দিগম্বরী দেবী
রবীন্দ্রনাথের পিতামহী।
পিতার নাম
রামতনু চৌধুরী। মায়ের
নাম আনন্দময়ী। উল্লেখ্য তাঁর পিতার পরিবার ছিল যশোহরের নরেন্দ্রপুর গ্রামের পীরালি
বংশের।
১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
দ্বারকানাথ ঠাকুরের
সাথে তাঁর বিবাহ হয়। বিবাহের সময় তাঁর বয়স ছিল ৬ বৎসর। তিনি অসামান্য সুন্দরী
ছিলেন।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর
'দ্বারকানাথ
ঠাকুরের জীবনী''
গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন
...দিগম্বরীদেবীকে লোকে লক্ষ্মীর অবতার বলিত। তাঁহার হাতের আঙুল চাঁপার কলিরমত ছিল। তাহার কেশদাম কোঁকড়া ছিল। প্রতিমার পদযুগল যেরূপ সচরাচর গঠিত হয়, তাঁহারও পদযুগল সেইরূপ ছিল। তিনি নাতিহ্রস্ব নাতিদীর্ঘ এবং শরীরে দোহারা ছিলেন। আমাদের গোষ্ঠীতে প্রবাদ আছে যে আমাদের বাটীতে যে জগদ্ধাত্রী মূর্তি গঠিত হইত, তাহার মুখটি নাকি দিগম্বরী দেবীর মুখের আদর্শে গঠিত হইত। সেখানের বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা যাঁহাকেই তাঁহার রূপের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহাদের সকলেই একবাক্যে বলিয়াছেন যে, তাঁহার রূপের কী বর্ণনা করিব, সাক্ষাত জগদ্ধাত্রী ছিলেন।
ধর্মনিষ্ঠা এবং রাশভারি স্বভাবের জন্য, অন্দরমহলে তাঁকে সবাই সমীহ করে চলতেন। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী'' গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন
'তাঁহার যথেষ্ট গাম্ভীর্য্য ছিল এবং তিনি খুব রাশভারী লোক ছিলেন।...তাঁহার নীরব শাসনের প্রতাপে গৃহ সুশাসিত ছিল। নীলমণি ঠাকুরের গোষ্ঠীই তখন জোড়াসাঁকোস্থিত ৬ নম্বর ভবনে একত্র বাস করিতেন। দিগম্বরী দেবী বর্ত্তমান বাটীর উত্তরপূর্ব্বাঞ্চলের গৃহে থাকিতেন। ...তিনি প্রত্যুষে চারটার সময় উঠিয়া প্রাতঃকৃত্য এবং স্নান সমাধা করিয়া হরিনাম করিতে বসিতেন। তাঁহার একটি লক্ষ হরিনামের মালা ছিল। তাহার অর্ধেক অংশ প্রাতে সমাপন করিয়া সামান্য আহার করিতেন – আহারের প্রধান দুগ্ধ ও ফল। পরাণ ঠাকুর তাঁহার পূজার ও রাঁধিবার উপকরণ সংগ্রহ করিয়া দিতেন। তাঁহার পূজা এবং রাঁধাবাড়া হইয়া গেলে দুপুর বেলায় রাসপঞ্চাধ্যায়, শ্রীমদ্ভাগবত প্রভৃতি বাঙালা গ্রন্থপাঠে সময় অতিবাহিত করিতেন। আবার বৈকালে মুখ হাত ধুইয়া হরিনামের অবশিষ্ট অংশ সম্পাদিত করিয়া ফেলিতেন। দয়া বৈষ্ণবী আসিয়া প্রায়ই গ্রন্থপাঠ করিত। রাত্রে তিনি হরিনাম করিয়া অন্ন আহার করিতেন। একাদশীতে ফলমূল আহার করা তাঁর নিয়মিত অভ্যাস ছিল।'
দ্বারকানাথের মা অলকানন্দার মতোই দিগম্বরী দেবী ইংরেজদের সাথে, দ্বারকানাথের
সংসর্গ অপছন্দ করতেন। কিন্তু দ্বারকানাথ স্ত্রীর মতামতকে গ্রাহ্য করেন নি। ফলে
তিনি স্বামীর সাথে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেন। এরপর থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুর
বাড়ির বৈঠকখানাতেই কাটাতেন।
পরে
দিগম্বরীর নেতৃত্বে ঠাকুরবাড়ির মহিলারা দ্বারকানাথকে তাঁর বসতবাড়ি থেকেই
বহিস্কারের সিদ্ধান্ত
নেন। তিনি
পণ্ডিতদের ডেকে বিবাহবিচ্ছেদের বিধান
চেয়েছিলেন।
কিন্তু পণ্ডিতার
তাঁকে জানান
যে, ভারতীয় শাস্ত্রে
স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের বিধান নেই।
ক্ষিতীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
'দ্বারকানাথ
ঠাকুরের জীবনী''
গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন
'...দিগম্বরীদেবী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতগণের নিকটে মতামত চাহিয়া পাঠাইলেন যে, যদি স্বামী ম্লেচ্ছদিগের সহিত একত্ত পানভোজন করেন, তবে তাঁহার সহিত একত্র অবস্থান কর্ত্তব্য কি না! তাঁহারা উত্তর দিলেন যে, স্বামীকে ভক্তি ও তাঁহার সেবা অবশ্য কর্তব্য, তবে তাঁহার সহিত একত্র সহবাস প্রভৃতি কার্য্য অকর্ত্তব্য। এই বিধান অনুসারে দিগম্বরী তাঁহার উপযুক্তমত সেবাকর্ম্ম ব্যতীত আর সর্বপ্রকার সম্পর্ক ত্যাগ করিলেন। এখম বাহিরের লোকে তো আর ভিতরের সকল কথা জানিত না। তাহাদের আত্মীয়া স্ত্রীলেকেরা মা ঠাকুরুণের আসিয়া নিজ নিজ আব্দার জানাইত- কন্যা পিতার, ভগ্নী ভ্রাতার, মাতা পুত্রের, এইরূপে সকলেই আপনার লোকের চাকরী করাইয়া দিবার জন্য দিগম্বরী দেবীকে অনুরোধ উপরোধ করত। তাঁহাকেও কাজেই দ্বারকানাথের সহিত এই সকল বিষয়ে কথা কহিতে হইত। শুনিতে পাই যে, যতবার তিনি দ্বারকানাথের সহিত কথা কহিতে বাধ্য হইতেন, ততবারই সাতঘড়া গঙ্গা জলে স্নান করিয়া নিজেকে পরিশুদ্ধ বোধ করিতেন। এ বিষয়ে তাঁহার দিনরাতের বিচার ছিল না।'
শোনা যায় দিগম্বরী দেবীর এই আচারে শীত-গ্রীষ্মে কোনো ব্যতিক্রম হতো না। জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে তাঁর পুত্র ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর, শোকে কাতর হয়ে পড়েন। এই সময় স্বামীর সাথে প্রয়োজনেই কথা বার্তা বলতে হয়েছে। হয়তো একাধিকবার শীতল স্নান করতে হয়েছে। এর ফলে দিগম্বরীর নিউমোনিয়া হয়ে যায় এবং ২১শে জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।
সূত্র:
দ্বারকনাথের জীবনী। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবি জীবনী (প্রথম খণ্ড)। প্রশান্তকুমার পাল