স্বর্ণকুমারী দেবী
কবি, উপন্যাসিক এবং সমাজসেবিকা।

১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ আগষ্ট [বৃহস্পতিবার, ১৪ ভাদ্র, ১২৬৩ বঙ্গাব্দ] কলকাতার জোড়সাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।  দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ কন্যা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় বোন। মায়ের নাম সারদা দেবী

তৎকালীন ঠাকুর পরিবারের রীতি অনুসারে, তিনি শৈশবে ঘরেই লেখাপড়া শেখেন। স্বর্ণকুমারী দেবীর স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়, তাঁদের শিক্ষয়িত্রী শ্লেটে কিছু লিখে দিতেন, সেই লেখাটিই তাঁরা টুকে লিখতেন। দেবেন্দ্রনাথ এ কথা জানতে পেরেই এই শিক্ষাদান পদ্ধতিটি তুলে দেন। এর পরিবর্তে তিনি অযোধ্যানাথ পাকড়াশি নামে এক দক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ করে মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করেন। পরে স্বর্ণকুমারী নিজ চেষ্টায় স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেন।

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর [২ অগ্রহায়ণ, ১২৭৪ খ্রিষ্টাব্দে], জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে স্বর্ণকুমারী দেবীর বিবাহ হয়। উল্লেখ্য জানকীনাথ ছিলেন নদিয়া জেলার এক জমিদার পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবার ছিল পিরালী থাকভুক্ত ব্রাহ্মণ। পিরালী ব্রাহ্মণ বংশের কন্যাকে বিবাহ করার জন্য জানকীনাথ পরিবারচ্যূত হয়েছিলেন। জানকীনাথ পরে ব্যবসা করে সাফল্য অর্জন করেন এবং নিজস্ব এক জমিদারি গড়ে তুলে "রাজা" উপাধি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন একজন দিব্যজ্ঞানবাদী (থিওজফিস্ট) এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।

বিবাহের পর স্বর্ণময়ীকে লেখাপড়ায় বিশেষভাবে তাঁর স্বামী সাহায্য করায়, তিনি নানা ধরনের বিষয় পড়ার সুযোগ লাভ করেন।

১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৫ ডিসেম্বর [১২৭৫ বঙ্গাব্দ ২১ অগ্রহায়ণ] তাঁর প্রথম কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর জন্ম হয়। এই সন্তান জন্মগ্রহণের পর, তাঁর শ্বশুড় তাঁকে এবং তাঁর কন্যাকে আশীর্বাদ করেন এবং এর দ্বারা জানকীনাথের সাথে তাঁর পিতার সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়।
১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল এবং ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ সেপ্টেম্বর [২৫ ভাদ্র, ১২৭৯ বঙ্গাব্দ],
সরলা দেবী'র জন্ম হয়। সর্বশেষ কন্যা উর্মিলা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে।

ভারতী পত্রিকার পৌষ ১২৮৬ সংখ্যা থেকে তাঁর প্রথম উপন্যাস ছিন্নমুকুল ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়।

