অতুলপ্রসাদ
সেন
বাংলা সঙ্গীতের প্রধান পাঁচজন স্থপতির একজন।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০শে অক্টোবর-এ তাঁর ঢাকাস্থ মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরের মাগর-ফরিদপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম
রামপ্রসাদ সেন এবং মায়ের নাম হেমন্তশশী।
অতি অল্পবয়সেই তিনি পিতৃহারা হন। এরপর তিনি তাঁর মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের কাছে
প্রতিপালিত হন। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, সে
সময় তাঁর বিধবা মা হেমন্তশশী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর জ্যাঠামশাই
দুর্গামোহন দাশকে বিবাহ করেন। এর ফলে তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত আঘাত পান। তিনি মায়ের
নির্দেশে তাঁর বোনদের মায়ের কাছে রেখে আসেন, কিন্তু নিজে মামা বাড়িতে ফিরে যান।
এরপর তিনি মামাদের অনুরোধে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি
বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।
বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাঁর শৈশব থেকেই আকাঙ্ক্ষা
ছিল। এই কারণে তাঁর মামারা তাঁকে বিলেত যাবার ব্যবস্থা করেন। এই যাত্রার পিছনে
অলক্ষ্যে সহযোগিতা করেন তাঁর সৎপিতা দুর্গামোহন দাশ। সৎপিতার এই সদিচ্ছার কথা জানতে
পেরে তিনি তাঁর সাথে দেখা করেন এবং এর ভিতর দিয়ে তাঁর মা এবং সৎপিতার সাথে
সুসম্পর্ক গড়ে উঠে।
১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে তিনি ইংল্যান্ডে যান। জাহাজে বসে তিনি
রচনা করেছিলেন 'উঠ গো ভারতলক্ষ্মী' গানটি। লন্ডনে গিয়ে তিনি আইন শিক্ষা করেন এবং
আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এই সময় তাঁর বড় মামা কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে
লন্ডনে যান। অতুলপ্রসাদ নিয়মিতভাবে লণ্ডনের মামাবাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করেন। এই
সূত্রে তাঁর মামাতো বোন হেমকুসুমের সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং কলকাতায় লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের
জুনিয়র হিসাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তবে এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন
দুর্গামোহন দাশ। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রস্তাবে 'খামখেয়ালী
সভা' প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই সভায় যাওয়া-আসা সম্পর্কে অতুল প্রসাদ সেন, তাঁর
রচিত 'আমার কয়েকটি রবীন্দ্র-স্মৃতি' প্রবন্ধে তারিখ উল্লেখ করেছেন
'১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ'। সম্ভবত তিনি স্মৃতিচারণার সময় এই সালটি ভুল করেছিলেন। উল্লেখ্য
রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও এই আসরে উপস্থিত থাকতেন বাংলা সঙ্গীতের অপর কৃতি পুরুষ
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। এই আসরে হাস্যরসাত্মক গান ছাড়াও রাগসঙ্গীতের মতো উচ্চাঙ্গের গান
হতো। আসরে রাগসঙ্গীত পরিবেশন করতেন রাধিকা গোস্বামী এবং এর সাথে তবলায় সঙ্গত করতেন
নাটোরের মহারাজ, আর এস্রাজ বাজাতেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আইন ব্যবসায় তিনি কলকাতায় ততটা পসার জমাতে পারেন নি। এছাড়া ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে
দুর্গামোহন দাশ পরলোকগমন করলে, অতুলপ্রসাদকে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। আর্থিক সুবিধা
লাভের আশায় তিনি রংপুরে চলে যান। এই সময় তাঁর সাথে হেমকুসুমের সম্পর্কের কথা জানাজানি
হয়ে যায়। হিন্দু রীতিতে এই বিবাহ অসিদ্ধ, তাই যথারীতি পারিবারিকভাবে প্রচণ্ড আলোড়ন
সৃষ্টি হয়। এই কারণে অতুলপ্রসাদ এবং হেমকুসুম, সত্যেন্দ্রসিংহের পরামর্শে
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় বিলাত যান এবং স্কটল্যান্ডের গ্রেট্নাগ্রীন গ্রামের রীতি
