সারদাসুন্দরী দেবী
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
স্ত্রী এবং
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর
মা।
তাঁর অপর নাম: শাকম্ভরী।
তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু জানা যায় না। তাঁর পিতা
রামনারায়ণ চৌধুরী
ছিলেন যশোর জেলার দক্ষিণডিহি'র
অধিবাসী।
১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁর পুত্রবধূ জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর ‘স্মৃতিকথা’ থেকে জানা যায়, এই সময় সারদাসুন্দরীর বয়স ছিল ছয়। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তাঁর ‘স্মৃতিকথা’-য় লিখেছেন–
তাঁর [সারদাসুন্দরী দেবীর] এক কাকা কলকাতায় শুনেছিলেন যে, আমার শ্বশুরমশায়ের জন্য সুন্দরী মেয়ে খোঁজা হচ্ছে। তিনি দেশে এসে আমার শাশুড়িকে (তিনি তখন ছয় বৎসরের মেয়ে) কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিয়ে দিয়ে দিলেন। তখন তাঁর মা বাড়ী ছিলেন না – গঙ্গা নাইতে গিয়েছিলেন। বাড়ী এসে মেয়েকে তাঁর দেওর না বলে-কয়ে নিয়ে গেছে শুনে তিনি উঠোনের এক গাছতলায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলেন। তারপর সেখানে পড়ে কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয়ে মারা গেলেন।
সাংসারিক ব্যাপারেও কিছুটা উদাসীন ছিলেন সারদাসুন্দরী। এমনিতে সংসারের কজাকর্ম তেমন করতেন না। তবে দেবেন্দ্রনাথ বাড়িতে থাকলে নিজে রান্না করতেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর স্মতিকথা থেকে জানা যায়
“আমার শাশুড়ীর একটু স্থূল শরীর ছিল, তাই বেশি নড়াচড়া করতে পারতেন না।” মহর্ষি বাড়ি থাকলে রান্নাঘরে যেতেন। উপাসনার সময় মহর্ষির কাছে গিয়ে বসতেন। জ্ঞানদানন্দিনীর লেখা থেকে আরও জানা যায়, “আমার মনে পড়ে বাবামশায় [দেবেন্দ্রনাথ] যখন বাড়ী থাকতেন আমার শাশুড়িকে একটু রাত করে ডেকে পাঠাতেন, ছেলেরা সব শুতে গেলে। আর মা একখানি ধোয়া সূতি শাড়ি পরতেন, তারপর একটু আতর মাখতেন; এই ছিল তাঁর রাতের সাজ।”
সারদাসুন্দরী দেবী যখন বৌ হয়ে ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করেন, তখন শাশুড়ি দিগম্বরী দেবী ও দিদি শাশুড়ি অলকা দেবী জীবিত ছিলেন। উভয়ই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপ্রাণা। এর প্রভাব পড়েছিল সারদাসুন্দরীর উপর। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করার পর ঠাকুর বাড়ি থেকে জগদ্ধাত্রী পূজা তুলে দেন। দেবেন্দ্রনাথের সেজ ভাই গিরীন্দ্রনাথ গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার সেবার ভার গ্রহণ করে পৃথক হয়ে যান। এই সময় পরিবারের অন্যান্যদের মতোই সারদাদেবী ধর্মীয় সঙ্কটে পড়ে যান। শাশুড়ি দিগম্বরী দেবী ও দিদি শাশুড়ি অলকা দেবী'র শিক্ষায়, যে ধর্মবোধ তাঁর সত্তার গভীরে মিশে গিয়েছিল, তাকে বিসর্জন দেওয়াটা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর মতো অত গভীরভাবে উপনিষদকে জেনে বুঝে গ্রহণ করতে পারেন নি। কিন্তু স্বামীর বিরুদ্ধাচারণও করেন নি। তাঁর ৩৫ বৎসর বয়সে স্বামীর মতানুবর্ত্তিনী হয়ে ধর্মত্যাগ ত্যাগ করলেন। তিনি স্বামীর পাশাপাশি বসে ব্রহ্মার আরাধনা করতেন, তাঁর ধর্মব্যাখ্যা শ্রদ্ধার সাথে শুনতেন। আবার বহুদিনের অভ্যাসের কারণে কখনো কখনো রমানাথ ঠাকুরের দুর্গোৎসবের পূজক কেনারাম শিরোমণির হাতে কালীঘাটে ও তারকেশ্বরে পূজা পাঠাতেন। এটা অবশ্য তিনি স্বামীর অজ্ঞাতে করতেন।
