দ্বারকানাথ
ঠাকুর, প্রিন্স
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের প্রপিতামহ।
দেখুন:
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশের ইতিহাস
পিতার নাম রামমণি। ঠাকুর পরিবারের নীলমণির দুই পুত্র রামলোচন ও
রামমণি। রামলোচন অপুত্রক ছিলেন। এই কারণে, তিনি তাঁর রামমণি'র পুত্র দ্বারকানাথকে
দত্তক হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৮০৭
খ্রিষ্টাব্দে তিনি পালকপিতা রামলোচনের নিকট থেকে উইলের মাধ্যমে, বিরাহিমপুর পরগণার
জমিদার-সহ বিপুল সম্পত্তি লাভ করেন। এই সময় রামলোচনের স্ত্রী অলোকা দেবী ও
দ্বারকানাথের আপন বড় ভাই রাধানাথ নাবালক দ্বারকানাথের সম্পত্তি দেখাশোনা করেন।
শৈশবে তৎকালীন রীতি অনুসারে তিনি ফার্সি ও আরবি ভাষা শেখেন। এরপর তিনি কিছুদিন
জোড়াসাঁকোর চিৎপুর রোডের ইংরেজদের পরিচালিত শেরবোর্ণ নামক একটি স্কুলে লেখাপড়া করেন।
এই স্কুলে তাঁর পাঠ্য বিষয় ছিল- 'এনফিল্ড স্পেলিং', 'রিডিং বুক', য়ুনিভার্সেল লেটার
রাইটার', 'কমপ্লিট লেটার বুক', 'রয়্যাল ইংলিশ গ্রামার' ইত্যাদি। এরপর তিনি তাঁর
বন্ধু উইলিয়াম এ্যাডমস্, জেজ জে গর্ডন এবং জেম্স্ প্রমুখের কাছে ইংরেজি শেখেনে।
ইংরেজি শিক্ষা শেষ করার পর, অভিভাবকদের ইচ্ছায় তাঁকে ভারতীয় ও ব্রিটিশ
ভূমিসংক্রান্ত আইন নিয়ে লেখাপড়া করতে হয়। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর তাঁর
দত্তক-পিতা
রামলোচনের মৃত্যু হয়। রামলোচনের সূত্রে দ্বারকানাথ বিষয়সম্পত্তির অধিকার লাভ করেন।
এই সময় দ্বারকানাথ নাবালক ছিলেন বিধায়- এই সম্পত্তি দেখার ভার গ্রহণ করেন
দত্তক-মাতা অলোকাসুন্দরী। এক্ষেত্রে অলোকাসুন্দরীকে বিশেষভাবে সহায়তা করতেন
দ্বারকানাথের বড় ভাই
রাধানাথ।
১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
নরেন্দ্রপুরের রামতনু রায়ের ছয় বছরের কন্যা
দিগম্বরী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়।
আর ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর বিষয়সম্পত্তির ভার গ্রহণ করেন। সম্পত্তি পাওয়ার পর তিনি
ব্যারিস্টার রবার্ট কাট্লার ফার্গুনসন-এর কাছে বিষয়সম্পত্তি সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান
অর্জন করেন।
১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে
রাজা রামমোহন রায়
কলকাতার গরানহাটায় গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। এই সময় তাঁকে
বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন দ্বারকনাথ ঠাকুর। পরে হেদুয়ার কাছে, রামমোহন রায় ইংরেজি
শিক্ষার জন্য একটি এ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় দ্বারকানাথ তাঁর
জ্যেষ্ঠ পুত্র
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর- কে এই
স্কুলে ভর্তি করে দেন।
এছাড়া তাঁর ইংরেজি শিকক্ষ জেজ জে গর্ডন এবং জেম্স্ ম্যাকিন্টস্
এ্যান্ড কোম্পানি'র অংশীদার হন। এঁদের সহায়তায় তিনি ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে
ব্রিটিশ সরকারের চব্বিশপরগণার কালেক্টর বিভাগে সেরেস্তার দায়িত্ব পান। তাঁর কাজে
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা সন্তুষ্ট হয়ে, ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে
নিমকমহলে দেওয়ান পদে নিয়োগ দেন।
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ম্যাকিন্টস্ এ্যান্ড কোম্পানির অংশীদার হন এবং এই কোম্পানির
কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের পরিচালক পদ লাভ করেন।
১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
শুল্ক, লবণ এবং অহিফেন বোর্ডের দেওয়ান পদে উন্নীত হন। এই চাকরিতে কর্মরত অবস্থায়, ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগষ্ট তারিখে, ১৬
লক্ষ টাকা মূলধন নিয়ে নিজে ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারী কাজের জন্য
ব্যাংকটি যথাযথভাবে দেখাশোনা করতে পারতেন না, এই কারণে তিনি তাঁর ছোটো ভাই রমানাথকে
আলিপুরের সেরেস্তার কাজ থেকে ছাড়িয়ে এনে, তাঁর ব্যাংকের কোষাধ্যক্ষ করেন।
১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