অনুসারে তাঁদের বিবাহ হয়। বিবাহের পর এঁরা দেশে ফিরে না যাওয়ার সংকল্প করেন এবং
বিলেতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু অতুলপ্রসাদ বিলেতে আইন ব্যবসায়
সুবিধা করতে পারেন নি।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের
যমজ পুত্র সন্তান জন্ম হয়। এঁদের নাম রাখা হয় দীলিপকুমার ও নিলীপকুমার। এই সময় তিনি
প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের ভিতর পড়েন। সংসারের খরচ মেটানোর জন্য এক সময় হেমকুসুম গহনা বিক্রয়
শুরু করেন। এর ভিতর নিলীপকুমার সাত মাস বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। চরম
হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি দেশ ফেরার কথা ভাবতে থাকেন। এই সময় মমতাজ হোসেন
নামক এক বন্ধু তাঁকে উত্তরপ্রদেশের লখ্নৌতে আইন ব্যবসার পরামর্শ দেন। এই ভরসায়
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথমে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা
তাঁকে বর্জন করলে, তিনি লখ্নৌতে চলে যান। মমতাজ হোসেন তাঁদের জন্য রাজা শ্রীপাল
সিংহের একটি বাসায় (মাসিক ৩০ টাকা ভাড়া) থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এখানে মমতাজ হোসেনের
সহায়তায় লখনৌতে ক্রমে ক্রমে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং ব্যবসায়িক স্বর্থে উর্দু ভাষা
শেখেন। তখনকার সরকারি উকিল টমাস, নগেন্দ্র ঘোষাল ও ঝাউলালপুলের বিপিনবিহারী বসুর
সহযোগিতায় নিজেকে প্রথম শ্রেণীর আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ক্রমে ক্রমে তিনি লখ্নৌ শহরের একজন বিশিষ্ট
ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। এই সময় বাবু গঙ্গাপ্রসাদ ভার্মা লখ্নৌ
শহরের উন্নয়নমূলক কাজ শুরু করেন। এক্ষেত্রে
অতুলপ্রসাদ, লালা শ্রীরাম এবং নবীউল্লাহ বেগ তাঁকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। এরপর
তিনি বিদ্যাসাগর গ্রন্থাগারের সংস্কার করেন। তাঁর অনুপ্রেরণায় প্রতিষ্ঠিত হয় বঙ্গীয়
যুবক সমিতি, গুডউইল ক্লাব ও সেবা সমিতি। শ্রীরমেশ ঘোষের উদ্যোগে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে
লখ্নৌতে মেয়েদের শিক্ষার জন্য প্রথম বাঙালি স্কুল 'হিন্দু গার্লস কলেজ'
স্থাপিত হয়েছিল। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই স্কুলের সভাপতি হন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বারাণসীতে কংগ্রেস
অধিবেশনে তিনি লখ্নৌর প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ অক্টোবর
বঙ্গভঙ্গ
কার্যকর করার দিনে, জাতীয় শোক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। এই দিনে রবীন্দ্রনাথের
আহ্বানে–
হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববন্ধনের প্রতীক হিসাবে '
রাখিবন্ধন'-এর
ব্যবস্থা করা হয়। অতুলপ্রসাদ এই অনুষ্ঠানের জন্য কলকাতায় আসেন এবং 'রাখিবন্ধন
অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। লখ্নৌতে ফিরে এসে তিনি স্বদেশী চেতনায় ভারতীয় যুবকদের
উদ্বুদ্ধ করার জন্য, 'মুষ্ঠিভিক্ষা সংগ্রহ'-এর সূচনা করেন। পরে এই সূত্রে
প্রতিষ্ঠিত হয় 'আউধ সেবাসমিতি'।
এই সময় অতুলপ্রসাদের আত্ময়স্বজনেরা, বিশেষ
করে তাঁর মা সব ভুলে গিয়ে সম্পর্ককে উন্নত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এই কারণে তাঁর
মা লখ্নৌতে আসেন। অতুলপ্রসাদও সব ভুলে গিয়ে সম্পর্ক দৃঢ় করায় আগ্রহ প্রকাশ করেন।
কিন্তু তাঁর স্ত্রী হেমকুসুম অতীতের লাঞ্ছনাকে ভুলতে পারেন নি। তাই তিনি কোনো ভাবেই
সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে মেনে নিতে পারেন নি। ফলে অনিবার্যভাবে পারিবারিক সংঘাত
শুরু হয়। পরম অশান্তি নিয়ে অতুলপ্রসাদ ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তৃতীয় বার ইংল্যান্ডে যান।
