১৭৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মে -তে
হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম ছিল রামকান্ত
রায়। তাঁর বংশগত পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত
ফারুখশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কার্য করতেন। ধারণা করা
হয়, সেই সূত্রেই এই পরিবার 'রায়' পদবী পেয়েছিলেন।
উল্লেখ্য কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ ছিলেন রামমোহনের পিতামহ।
রামকান্ত তিনটি বিবাহ করেছিলেন। মধ্যমা পত্নী তারিণীর এক কন্যা ও দুই
পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। এঁরা ছিলেন জগমোহন ও রামমোহন। এঁদের বংশ ছিল
বৈষ্ণব, কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘোর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা।
রামমোহন পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানাস্থানে ঘোরেন।
রামমোহনের সংস্কৃতে বুৎপত্তি, তাঁর বেদান্তে অনুরাগ নন্দকুমারের
সহযোগিতায় হয়েছিল।
১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দে রামকান্ত পৈত্রিক এজমালি ভদ্রাসন ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে স্ব-পরিবারে উঠে যান। ১৭৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পৈতৃক অন্যান্য সূত্রে কিছু জমি, বাগান এবং কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়ির মালিকানা লাভ করেন। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই জুলাই তারিখে তিনি কিছু তালুক ক্রয় করেন। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতা এবং ভাই জগমোহন জমিদারি ঝামেলায় পড়েন এবং উভয়ের জেল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে রামমোহন এই ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছিলেন।
১৮০৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ কালেক্টর উড্ফোর্ডের দেওয়ান হিসাবে নিষুক্ত হন এবং যশোহরে বদলি হয়ে চলে যান। এর কিছুদিন পর মুর্শিদাবাদ যান। এখান থেকে তাঁর একেশ্বরবাদ-বিষয় আরবি ও ফার্সি ভাষায় 'তুহ্ফাৎ উল মুবাহ্হিদ্দীন' প্রকাশিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে আত্মসম্মান বজায় রেখে চাকরি করা
তাঁর জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে ফ্রেডরিক হ্যামিল্টনের সাথে তাঁর
কর্মক্ষেত্রে সংঘর্ষ হয়। ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লর্ড মিন্টোর
কাছে লিখিত আকারে প্রতিবাদ জানান। ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম জীবনের
শিক্ষক হরিহরানন্দের কাছে হিন্দু শাস্ত্র ও দর্শনের পাঠ নেন। এরপর তিনি
১৮১৪ খ্রিষ্টাব্দে রংপুরের কালেক্টর অফিসের সেরেস্তার কাজে স্তফা দেন এবং ইনি কলকাতায়
ফিরে এসে চৌরঙ্গী ও মানিকতলায়
বাড়ি কেনেন। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমদিকে তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস
শুরু করেন। এই সময় তিনি
কালী মীর্জা'র
কাছে কিছুদিন রাগসঙ্গীতের তালিম নেন।
বিস্তর পড়ালেখার সূত্রে তিনি ক্রমে ক্রমে একেশ্বরবাদী হয়ে উঠেন। যে সকল
উপনিষদ ও বেদান্তসূত্র একশ্বেরবাদ সমর্থন করে, সেগুলোর প্রচারণ শুরু
করেন। ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি বেদান্তগ্রন্থ,
বেদান্তসার, কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মাণ্ডূক্যোপনিষদ ও
মুণ্ডকোপনিষদ বাংলা অনুবাদসহ প্রকাশ করেন। এর ফলে রক্ষণশীল ব্যক্তিরা
ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁর লেখার প্রতিবাদ করতে থাকেন। এই সকল প্রতিবাদ ছিল
কটুক্তিপূর্ণ এবং বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। কিন্তু রামমোহন এসবের প্রতিবাদ
করতেন যুক্তি দিয়ে ও ভদ্রভাষায়। প্রতিবাদ-কর্তাদের মধ্যে প্রথম ও
প্রধান ছিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, এঁর গ্রন্থের নাম
'বেদান্তচন্দ্রিকা'। বেদান্তচন্দ্রিকা'র প্রতিবাদে রামমোহন
ভট্টাচার্যের তীব্রভাবে প্রতিবাদ করেছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের
শুরুতে, ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ১১৩, সারকুলার রোডস্থ ভবনে প্রতিষ্ঠা করেন 'আত্মীয় সভা'।
এই সময় দ্বারকানাথ ঘোরতর পৌত্তালিক হওয়া সত্ত্বেও রামমোহনকে আর্থিক
সাহায্য দিয়ে গেছেন। যতদূর জানা যায় তিনি প্রথম ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা করেন
১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। গানটি হলো- 'কে ভুলালো হায়'।