মূলত সারদাদেবী ছিলেন সেকালের পতিপরায়ণা আদর্শ স্ত্রী। কন্যা সৌদামিনী, তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন
“মা আমার সতীসাধ্বী পতিপরায়ণা ছিলেন। পিতা সর্বদাই বিদেশে কাটাইতেন এই কারণে সর্বদাই তিনি চিন্তিত হইয়া থাকিতেন। পূজার সময় কোনোমতেই পিতা বাড়িতে থাকিতেন না। এইজন্য পূজার উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না। তখন নির্জন ঘরে তিনি একলা বসিয়া থাকিতেন। কাকীমারা আসিয়া তাঁকে কত সাধ্য সাধনা করিতেন, তিনি বাহির হইতেন না। গ্রহাচার্যরা স্বস্ত্যয়নাদির দ্বারা পিতার সর্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার কাছ হইতে সর্বদাই যে কত অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।”
স্বামীর মতকে মেনে নিলেও, তৎকালীন রক্ষণশীলতা থেকে মুক্ত হতে পারেন নি। সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রী-স্বাধীনতার পক্ষপাতী ছিলেন বলে, তিনি ছেলেকে ধমকিয়েছেন। বিশেষ করে গড়ের মাঠে স্ত্রীর বেড়াতে নিয়ে যাওয়াটাকে তিনি মোটেই মেনে নিতে পারেন নি।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে পিতা যে ভাবে শৈশবকে প্রভাবিত করেছিল, মায়ের প্রভাব ছিল না। মায়ের নামে তিনি তাঁর গ্রন্থ উৎসর্গও করেন নি। এর অন্যতম কারণ ছিল, তিনি সন্তানদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে পারতেন না। রবীন্দ্রনাথও সেই অর্থের যথাযথ মাতৃ-পরিচর্চা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তবে মাতৃস্নেহ থেকে একেবারে বঞ্চিত ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথের সাথের মায়ের মধুর সম্পর্কের কথা জানতে পারি তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে থেকে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন
"পৃথিবীসুদ্ধ লোকে কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ পড়িয়া জীবন কাটায়, আর আমি পিতার কাছে স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির স্বরচিত অনুষ্টুভ ছন্দের রামায়ণ পড়িয়া আসিয়াছি, এই খবরটাতে মাকে সকলের চেয়ে বেশি বিচলিত করিতে পারিয়াছিলাম। তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়া বলিলেন, “আচ্ছা, বাছা, সেই রামায়ণ আমাদের একটু পড়িয়া শোনা দেখি।”
হায়, একে ঋজুপাঠের সামান্য উদ্ধৃত অংশ, তাহার মধ্যে আবার আমার পড়া অতি অল্পই, তাহাও পড়িতে গিয়া দেখি মাঝে মাঝে অনেকখানি অংশ বিস্মৃতিবশত অস্পষ্ট হইয়া আসিয়াছে। কিন্তু যে-মা পুত্রের বিদ্যাবুদ্ধির অসামান্যতা অনুভব করিয়া আনন্দসম্ভোগ করিবার জন্য উৎসুক হইয়া বসিয়াছেন, তাঁহাকে “ভুলিয়া গেছি” বলিবার মতো শক্তি আমার ছিল না। সুতরাং ঋজুপাঠ হইতে যেটুকু পড়িয়া গেলাম তাহার মধ্যে বাল্মীকির রচনা ও আমার ব্যাখ্যার মধ্যে অনেকটা পরিমাণে অসামঞ্জস্য রহিয়া গেল। স্বর্গ হইতে করুণহৃদয় মহর্ষি বাল্মীকি নিশ্চয়ই জননীর নিকট খ্যাতিপ্রত্যাশী অর্বাচীন বালকের সেই অপরাধ সকৌতুক স্নেহহাস্যে মার্জনা করিয়াছেন, কিন্তু দর্পহারী মধুসূদন আমাকে সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি দিলেন না।