রাজশাহী জেলার কালীগ্রামের জমিদারি ক্রয় করেন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই তারিখে
ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের ডিরেক্টর পদ লাভ করেন। এই সময় তিনি কয়েকটি বীমা কোম্পানিরও
পরিচালক ছিলেন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ম্যালিন্টশ ও কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের পতন হয়। এই
কোম্পানির তিনিই একমাত্র ধনবান ব্যক্তি ছিলেন। এই কারণে কোম্পানির সকল দায়ভার
তাঁকেই গ্রহণ করতে হয়। এই বৎসরে এক সনদে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসায়িক
সুবিধা লুপ্ত হয়ে যায়। এই সুযোগে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে তিনি বিরাহিমপুর
পরগণার কুমারখালি মৌজায় স্থাপিত রেশমের কুঠি বাড়ি কিনে নেন।
১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১লা আগষ্ট তিনি সরকারি ছেড়ে দিয়ে তাঁর নিজ ব্যবসায় মনোযোগ দেন। এই বৎসরেই তিনি পাবনার
শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে ক্রয় করেন।
১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কার-টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি
আলেকজান্ডার অ্যান্ড কোম্পানির কয়লা খনিগুলি সত্তর হাজার টাকার বিনিময়ে ক্রয় করে।
এর মধ্য দিয়ে রানিগঞ্জে কয়লা বাণিজ্যে
কার-টেগোর কোম্পানির যুগ শুরু হয়ে। এদের মাধ্যমে
রানিগঞ্জে কয়লাখনির দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে।
এই সমব রানিগঞ্জে ভিন্ন ভিন্ন
মালিকানায় আরও কিছু কয়লাখনি
থেকে কয়লা উত্তোলন শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল
সিয়ারসোল কয়লাখনি। এই কোম্পানিট প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল
১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে। এছাড়া ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে কলকাতায় মেডিকেল
কলেজ স্থাপিত হলে, ইনি ছাত্রদের উৎসাহিত করার জন্য তিন বৎসরের জন্য দুই হাজার টাকা
দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তাঁরই উৎসাহে সংস্কৃত কলেজের আয়ুর্বেদের অধ্যাপক মধুসূদন
গুপ্ত ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ অক্টোবর শব-ব্যবচ্ছেদ করেন। উল্লেখ্য, এটাই ছিল কোন
ভারতীয়ের প্রথম শব-ব্যবচ্ছেদ।
লর্ড বেন্টিকের উদ্যোগে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আভ্যন্তরীণ পরিবহনের জন্য স্টিমার
চলাচলের ব্যবস্থা করেন ১৮৩৪-১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে। এই উদ্যোগের সূত্রে 'স্টিম
ট্যাগ এ্যাসোসিয়েশান' নামক একটি কোম্পানি ১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দে স্টিমার চালু করে।
কার-ঠাকুর কোম্পানি ছিল এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং এজেন্ট। এই
স্টিমারগুলো মেরামতের জন্য কার-ঠাকুর কোম্পানি খিদিরপুরে একটি স্টিমার মেরামতের
কারখানা খোলে। সুয়েজ খালের ভিতর দিয়ে ইংল্যান্ড ও ভারতের ভিতরে জাহাজ চলাচলের
ব্যাপারে দ্বারকানাথ অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। তাঁর নিজের একটি 'ইন্ডিয়া' নামক জাহাজ
ছিল। এই জাহাজে করে তিনি প্রথম ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন।
বিভিন্ন
কয়লাখনিভিত্তিক কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সূত্রে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের
সূত্রপাত ঘটে। এই সূত্রে কোম্পানিগুলোর ভিতরে বাণিজ্যক সংঘাতের
সৃষ্টি হয়। এই অবস্থা নিরসনের জন্য ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে
দ্বারকানাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে
একটি যৌথভাবে কোম্পানি গঠন করা
হয়। কোম্পানির নাম রাখা হয় বেঙ্গল কোল কোম্পানি।
ওই কোম্পানির কেন্দ্রীয় কার্যালয় করা হয় এগারায় কার-টেগোর কোম্পানির নীল কারখানার
কার্যালয়ের ভবনে। এটি ছিল ভারতের কয়লাশিল্পে প্রথম
প্রশাসনিক কার্যালয়। কোম্পানি পরিচালনার জন্য সেই সময়
দ্বারকানাথ ঠাকুর থাকতেন
নারানকুড়ির বাংলোতে। এই কোম্পানি রানিগঞ্জের নারানকুড়ি
ও দামালিয়া ঘাট থেকে
