দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর

ধর্মবেত্তা, সমাজ ও ধর্ম সংস্কারক।
       
দেখুন: জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বংশের ইতিহাস

১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মে (৩রা জ্যৈষ্ঠ ১২২৪
বঙ্গাব্দ) তারিখে কলকাতার জোড়াসাঁকোস্থ ঠাকুর বাড়ীতে ইনি জন্ম গ্রহণ করেন। এঁর পিতার নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং মাতার নাম ছিল দিগম্বরী দেবী

১৮২৭ সালে তিনি
দ্বারকানাথ ঠাকুর-এর প্রতিষ্ঠিত এ্যাংলো-হিন্দু স্কুলে ভর্তি হন। সম্ভবতঃ এই স্কুলে তিনি ১৮৩০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এই স্কুলে পড়ার সময়– স্কুলের প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রদের নিয়ে 'সর্বতত্ত্বদীপিকা' নামে একটি সভা স্থাপিত হয়েছিল। তিনি এই সভার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। উল্লেখ্য এই সভাতে নির্ধারিত হয়েছিল যে,– সভার সদস্যগণ কেউই বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলবেন না।

এর ভিতরে তিনি ধীরে ধীরে রাজা রামমোহন রায়ের প্রতিষ্ঠিত 'ব্রাহ্মসমাজ'-এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। উল্লেখ্য, ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে
রাজা রামমোহন রায় একেশ্বরের উপাসনার জন্য 'ত্মীয়সভা' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগষ্ট (৬ ভাদ্র, ১২৭৩ বঙ্গাব্দ) তারিখে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ব্রাহ্মসভা গঠিত হয়। প্রথম 'ব্রাহ্মসভা' অনুষ্ঠিত হয়েছিল উত্তর কলকাতায় ফিরিঙ্গি কমল বোসের বাসায়। এই সভা উপলক্ষে আয়োজিত সঙ্গীত ও আলোচনা সভার নামকরণ করা হয়েছিল 'ভাদ্রোৎসব'। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে 'ব্রাহ্মসভা'র সূত্রে স্থাপিত হয় 'ব্রাহ্মসমাজ'।

১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দে বিলেতে
 রাজা রামমোহন ২৭ সেপ্টেম্বরে মেনিনজাইটিস রোগে মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় দ্বারকানাথের র্থানুকূল্যে এই 'আত্মীয় সভা'র কার্যক্রম চলছিল। তখনো ব্রাহ্মধর্মের আদর্শ তাঁকে অনুপ্রাণিত করে নি। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই স্কুল ছেড়ে দ্বারকানাথের  প্রতিষ্ঠিত ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের কোষাধ্যক্ষ রমানাথ ঠাকুরের অধীনে শিক্ষানবীশ হিসাবে যোগদান করেন। এই সময় নানা প্রকার মোদ-প্রমোদের মধ্যেই তাঁর সময় অতিবাহিত হয়েছে। এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর অভিভাবকরা তাঁর বিবাহের ব্যবস্থা করেন। ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে যশোহরের রামনারায়ণ চৌধুরীর কন্যা সারদাসুন্দরী দেবীর সাথে তাঁর বিবাহ হয়।

১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে এঁর পিতামহী অলকাদেবীর মৃত্যুর পর এঁর জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই সময় তিনি ভারতীয় ও ইউরোপীয় ধর্ম ও দর্শনপাঠে
ত্মনিয়োগ করেন। এরপর তিনি সকল ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্য থেকে উপনিষদকে উপযুক্ত গ্রন্থ হিসাবে নির্বাচন করেন। মূলতঃ উপনিষদের চর্চা ও এর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে, তিনি ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই অক্টোবর (২১ই শ্বিন ১২৪৬ বঙ্গাব্দ) তারিখে জোড়সাঁকোর-বাড়ির একটি ছোটো ঘরে দশজন ত্মীয় ও বন্ধু নিয়ে 'তত্ত্বরঞ্জিনী সভা' স্থাপন করেন। এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার চার্য পদ গ্রহণ করলে– চার্য এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন– 'তত্ত্ববোধিনী'।

 

১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখে তাঁর ভাই ভূপেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। এর দুই দিন পরে ২১ জানুয়ারিতে তাঁর মা দিগম্বরী দেবী মৃত্যবরণ করেন। এই দুটি মৃত্যুর পর দ্বারকানাথ নিজের অকস্মাৎ মৃত্যু হতে পারে বিবেচনা করে, ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগষ্টে তিনি তাঁর সন্তান ও তাঁদের উত্তরাধিকারীদের ট্রাস্ট করে দেন। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা' স্থাপন করেন। এই স্কুলটি সেখানে জনসমাদর লাভ না করায়, স্কুলটি বাঁশবেড়িয়া নামক গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য, তিনি ১৮৪২ সালে (বৈশাখ ১৭৬৪ শকাব্দ) তত্ত্ববোধনী সভা'র পরিচালনাভার গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মসমাজের বক্তব্য প্রচারের জন্য ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ডিসেম্বর  'তত্ত্ববোধিনী' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এরপর তিনি তাঁর ২১ জন ত্মীয়-সহ নুষ্ঠানিকভাবে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর অবশিষ্ট ত্মীয়রা এই সময় তাঁকে পরিত্যাগ করেন।

