বঙ্গভঙ্গ
(বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও তা বাতিল)
ব্রিটিশ ভারতে
অখণ্ড বঙ্গদেশ বিভাজনের প্রক্রিয়াটি বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিত।
১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে,
ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি
এবং কোম্পানীর স্থানীয় মিত্ররা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার
নবাব সিরাজদৌল্লাকে
পলাশির যুদ্ধে
পরাজিত করে।
কালক্রমে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই অঞ্চলের প্রশাসনিক
পূর্ণ অধিকার লাভে সক্ষম হয়। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা, বিহার, উড়ি্ষ্যা ও
আসাম নিয়ে একটি প্রশাসনিক এলাকায়
তৈরি করা হয়। এর নাম ছিল বাংলা প্রেসিডেন্সি।
উল্লেখ্য এই
সমগ্র এলাকার আয়তন ছিল ১,৮৯,০০০
বর্গমাইল।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে চরম প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।
ফলে
'বাংলা প্রেসিডেন্সি' থেকে আসামকে পৃথক করে একটি পৃথক প্রেসিডেন্সি তৈরি করা হয়।
এই সময় শ্রীহট্ট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া ইত্যাদি বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলকে আসামের সাথে
যুক্ত করা হয়েছিল। এটাই ছিল প্রথম বঙ্গভঙ্গ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বিভাজন কার্যকরী হয় নাই।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে
লর্ড কার্জন
বড় লাট
নিযুক্ত হন। মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য― লর্ড কার্জন
বাংলা প্রসিডেন্সি ভেঙে বাংলাকে দুর্বল করার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে বাংলার
আন্দোলনরত জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ব্রিটিশ শক্তি হুমকি হিসাবে নিয়েছিল। এই প্রক্রিয়া
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা প্রেসিডেন্সি থেকে উড়িষ্যাকে পৃথক করার প্রস্তাব করা হয়।
এই সময় লর্ড কার্জনের প্রধান সমর্থক ও উপদেষ্টা এ্যাণ্ডুজ ফ্রেজারকে বাংলার
লেফটেনান্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফ্রেজার বাংলা প্রেসিডেন্সির ক্ষমতা গ্রহণের পর,
লর্ড কার্জনের কাছে বঙ্গবিভাগের পরিকল্পনা পেশ করেন।
১৯০৩ বঙ্গাব্দের ৩ ডিসেম্বর তারিখে
লর্ড কার্জন এই পরিকল্পনা প্রায় অক্ষুণ্ণ রেখে সরকারিভাবে
উত্থাপন করেন এবং তা 'ক্যালকাটা
গেজেট'-এ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য এই সময় এই অঞ্চল
শাসিত হতো একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের অধীনে।
প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া
হলেও— এই বিভাজন থেকে বিশেষ কোন প্রশাসনিক সুবিধা পাওয়ার পরিবর্তে অসুবিধাই বেশি
হয়েছিল।
এই প্রস্তাবে
ছিল–
১. সমগ্র উড়িষ্যার সাথে বঙ্গদেশের বৃহত্তম অংশ যুক্ত হবে।
২. চট্টগ্রাম বিভাগের চারটি জেলা ও ঢাকা বিভাগের ঢাকা ও ময়মনসিংহ আসামের সাথে
যুক্ত করা হবে।
১৯০৫
খ্রিষ্টাব্দের ৫ জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়।
খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল
প্রথম কোলকাতা প্রেস- থেকে। আর ৭ই জুলাই
আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এই ঘোষণাটির ৭ম অনুচ্ছেদটির বৈদ্যুতিন অনুলিপি তুলে
ধরা হলো- আর.সি.মজুমদারেরর স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম পুস্তকের পৃষ্ঠা-২০।
[বৈদ্যুতিন
পত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল: প্রথম খণ্ড]
ইংরেজি ভাষায় লিখিত এই অনুচ্ছদের বঙ্গানুবাদ
আসামের বর্তমান প্রধান কমিশনারকে প্রতিনিধি গভর্নর করে বাংলার চট্টগ্রাম, ঢাকা এবং রাজশাহী বিভাগ, মালদহ জেলা এবং পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য নিয়ে নতুন একটি রাজ্য গঠিত হবে। দার্জিলিং বাংলার সাথে থাকবে। উভয় অঞ্চলের গুরুত্ব বিবেচনা করে সমন্বয়ের জন্য রাজ্যের নাম হবে পূর্ববঙ্গ ও আসাম। এর রাজধানী হবে ঢাকা আর অধীনস্থ কিছু হেডকোয়ার্টার হবে চট্টগ্রামে।
১,০৬,৫৫০ বর্গমাইলের ও ৩ কোটি ১০ লাখ জনগোষ্ঠীর এই অঞ্চলে, ১ কোটি ৮০ লাখ মুসলিম এবং ১ কোটি ২০ লাখ হিন্দু বসবাস করে। এর অধীনে একটি আইন সভা থাকবে। রাজস্ব বোর্ডের দুই সদস্য এবং কোলকাতা হাইকোর্টের কর্তৃত্ব অবিঘ্নিত থাকবে।