১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ কার্তিক (৪ নভেম্বর ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম বাংলা গীতিনাট্য (অপেরা) বসন্ত উৎসব প্রকাশিত হয় । ৩১ ডিসেম্বর [১৭ পৌষ] তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা ঊর্মিল দেবী মারা যান।
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ঠাকুর পারিবার থেকে পত্রিকা ভারতী নামক মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ২০-২১ এপ্রিল (৯-১০ বৈশাখ),
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর স্ত্রী কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। এই কারণে ভারতী পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর আগেই ভারতী'র বৈশাখ ১২৯১ সংখ্যার প্রায় অর্ধেকটা ছাপা হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণে বাকি অংশ-সহ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর সম্পাদনায়। তবে পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ যুগ্নসংখ্যা হিসাবে। এরপর থেকে তাঁর সম্পাদনায় পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বাংলাদেশে থিয়োসফিক্যাল সোসাইটির মহিলা সংগঠন গড়ে উঠেছিল। এই সংগঠনের শুরু থেকেই স্বর্ণকুমারী দেবী জড়িত ছিলেন। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই সংগঠনের সভানেত্রী নির্বাচিত হন।
নানাবিধ কারণে  এই অধ্যাত্ম-দর্শন চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সমিতির কার্যক্রম শিথিল হয়ে পড়ে। এরপর ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম নারীবাদী সংগঠন 'সখি সমিতি' গড়ে তোলেন । স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী মতে- এই 'সখি-সমিতি' নামটি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই বৎসরের ২৯ ডিসেম্বর [১৫ পৌষ ১২৮৫ বঙ্গাব্দ] কলকাতার বেথুন কলেজ প্রাঙ্গণে এই সমিতির উদ্যোগে মহিলা শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয়।  ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর [১৫ পৌষ ১২৯৫ বঙ্গাব্দ] কলকাতার বেথুন কলেজ প্রাঙ্গণে এই সমিতির উদ্যোগে মহিলা শিল্পমেলা অনুষ্ঠিত হয়।

স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি নিজেও সামাজিক সংস্কার ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দর কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় বোম্বাইতে। এই সভায় স্বর্ণকুমারী দেবী অংশগ্রহণ করেন।

১৩০২ বঙ্গাব্দ [১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ]-এ স্বর্ণকুমারী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই কারণে তিনি ভারতীর সম্পাদকে পদ ত্যাগ করেন। ভারতীর বৈশাখ ১৩০২ সংখ্যা থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন  স্বর্ণকুমারী দেবী'র দুই কন্যা হিরন্ময়ী দেবী ও সরলা দেবী। এরপর মাঝখানে রবীন্দ্রনাথ এক বৎসর (১৩০৫ বঙ্গাব্দ) পত্রিকটি সম্পাদনা করার পর, সরলা দেবী এই পত্রিকার দায়িত্ব নেন। সরলা দেবীর বিবাহের পর ১৩১৪ বঙ্গাব্দে পত্রিকাটি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।  ১৩১৪ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ্য মাসে সরলাদেবী পাঞ্জাব থেকে কলকাতায় এসে পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব সৌরিন্দ্রমোহনের হাতে অর্পণ করেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে ১৩১৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর পত্রিকাটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। ১৯১৫ বঙ্গাব্দের [১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দ] বৈশাখ মাস থেকে স্বর্ণকুমারী দেবীর সম্পাদনায় পুনরায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে।

১৩২০ বঙ্গাব্দের ১৯ বৈশাখ [২ মে ১৯১৪], স্বর্ণকুমারী দেবীর স্বামী জানকীনাথ ঘোষাল মৃত্যুবরণ করেন।
১৩২১ বঙ্গাব্দে তিনি ভারতী পত্রিকার সম্পাদনা পদ ত্যাগ করেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জুলাই মৃত্যবরণ করেন।



রচনাবলি
উপন্যাস:
দীপনির্বাণ (১৮৭৬)
মিবার-রাজ (১৮৭৭)
ছিন্নমুকুল (১৮৭৯)
মালতী (১৮৭৯)
হুগলীর ইমামবাড়ী (১৮৮৭)
বিদ্রোহ (১৮৯০)
স্নেহলতা (১৮৯২)
কাহাকে (১৮৯৮)
ফুলের মালা (১৮৯৫)
বিচিত্রা (১৯২০)
স্বপ্নবাণী (১৯২১)
মিলনরাতি (১৯২৫)
সাব্বিরের দিন রাত [১৯১২]

নাটক:
বিবাহ-উৎসব (১৮৯২)
রাজকন্যা
দিব্যকমল।

কাব্যগ্রন্থ:
গাথা
বসন্ত-উৎসব
গীতিগুচ্ছ।

বিজ্ঞান-বিষয়ক প্রবন্ধ:
পৃথিবী।[১৮৮২]

 


তথ্যসূত্র:
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান
রবিজীবনী
(১-৯ খণ্ড)। প্রশান্তকুমার পাল