 

১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মার্চ-এ দ্বারকানাথ দ্বিতীয়বার ইংল্যান্ড যান এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ আগষ্ট তারিখে লণ্ডনের সারেতে মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর, তাঁর বহু ঋণ দেবেন্দ্রনাথের কাঁধে এসে পড়ে। এই সময় বাড়িতে অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ প্রতিমা পূজা চালু রেখেছিলেন। সে কারণে দুর্গাপূজা'র সময় তিনি দেশ ভ্রমণে বের হতেন। উল্লেখ্য সে সময় তাঁর সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন তাঁর অপর ভাই গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ভাই গিরীন্দ্রনাথের মত্যু হলে, তিনি তাঁর সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে একত্ববাদ প্রচারের জন্য তিনি কেশবচন্দ্র সেন ‘গুডউইল ফ্যাটার্নিটি’ নামে ছাত্রদের একটি একত্ববাদী ধর্ম সভার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের একটি সভায় তাঁর সাথে প্রথম দেবেন্দ্রনাথের প্রথম দেখা হয়।  দেবেন্দ্রনাথের প্রচারিত ব্রাহ্মসমাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, এই বৎসরে কেশবচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন।

১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় ব্রহ্মবিদ্যালয় স্থাপন করেন। এর কিছুদিন পর ব্রাহ্মসমাজের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম কেশবচন্দ্রের হাতে ন্যাস্ত করেন। পরে ধর্মীয়
দর্শের কারণে  কেশবচন্দ্রের সাথে সংঘাত উপস্থিত হলে –  ব্রাহ্মসমাজ বিভক্ত হয়ে যায়। কেশবচন্দ্রের অনুগামী সমাজের নামকরণ হয় 'ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ', পক্ষান্তরে দেবেন্দ্রনাথের অনুগামী ধর্মের নাম হয়– 'দি ব্রাহ্মসমাজ'। এরপর ধীরে ধীরে তিনি সকল বৈষয়িক ও ধর্মীয় সংঘাত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেন।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জানুয়ারি (৬ই মাঘ ১৩১১
বঙ্গাব্দ) তারিখে ৮৮ বৎসর বয়সে তিনি দেহত্যাগ করেন। এঁর সন্তানের সংখ্যা ছিল ১৫টি। নিচে এর তালিকা দেওয়া হলো।

 

১. কন্যা। শৈশবেই মারা যায়।

২. দ্বিজেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৯ ফাল্গুন, ১২৪৬। মৃত্যু : ৪ মাঘ ১৩৩২। জীবনকাল : ৮৬ বৎসর।

৩. সত্যেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১২৪৯। মৃত্যু : ২৪ পৌষ ১৩২৯। জীবনকাল : ৮১ বৎসর।

৪. হেমেন্দ্রনাথ। জন্ম : ০৮ মাঘ, ১২৫০।  মৃত্যু : ২১ জ্যৈষ্ঠ ১২৯১। জীবনকাল : ৮০ বৎসর।

৫. বীরেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৭ কার্তিক, ১২৫২। মৃত্যু : ১৩২২। জীবনকাল : ৭০ বৎসর।

৬. সৌদামিনী। জন্ম : ১২৫৪। মৃত্যু : ৩০ শ্রাবণ ১৩২৭। জীবনকাল : ৭৩ বৎসর।

৭. জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জন্ম : ২২ বৈশাখ, ১২৫৬। মৃত্যু : ফাল্গুন ১৩৩১। জীবনকাল : ৭৬ বৎসর।

৮. সুকুমারী। জন্ম : ১২৫৭। মৃত্যু : জ্যৈষ্ঠ ১২৭১। জীবনকাল : ১৪ বৎসর।

৯. পুণ্যেন্দ্রনাথ। জন্ম : ১২৫৮। মৃত্যু : ১২৬৪। জীবনকাল : ৬ বৎসর।

১০. শরত্কুমারী। জন্ম : ১২৬১। মৃত্যু : ১০ ষাঢ় ১৩২৭। জীবনকাল : ৬৬ বৎসর।

১১. স্বর্ণকুমারী। জন্ম : ১৪ ভাদ্র, ১২৬৩। মৃত্যু : ১৯ অষাঢ় ১৩৩৯। জীবনকাল : ৭৬ বৎসর।

১২. বর্ণকুমারী। জন্ম : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ। মৃত্যু : ৩ নভেম্বর ১৯৪৮। জীবনকাল : ৯১ বৎসর।

১৩. সোমেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৯ ভাদ্র, ১২৬৬। মৃত্যু : ১৬ মাঘ ১৩২৮। জীবনকাল : ৬২ বৎসর।

১৪. রবীন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৫ বৈশাখ। ১২৬৮। মৃত্যু : ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮। জীবনকাল : ৮০ বৎসর।

১৫. বুধেন্দ্রনাথ। জন্ম : ১৮৬৩। মৃত্যু ১৮৬৪। জীবনকাল : এক বৎসর।