তত্ত্ববোধিনী

 

তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের মুখপত্র হিসাবে এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন।

উপনিষদের চর্চা ও এর বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই অক্টোবর (২১ই শ্বিন ১২৪৬ বঙ্গাব্দ, ১৭৬১ শকাব্দ) তারিখে জোড়সাঁকোর-বাড়ির একটি ছোটো ঘরে দশজন ত্মীয় ও বন্ধু নিয়ে 'তত্ত্বরঞ্জিনী সভা' স্থাপন করেন। এই সভার দ্বিতীয় অধিবেশনে ৬ অক্টোবর রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ সভার চার্য পদ গ্রহণ করলে– চার্য এই নাম পরিবর্তন করে রাখেন– 'তত্ত্ববোধিনী'। পরের বছর ১২৪৭ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সভার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৫৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটে একটি বাড়ি ভাড়া করেন। তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্দেশ্য ছিল 'উপনিষদ ও বেদ' ভিত্তিক ধর্মালোচনা। এই সময় তিনি ব্রাহ্মমত প্রচারের জন্য তিনি তিনটি উপায় নির্ধারণ করেন। উপায় তিনটি হলো

১. বিদ্যালয় স্থাপন। যার মাধ্যমে উপনিষদ পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা হবে। এই সূত্রে হুগলি জেলার বাঁশবেড়িয়া-তে একটি 'তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা' স্থাপিত হয়। অবশ্য এই পাঠাশালা

২. বেদের অভ্রান্ততা বিচারের জন্য বিচারক তৈরি করা। বিচারক তৈরির জন্য চারজন ব্যক্তিকে কাশীতে পাঠানো হয়। এই চারজন ব্যক্তি ছিলেন আনন্দচন্দ্র ভট্টাচার্য, তারকানাথ ভট্টাচার্য, বাণেশ্বর ভট্টাচার্য এবং রমানাথ ভট্টাচার্য।

৩. ধর্মমত প্রচারের জন্য পত্রিকা প্রকাশ। এই সূত্রে পরে 'তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকার প্রকাশ ঘটে।


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আত্মজীবনীতে এই পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে লিখেছেন-

"আমি, ভাবিলাম তত্ত্ববোধিনী সভার অনেক সভ্য কার্য্যসূত্রে পরস্পর বিচ্ছিন্নভাবে আছেন। তাঁহারা সভার কোন সংবাদই পান না, অনেক সময় উপস্থিত হইতেও পারেন না। সভায় কি হয় অনেকেই তাহা অবগত নহেন। বিশেষতঃ ব্রাহ্মসমাজে বিদ্যাবাগীশের ব্যাখ্যান অনেকেই শুনিতে পান; তাহার প্রচার হওয়া আবশ্যক। আর রামমোহন রায় জীবদ্দশায় ব্রহ্মজ্ঞান বিস্তার উদ্দেশ্যে যে সকল গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, তাহারও প্রচার আবশ্যক। এতদ্ব্যতীত, যে সকল  বিষয়ে লোকের জ্ঞান বৃদ্ধি ও চরিত্র শোধনের সহায়তা করিতে পারে, এমন সকল বিষয়ও প্রকাশ হওয়া আবশ্যক। আমি এইরূপ চিন্তা করিয়া ১৭৬৫ শকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রচারের সংকল্প করি"

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক তালিকা

অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮৪৩-১৮৫৫)
নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৫-১৮৫৯)
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (ডিসেম্বর ১৮৫৯-মার্চ ১৮৬২)
অজ্ঞাত (১৮৬২-১৮৬৫)
অযোধ্যানাথ পাকড়াশী (১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৫- এপ্রিল ১৮৬৭)
সীতানাথ ঘোষ (১৮৭২-?)
হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮৭৭-১৮৮৪)
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৪-১৯০৮)
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯০৯-১৯১১)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১১-১৯১৫)
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৫-১৯২৩)
ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২৩-১৯৩৭)

১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগষ্ট (১৭৬৫ শকাব্দ, ১ ভাদ্র)-এ এই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। এর চারমাস পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন।
 

পত্রিকাটি ছিল মাসিক, এবং এর প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ইনি এই পত্রিকার সম্পাদক পদ থেকে ইস্তফা দেন। এরপর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তির সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে। পরবর্তীকালের সম্পাদকরা ছিলেন- সত্যেনন্দ্র্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, হেমচন্দ্রবিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত।

 


সূত্র :