১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দের তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র গোবিন্দদাস, রামমোহনের
সম্পত্তির অংশ দাবী করে। এই সংক্রান্ত মোকদ্দমার কারণে তিনি ব্যস্ত
থাকায়, নিয়মিতভাবে 'আত্মীয় সভা' চালাতে পারেন নি। এর ভিতরে তিনি
১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে কলকাতার গরানহাটায়
গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে
হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। এই সময় তাঁকে
বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন
প্রিন্স
দ্বারকনাথ ঠাকুর। পরে তিনি হেদু্য়ার কাছে ইংরেজি শিক্ষার জন্য একটি
এ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সব মিলিয়ে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দে
'আত্মীয় সভা' বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর তিনি খ্রিষ্টধর্মের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোকপাত করতে থাকেন। তিনি যিশুকে অবতার হিসাবে মান্য করাটা অযৌক্তিক মনে করেন। তবে তাঁর উপদেশকে চর্চার প্রতি খ্রিষ্টানদের বলেন। ফলে খ্রিষ্টান পাদরিদের সাথে বিরোধ করেন। কিন্তু যুক্তির অকাট্যাতায় মুগ্ধ হয়ে পাদরি উইলিয়ম এ্যাডাম তাঁর দলভুক্ত হন। এই প্রেক্ষিতে তিনি তিনটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা তিনটি হলো - ১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি-বাংলা দ্বিভাষিক ব্রহ্মনিক্যাল ম্যাগাজিন ব্রাহ্মণ সেবধি, বাংলা ভাষায় সম্বাদ কৌমুদি, এবং ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ফার্সি প্রকাশিত মীরাৎ-উল-আখ্বার।
১৮২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
ইউনিটোরিয়ান কমিটি নামে ধর্মসভা স্থাপন করেন। পত্রিকার স্বাধীনতা হরণের
প্রতিবাদে তিনি মীরাৎ-উল-আখ্বার বন্ধ করে দেন। ১৮২৩
খ্রিষ্টাব্দের ১১ ডিসেম্বরে তিনি নিজ খরচে এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্কুল
স্থাপন করেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে ২০ আগষ্ট তারিখে বিশিষ্ট
ব্যক্তিদের নিয়ে ব্রাহ্মসভা গঠিত হয়। উল্লেখ্য, উত্তর কলকাতায় ফিরিঙ্গি
কমল বোসের বাসায় প্রথম 'ব্রাহ্ম সভা' অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ব্রাহ্মধর্মের
অঙ্গ হিসেবে বাংলা সঙ্গীতজগতে একটি নতুন ধারার সূচনা করেন।
ব্রহ্মের
উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই গান বর্তমানে
ব্রহ্মসঙ্গীত নামে
পরিচিত। সম্ভবত তিনি যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে বর্ণিত 'ব্রহ্মগীতি' বা
'ব্রহ্মগীতিকা' নামক একপ্রকার সাধনসঙ্গীত থেকে এই নাম গ্রহণ করেছিলেন।
১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে
ব্রহ্মসঙ্গীত নামক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য এটিই ছিল
ব্রহ্মসঙ্গীতের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এই গ্রন্থে, তাঁর এবং
অন্যান্যদের রচিত গান গৃহীত হয়েছিল।
হিন্দু সমাজে প্রচলিত সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে ইনি
সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনের সূত্রে ১৮২৯ খ্রিষ্টাব্দের ৪
ডিসেম্বরে লর্ড সতীদাহ প্রথা আইন দ্বারা বিলোপ করেন।
দিল্লীর বাদশাহ তাঁকে রাজদরবারে বাদশাহের ভাতা বৃদ্ধির সুপারিশের জন্য
ইংল্যাণ্ডে পাঠান। এই সময় সম্রাট তাঁকে 'রাজা' উপাধি প্রদান করেন। সেই
থেকে তিন 'রাজা রামমোহন রায়' অভিহিত হয়ে থাকেন। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯
নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৮
এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে
কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। সেখানে ফরাসি সম্রাট লুই
ফিলিপ কর্তৃক তিনি সংবর্ধিত হন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ইংল্যান্ডের
ব্রিস্টলে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ সেপ্টেম্বরে
মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৮ দিন জ্বরে ভুগে মৃত্যবরণ
করেন। তাঁর মৃত্যুর দশ বৎসর পর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর 'আনসার ডেল' নামক
স্থানে তাঁর সমাধিস্থ করে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেন। ১৯৯৭
খ্রিষ্টাব্দে মধ্য ব্রিস্টলে তার একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।