দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ
কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেবের পুত্র লক্ষ্মীকর্ণ বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন। এই সূত্রে বঙ্গদেশের 
রাজা
নয়াপাল 
সাথে একটি দীর্ঘকালীন যুদ্ধের সূচনা হয়। ধারণা করা হয় এই যুদ্ধ সংঘটিত 
হয়েছিল ১০৪১ খ্রিষ্টাব্দে। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে নয়াপাল পরাজিত হন। তিব্বতীয় 
গ্রন্থে এই যুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। লক্ষ্মীকর্ণ মগধ আক্রমণ করে 
নয়াপালকে পরাজিত 
করেছিলেন বটে, কিন্তু তিনি পাল-রাজধানী অধিকার করতে 
পারেন নি। কিন্তু তিনি বহু বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে মন্দিরের দ্রব্যাদি লুণ্ঠন 
করেন। এই সময় অতীশ দীপঙ্কর মগধে বাস করছিলেন। তিনি প্রথমে যুদ্ধের ব্যাপারে কোনো 
প্রকারে এই হস্তক্ষেপ করেন নি। কিন্তু পরে 
নয়াপাল
যখন লক্ষ্মীকর্ণকে পরাজিত 
করেন, তখন কলিচুর সৈন্যরা ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠে। এই সময় তিনি উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি 
স্থাপিনের উদ্যোগ নেন। শেষ পর্যন্ত উভয় রাজা এই সন্ধিতে সম্মত হন। এরপর ১০৪২ 
খ্রিষ্টাব্দ অতীশ দীপঙ্কর তিব্বত চলে যান। দীপঙ্করের চেষ্টায় যে 
সন্ধি হয় তা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নি।
তিব্বতে ধর্মচেতনা বিকাশের উদ্দেশ্যে 
তিব্বতের রাজা 
হ্লা-লামা তাঁকে স্বর্ণ উপহার দিয়ে.
তাঁকে তিব্বতে যাওয়ার 
আমন্ত্রণ 
জানান। কিন্তু বিবিধকাজে ব্যস্ত থাকার কারণে ইনি সে সময়ে তিব্বতে যেতে রাজি না হলে,
তিব্বত-রাজ ছলে-বলে-কৌশলে তাঁকে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর এই চেষ্টা ফলপ্রসু 
হওয়ার 
আগেই 
রাজা বিদ্রোহী প্রজাদের হাতে নিহত হন। এরপর তিব্বতের রাজা হন–
 রাজপুত্র 
চংছুপ।
এঁর সবিনয় অনুরোধে দীপঙ্কর 
আনুমানিক 
১০৪২ 
খ্রিষ্টাব্দের 
দিকে তিব্বতের 
দিকে রওনা দেন। পথে
নেপালের রাজা অনন্তকীর্তি তাঁকে সম্বর্ধনা দেন। নেপালের রাজপুত্র পথপ্রভা 
তাঁর কাছ থেকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন।
তিব্বতের গুজে নামক স্থানে 
তিব্বত-রাজ স্বয়ং তাঁকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর রাজপ্রাসাদে নিয়ে গিয়ে,
এক মহানুষ্ঠানে রাজা তাঁকে পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ হো-বো-জে (ভট্টারক) 
উপাধিতে ভূষিত করেন। ১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইনি তিব্বতের থোলিন রাজবিহার পরিদর্শন 
করেন। এরপর ইনি তিব্বতের রাজধানী লাসার নিকটস্থ ন্যাথাং নামকস্থানে বৌদ্ধবিহার 
প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে অবস্থানকালে ইনি বেশকিছু গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসা 
ও কারিগরিবিদ্যা সম্পর্কে তিব্বতি ভাষায় দুইশ'রও বেশি বই 
রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করে তিব্বতবাসীদের মাঝে বিপুল খ্যাতি অর্জন করেন। 
তিব্বতবাসীরা গৌতম বুদ্ধের পরেই তাঁকে স্থান দেয় এবং 
তাঁকে 'জোবো ছেনপো' বা মহাপ্রভুরূপে হিসাবে মান্য করে 
থাকে। 
তারা তাঁকে "অতীশ" উপাধিতে ভূষিত করে। তিনি তিব্বতে বহু প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথি 
আবিষ্কার করেন এবং নিজ হাতে সেগুলির প্রতিলিপি করে বাংলায়
পাঠান। তাঁর মূল রচনাগুলি বর্তমানে বিলুপ্ত। তিনি 
'তাঞ্জুর' নামের বিশাল তিব্বতি শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেছিলেন। এই মহাগ্রন্থে 
দীপঙ্করের ৭৯টি গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদ আছে। ১৩ বছর 
তিব্বতে বাস করার পর ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে বাহাত্তর বছর বয়সে তিব্বতের লাসা নগরীর 
অদূরে ঞেথাং বিহারে অতীশ দীপঙ্কর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুন তাঁর পবিত্র 
দেহভস্ম চীন থেকে ঢাকার ধর্মরাজিক বৌদ্ধবিহারে রাষ্ট্রীয় 
মর্যাদার সাথে অনীত হয় এবং সেখানে এটি সংরক্ষণের 
ব্যবস্থা করা হয়।
সূত্র :
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। 
প্রথম খণ্ড। জানুয়ারি ২০০২।