সখি সমিতি
প্রথম বাঙালি নারীবাদী সংগঠন। এর উদ্যোগক্তা
ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় বোন স্বর্ণকুমারী দেবী।
১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে অধ্যাত্ম-দর্শন বিষয়ক একটি নারী-সংগঠন তৈরি হয়েছিল। এর
সভানেত্রী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড় বোন
স্বর্ণকুমারী দেবী। এই সময় যে সব নারীদের
স্বামীরা অধ্যাত্ম-দর্শনের অনুরাগী ছিলেন, তাঁরা স্বর্ণকুমারীর কাশিয়াবাগানের
বাড়িতে যাতায়াত করতেন এবং তাঁদের অনেকেই এই সমিতির সখিত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নারীর
অধিকার নিয়ে সখিদের ভিতরে আলোচনার সূত্রে একটি প্রস্তাব পাশ হয়। এই প্রস্তাবটি
ভারতী পত্রিকা বৈশাখ ১২৯২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর শিরোনাম ছিল 'একটি
প্রস্তাব' [ভারতী
১২৯২। পৃষ্ঠা : ১৪-২৪]। এর পরের বৎসর এই সমিতির আরো একটি প্রস্তাব
ভারতী ও বালক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই প্রস্তবটির নাম ছিল- আর একটি
প্রস্তাব। [ভারতী
ও বালক ১২৯৩। পৃষ্ঠা ২০-২১]।
নানাবিধ কারণে অধ্যাত্ম-দর্শন চর্চার জন্য প্রতিষ্ঠিত এই সমিতির কার্যক্রম শিথিল হয়ে পড়ে। এরপর ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বর্ণকুমারী দেবী প্রথম নারীবাদী সংগঠন 'সখি সমিতি' গড়ে তোলেন । স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যা সরলা দেবী মতে- এই 'সখি-সমিতি' নামটি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সখি-সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল―
১. অসহায় অনাথ ও বিধবাদের সহায়তা করা।
২. ধর্ষিতা নারীদের পাশে দাঁড়ানো, তাঁদের আইনগত সাহায্য প্রদান।
৩. স্ত্রীশিক্ষার প্রসার ঘটানো।
৪. হিন্দু বিধবারা
হিন্দুধর্মের অনুমোদনক্রমেই শ্রমদানের মাধ্যমে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠবেন।
৫. আত্মরক্ষার জন্য নারীদের
লাঠি চালনা এবং আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ।
৬. ভারতীয় মহিলাদের
উৎপন্ন পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা।
সংগঠন পরিচালনা কেবলমাত্র সদস্যদের চাঁদায় সম্ভব নয় অনুভব করে, স্বর্ণকুমারী দেবীর বেথুন কলেজে একটি বার্ষিক মেলার আয়োজন করেন। এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল― ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর [১৫ পৌষ ১২৯৫ বঙ্গাব্দ], কলকাতার বেথুন কলেজ প্রাঙ্গণে । এই মেলায় ঢাকা ও শান্তিপুরের শাড়ি, কৃষ্ণনগর ও বীরভূমের হস্তশিল্প এবং বহির্বঙ্গের কাশ্মীর, মোরাদাবাদ, বারাণসী, আগ্রা, জয়পুর ও বোম্বাইয়ের হস্তশিল্প প্রদর্শিত হয়।
এই সমিতিটি দুঃস্থা নারীদের নানাভাবে সাহায্য করতোএবং তাঁদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য নানা উদ্যোগ নিতো। এই কার্যক্রমের বিষয় ছিল— নিরক্ষর নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলা, ধর্ষিতা বা অন্যভাবে অত্যাচারিতা নারীদের আইনী সাহায্য দেওয়া, নারী অধিকারসমূহের বিষয়ে নারীদেরকে জানিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এছাড়া আত্মরক্ষার জন্য নারীদের লাঠি চালনা এবং আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এই সমিতি করেছিল। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে মুম্বাইতে ভারতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে এই সংগঠন থেকে ৬ জন নারী অংশগ্রহণ করেছিলেন।
১৯০৬ সাল পর্যন্ত সখিসমিতি সক্রিয় ছিল।
এররপর হিরন্ময়ী দেবী বিধবা আশ্রয় এর
দায়িত্বভার গ্রহণ করে। পরে হিরন্ময়ী দেবীর আদর্শে
অনুপ্রাণিত হয়ে শশিপদ বন্দ্যোপাধ্যায় বরানগরে একটি বিধবা আশ্রম চালু করেন। এই
আশ্রমের নাম ছিল "মহিলা বিধবা আশ্রম"। হিরন্ময়ী দেবীর মৃত্যুর পর এই আশ্রমটিরই
নতুন নামকরণ হয় "হিরন্ময়ী বিধবা আশ্রম"। মহিলা বিধবা আশ্রমের প্রতিষ্ঠাকালীন
কার্যনির্বাহী সমিতিতে ছিলেন স্বর্ণকুমারী, ময়ূরভঞ্জের মহারানি সুচারু দেবী,
কোচবিহারের মহারানি সুনীতি দেবী (উভয়েই ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা), লেডি
হ্যামিলটন, প্রিয়ংবদা দেবী, শ্রীমতী চ্যাপম্যান ও শ্রীমতী সিংহ। হিরন্ময়ী দেবী
ছিলেন আশ্রমের সচিব। হিরন্ময়ী দেবীর কন্যা তথা আশ্রমের পরিচালিকা কল্যাণী মল্লিকের
লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই আশ্রম সফলভাবে চালু ছিল। এরপর এর
কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
সূত্র :
রবিজীবনী দ্বিতীয় খণ্ড। ১ বৈশাখ ১৩৯৪
ভারতী
বৈশাখ
১২৯২।
ভারতী ও বালক
বৈশাখ,
১২৯৩