দামোদর নদের জলপথ কয়লা নিয়ে যাওয়া হত
কলকাতায়।
১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের জমিদারদের সংহত করার জন্য
ল্যান্ড-হোল্ডার এ্যাসোসিয়েশান প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের তিনি অন্যতম
পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে তাঁর চতুর্থ পুত্র ভূপেন্দ্রনাথের
মৃত্যু হয়। এর দুই দিন পরে ২১ জানুয়ারিতে তাঁর স্ত্রী
দিগম্বরী দেবী মৃত্যবরণ করেন।
এই মৃত্যুর পর তিনি নিজের অকস্মাৎ মৃত্যু হতে পারে বিবেচনা করে,
১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগষ্টে তিনি তাঁর সন্তান ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ট্রাস্ট
করে দেন।
১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দের ৯
জানুয়ারিতে দ্বারকানাথ তাঁর নিজের ভাগ্নে চন্দ্রমোহনের সাথে প্রথম ইংল্যান্ড যাত্রা করেন।
ধারণা করা হয়, এই যাত্রায় তিনি তাঁর নিজের 'ইন্ডিয়া' নামক জাহাজে গিয়েছিলেন।
ইংল্যান্ডে তাঁকে বিপুলভাবে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। মহারানী ভিক্টোরিয়া স্বয়ং এই
অভ্যর্থনায় যোগ দেন এবং তাঁর অনুমতিক্রমে ইংল্যান্ডের মার্শাল ডিউক অব্ নরফোক তাঁকে
একটি 'আর্মোরিয়াল এনসাইন' দেন। লণ্ডনের মেয়র তাঁকে ভোজসভায় আপ্যায়োত করেন। ১৫
অক্টোবর দ্বারকানাথ ইংল্যান্ড থেকে প্যারিসে যান। সেখানে ফ্রান্সের রাজা লুই ফিলিপ
তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানান।
১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে তিনি কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। এর একবছর পরে
১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগষ্ট তারিখে তিনি পুনরায় একটি উইল করেন। ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের
৮ মার্চ-এ তিনি দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড যান, এই সময় ইংল্যান্ডে ডাক্তারি
পড়ার জন্য চারজন ছাত্রকে সাথে করে নিয়ে যান। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ আগষ্ট তারিখে
লণ্ডনের সারেতে মৃত্যুবরণ করেন।
শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দ্বরকানাথ
বৈষয়িক এ সকল কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি তিনি সে সময়ের পেশাদার সঙ্গীতশিল্পীদের বিশেষ
পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেন। বিশেষ করে বাইজি ও নর্তকীদের তিনি বিশেষভাবে সহায়তা করেছেন। এই
সময় তিনি ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের চর্চা করেছেন। তৎকালীন মঞ্চাভিনয়ের আর্থিক সহায়তা
দিয়েছেন অকুণ্ঠভাবে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে বলতে হয় 'দ্য চৌরঙ্গী থিয়েটার'-এর কথা।
১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে 'চৌরঙ্গী থিয়েটার' আর্থিক সমস্যার মুখোমুখী হলে- এই বছরের
১৫ই আগস্ট তিনি এই থিয়েটার ৩০ হাজার টাকায় কিনে নেন।
ইংরেজদের সাহচর্যে থেকে পাশ্চাত্য সঙ্গীতে তাঁর বিশেষ অনুরাগের সৃষ্টি হয়।
১৮৩৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলকাতায় একটি ইটালিয়ান ভ্রাম্যমান অপেরা দল কলকাতায় আসে।
দ্বারকানাথ এই দলের পৃষ্ঠপোষক হন এবং এই সূত্রে তিনি পাশ্চাত্য অপেরার সম্যক জ্ঞান
অর্জন করেন। বিশেষ করে তিনি এই দলের সদস্য সিনর পিৎসোন্নির বাগদত্তা শার্লৎ-এর কাছে
অপেরার গানের তালিম নেন। পাশ্চাত্য অপেরার সূত্রে তিনি পাশ্চাত্য অভিনয় রীতির
প্রতিও অনুরক্ত হয়ে পড়েন।
সন্তানাদি
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর
(১৮১৭-১৯০৫)
নরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (?)
গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২০-১৮৫৪)
ভূপেন্দ্রনাথ ঠাকুর (?-১৮৩৯)
নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮২৯-১৮৫৮)
সূত্র:
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। প্রথম খণ্ড। সাহিত্য সংসদ। জানুয়ারি ২০০২।
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
রবিজীবনী প্রথম খণ্ড। প্রশান্তকুমার পাল। ভূর্জপত্র। ১ বৈশাখ ১৩৮৯।