বিদ্যমান বাংলা প্রদেশ পূর্ব দিকের এই বিশাল অঞ্চল এবং ছোট নাগপুরের পাঁচটি হিন্দু রাজ্য ছেড়ে দেয়ায় আয়তনে ছোট হলেও সম্বলপুর ও উরিষ্যার পাঁচটি পূর্ববর্ণিত রাজ্যের অধিগ্রহণ করবে। ৫ কোটি ৪০ লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ কোটি ২০ লাখ হিন্দু এবং ৯০ লাখ মুসলিম অধ্যুষিত এর মোট আয়তন হবে ১,৪১,৫৮০ বর্গ মাইল।সংক্ষেপে বাংলা ও আসামের বর্তমান অঞ্চলসমূহ দুটো অখণ্ড এবং সার্বভৌম প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রতিটির মধ্যেই ব্যাপক সমরূপী অঞ্চল রয়েছে, যারা সুনির্দিষ্ট সীমানা দ্বারা পৃথককৃত, সম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সজ্জিত।”
পাদটীকা: পুনর্বিবেচিত এই বিভাজনের পরিকল্পনা ১৯শে জুলাই সরকারী ঘোষণা হিসেবে জনসমক্ষে আসে, ২০শে জুলাই কোলকাতা প্রেস থেকে তা প্রকাশিত হয়।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, তাই ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলন বা সংক্ষেপে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শুরুতে এর বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ, বাংলা পত্রপত্রিকা, ভারত ও ইংল্যান্ডের ইংরেজি পত্রিকাগুলো প্রতিবাদ করে। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে ইংরেজরা স্বপক্ষে আনতে সক্ষম হলেও, বাংলার সমগ্র মুসলমান সমাজকে আনতে পারে নাই। ১৯০৫ সালের জুলাই মাসের ভিতরে এই আন্দোলনে স্থানীয় জমিদার এবং সাধারণ প্রজাদের সাথে চরমপন্থী দলগুলোও শরিক হয়ে উঠে। ১৯০৫ সালের ১৭ই জুলাই খুলনাতে এই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ ব্রিটিশ পণ্য বয়কটের প্রস্তাব গৃহীত হয়। ক্রমান্বয়ে এই আন্দোলন ব্রিটিশ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী অন্দোলনে রূপ লাভ করে। এই সময় ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ব্রিটিশ বিভেদ নীতি দিয়ে মুসলমানদেরকে এই আন্দোলন থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে, ব্রিটিশরা ব্যর্থ হয়।
১ সেপ্টেম্বর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ, (শুক্র ১৬ ভাদ্র ১৩১২ বঙ্গাব্দ) তারিখে ব্রিটিশ ভারতের শীতকালীন রাজধানী সিমলা থেকে বঙ্গভঙ্গ আইন ঘোষিত হয়েছিল এবং এতে বলা হয়েছিল— ১৬ অক্টোবর ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ (৩০ আশ্বিন ১৩১২ বঙ্গাব্দ) তারিখ থেকে বঙ্গভঙ্গ কার্যকরী হবে।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ সেপ্টেম্বর কলকাতার রাজাবাজারে মুসলমানদের এক বিরাট সভায় এই আন্দোলনের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। ক্রমান্বয়ে এই আন্দোলন তীব্রতর হয়ে উঠলে— ব্রিটিশ সরকার কার্লাইল সার্কুলার জারি করে ছাত্রদের সভাসমিতি হরতাল নিষিদ্ধ করা হয়। এর প্রতিবাদে বাংলার যুবসমাজ নভেম্বর মাসে এ্যান্টি-কার্লাইল সার্কুলার সোসাইটি গঠন করে।
বঙ্গভঙ্গ-আইন বাতিল
ব্রিটিশ-রাজ সপ্তম এডওয়ার্ড মৃত্যুবরণ করেছিলেন ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ৬ মে তে। তাঁর
পুত্র পঞ্চম জর্জের অভিষেক হয় ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন। ৯ নভেম্বর, ভারতের
উদ্দেশে পঞ্চম জর্জ রানি মেরি-সহ ইংলন্ড থেকে রওনা হন এবং ৭ ডিসেম্বর রাজকীয়
শোভাযাত্রা সহকারে তিনি দিল্লির দরবারে পৌঁছান। ১২ ডিসেম্বর তিনি দিল্লির দরবারে
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা দেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তিনটি ঘোষণা ছিলো―
১. পূর্বতন বাংলা ও পূর্ববঙ্গ-আসাম প্রদেশ থেকে যথাক্রমে বিহার ও আসামকে বিচ্ছিন্ন করে অখন্ড বাংলাপ্রদেশ গঠিত হবে।
২. বাংলা প্রদেশ প্রেসিডেন্সি স্তরে উন্নীত করে লেফটেন্যান্ট গভর্নরের স্থানে গভর্নরের শাসনাধীনে আনা হবে।
৩. কলকাতার পরিবর্তে দিল্লি হবে ভারতের রাজধানী।
এ-ঘোষণার দ্বারাই ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গের আইনটি বাতিল হয়ে যায়। মূলত হিন্দু বাঙালিরা এই আইন বাতিলের কারণে আনন্দিত হন। তাঁরা কলকাতায় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি, পঞ্চম জর্জকে বিপুল সংবর্ধনা দেন। ১৯১২ সালের ২৫ জুন ভারত শাসন আইন পাশ হয়। মাদ্রাজের সে-সময়কার জনপ্রিয় গভর্নর লর্ড মাইকেল বাংলার গভর্নর হিসেবে ১৯১২ সালের ১ এপ্রিল যোগদান করেন।
সূত্র :