মা মনে করিলেন, আমার দ্বারা অসাধ্যসাধন হইয়াছে, তাই আর সকলকে বিস্মিত করিয়া দিবার অভিপ্রায়ে তিনি কহিলেন, “একবার দ্বিজেন্দ্রকে শোনা দেখি।” তখন মনে-মনে সমূহ বিপদ গনিয়া প্রচুর আপত্তি করিলাম। মা কোনোমতেই শুনিলেন না। বড়দাদাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। বড়দাদা আসিতেই কহিলেন, “রবি কেমন বাল্মীকির রামায়ণ পড়িতে শিখিয়াছে একবার শোন্-না।” পড়িতেই হইল। দয়ালু মধুসূদন তাঁহার দর্পহারিত্বের একটু আভাসমাত্র দিয়া আমাকে এ-যাত্রা ছাড়িয়া দিলেন। বড়দাদা বোধ হয় কোনো-একটা রচনায় নিযুক্ত ছিলেন- বাংলা ব্যাখ্যা শুনিবার জন্য তিনি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করিলেন না। গুটিকয়েক শ্লোক শুনিয়াই “বেশ হইয়াছে” বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।"
দেবেন্দ্রনাথ ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর এস্টেট’-এ
সারদাসুন্দরী দেবীর নামে ২৪,৭০০ টাকা দিয়ে একটি ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খুলে
দিয়েছিলেন।এর উপরে ব্যক্তিগত মাসোহারা ছাড়াও কন্যা ও জামাতাদের মাসোহারাও
‘সারদাসুন্দরী দেবী’ খাতে যেতো।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই মার্চ সারদাসুন্দরী দেবীর মৃত্যু হয়।
সারদাদেবী ও দেবেন্দ্রনাথের সন্তানাদি
১. কন্যা। শৈশবেই মারা যায়।
২. দ্বিজেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৯ ফাল্গুন, ১২৪৬। মৃত্যু : ৪ মাঘ ১৩৩২। জীবনকাল : ৮৬ বৎসর।
৩. সত্যেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২০ জ্যৈষ্ঠ, ১২৪৯। মৃত্যু : ২৪ পৌষ ১৩২৯। জীবনকাল : ৮১ বৎসর।
৪. হেমেন্দ্রনাথ। জন্ম : ০৮ মাঘ, ১২৫০। মৃত্যু : ২১ জ্যৈষ্ঠ ১২৯১। জীবনকাল : ৮০ বৎসর।
৫. বীরেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৭ কার্তিক, ১২৫২। মৃত্যু : ১৩২২। জীবনকাল : ৭০ বৎসর।
৬. সৌদামিনী। জন্ম : ১২৫৪। মৃত্যু : ৩০ শ্রাবণ ১৩২৭। জীবনকাল : ৭৩ বৎসর।
৭. জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জন্ম : ২২ বৈশাখ, ১২৫৬। মৃত্যু : ফাল্গুন ১৩৩১। জীবনকাল : ৭৬ বৎসর।
৮. সুকুমারী। জন্ম : ১২৫৭। মৃত্যু : জ্যৈষ্ঠ ১২৭১। জীবনকাল : ১৪ বৎসর।
৯. পুন্যেণ্দ্রনাথ। জন্ম : ১২৫৮। মৃত্যু : ১২৬৪। জীবনকাল : ৬ বৎসর।
১০. শরত্কুমারী। জন্ম : ১২৬১। মৃত্যু : ১০ আষাঢ় ১৩২৭। জীবনকাল : ৬৬ বৎসর।
১১. স্বর্ণকুমারী। জন্ম : ১৪ ভাদ্র, ১২৬৩। মৃত্যু : ১৯ অষাঢ় ১৩৩৯। জীবনকাল : ৭৬ বৎসর।
১২. বর্ণকুমারী। জন্ম : ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ। মৃত্যু : ৩ নভেম্বর ১৯৪৮। জীবনকাল : ৯১ বৎসর।
১৩. সোমেন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৯ ভাদ্র, ১২৬৬। মৃত্যু : ১৬ মাঘ ১৩২৮। জীবনকাল : ৬২ বৎসর।
১৪. রবীন্দ্রনাথ। জন্ম : ২৫ বৈশাখ। ১২৬৮। মৃত্যু : ২২ শ্রাবণ, ১৩৪৮। জীবনকাল : ৮০ বৎসর।
১৫. বুধেন্দ্রনাথ। জন্ম : ১৮৬৩। মৃত্যু ১৮৬৪। জীবনকাল : এক বৎসর।