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রশাসনভুক্ত
নাগা পাহাড়, জেলা নাগাল্যান্ডের অংশ হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে বোড়ো
জাতিসত্তার মানুষ আসাম থেকে একাংশ ভেঙে 'উদয়াচল' নামে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল দাবি
করে। অবশ্য সেই দাবি পূরণ হয় নি।
১৯৭o
খ্রিষ্টাব্দের
২ এপ্রিল, আসামের মেঘালয়কে
স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়।
এই সময় ৩৭টি সংসসদীয় আসনসহ মেঘালয়ের বিধানসভা গঠিত হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয়
সংসদে
"North-Eastern Areas
(Reorganization) Act, 1971"
পাশ হয়। সেই মোতাবেক ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে জানুয়ারি খাচি, গারো আর জয়ন্তিয়া
জেলা নিয়ে নতুন মেঘালয় রাজ্য গঠিত হয়।
ওই একই সময়ে মিজো পাহাড়ের
জেলাগুলোকে নিয়ে মিজোরাম নামক আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলও ঘোষিত হয়। সেই মিজোরামও
এখন একটা আলাদা রাজ্য।
সূত্র :
https://meghalaya.gov.in:8443/megportal/
http://www.amaderchhuti.com/info/meghalaya.php