১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রাহ্মসমাজের প্রচারের কাজে হাত দেন। এরপর তিনি ক্যানিং
কলেজের ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেন 'গোখলে স্টুডেন্ট সোসাইটি'। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে
লখনৌতে ভয়াবহ বন্যা হলে, তিনি তাঁর গঠিত সমিতিগুলো থেকে স্বেচ্ছাসেবক সংগ্রহ করে,
বন্যার্তদের সেবা করেন।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত 'খামখেয়ালী সভা'র সূত্রে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে
তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে
রবীন্দ্রনাথ হিমালয় ভ্রমণের পর রামগড় এলে, তিনি অতুলপ্রসাদকে আমন্ত্রণ জানান।
এবং তিনি রামগড়ে গিয়ে কিছুদিন রবীন্দ্রনাথের সাথে কাটান। পারবারিক সংঘাতের কারণে স্ত্রী হেমকুসুমের
সাথে তাঁর সাময়িক বিচ্ছেদ ঘটে। এর কিছুদিন পর তিনি লখ্নৌ ছেড়ে কলকাতা হাইকোর্টে
যোগদান করেন এবং কলকাতার একটি ফ্লাট বাড়িতে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন শুরু করেন।
১৯১৬
খ্রিষ্টাব্দে লখ্নৌতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে লখ্নৌবাসীর আমন্ত্রণে যান। ১৯১৭
খ্রিষ্টাব্দে তিনি পুনরায় লখ্নৌতে ফিরে আসার উদ্যোগ নেন। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন
সভাসমিতি, সাহিত্য আসর, রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যস্ততার মধ্যে কাটান। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে
লখ্নৌতে রবীন্দ্রনাথ এলে, তাঁর স্ত্রী হেমকুসুম পুত্রকে সাথে নিয়ে অতুলপ্রসাদের
কাছে আসেন এবং একসাথে কবিকে সম্বর্ধনা দেন। সম্বর্ধনা শেষে রবীন্দ্রনাথ বোম্বে চলে
যান। এরপরই হেমকুসুম পুত্রকে সাথে নিয়ে অন্যত্র চলে যান।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে
লখ্নৌতে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনে তিনি সভাপতি হন। এই অধিবেশনে একটি সাহিত্য
পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতুলপ্রসাদ এর নামকরণ করেন 'উত্তরা'। এই সময়
হেমকুসুম দেরাদুনে যান। সেখানে টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর পেলভিস্ বোন ভেঙ্গে যায়।
অতুলপ্রসাদ দেরাদুনে গিয়ে তাঁর চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা করে লখ্নৌতে ফিরে আসেন। এরপর
কলকাতা থেকে তাঁর অসুস্থ মাকে লখ্নৌতে নিয়ে আসেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মে-তে
তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের
নির্ধারিত সভাপতি
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
অসুস্থ হয়ে পড়লে, অতুলপ্রসাদ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৩
খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদ লিবারেল পার্টির উত্তরপ্রদেশ শাখার অষ্টম অধিবেশনে তিনি
সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে, স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য
কার্শিয়াং যান। ডিসেম্বরে গোরক্ষপুরের প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের বার্ষিক
অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এরপর তিনি সুস্থবোধ করায় লখ্নৌতে ফিরে আসেন।
১৯৩৪
খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিলে পুরী যান।
গান্ধী (মহাত্মা) এই
সময় পুরীতে আসেন। গান্ধীজীর অনুরোধে অতুলপ্রসাদ তাঁকে গান গেয়ে শোনান। ২৫শে আগষ্ট
তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৬শে আগষ্ট দিবাগত গভীর রাতে মৃত্যবরণ করেন।
অতুলপ্রসাদ
সেনের গানের তালিকা
তথ্যসূত্র
- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথমখণ্ড।
জানুয়ারি ২০০২।
- বঙ্গ অভিধান। যোগনাথ মুখোপাধ্যায়। এম.সি. সরকার
অ্যান্ড সন্স প্রাঃ
লিঃ।বইমেলা ১৯৯৯।
- অতুলপ্রসাদ সমগ্র। সম্পাদনা সুনীলময় ঘোষ।সাহিত্যম্।১৪১৩/২০০৭।