ব্রহ্ম
বানান বিশ্লেষণ:ব্+র্+অ+ম্+হ+অ।
উচ্চারণ:
brom.ɦo (ব্রোম্.হো)
শব্দ-উৎস: সংস্কৃত ব্রহ্ম> বাংলা ব্রহ্ম
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: বৃন্‌হ(দীপ্তি পাওয়া) + মন্ (মনিন্), কর্তৃবাচ্য, ন স্থানে অ।
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা { | পরমসত্তা | অতিপ্রাকৃতিক সত্তা | বিশ্বাস | প্রজ্ঞা | জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা | বিমূর্তন | বিমূর্ত-সত্তা | সত্তা | }
অর্থ: জগৎ যাঁর দ্বারা দীপ্ত হয় এই অর্থ- ব্রহ্ম

হিন্দু ধর্মীয়
র্শনে, ব্রহ্ম হলেন
পরমেশ্বর, সগুণ ঈশ্বর এই সত্তার যে সকল গুণাবলি বিভিন্ন উপনিষদে পাওয়া যায়, তা বাইবেলের সদাপ্রভু বা কোরআনের আল্লাহর সমতুল্য। যেমন

১. এক, অদ্বিতীয় দেব সর্বভূতে প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিত আছেন। তিনি সর্বব্যাপী, সর্বভূতের অন্তরস্থিত আত্মা, কর্মাধ্যক্ষ, সর্বভূতের নিবাসস্থান, সর্বদ্রষ্টা, চেতয়িতা নিরুপাধিক ও নির্গুণ। /১৩। তৃতীয় অধ্যায়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ।

২. এই জগতে তাহার কোনো প্রভু নাই, নিয়ন্তাও কেহ নাই। এমন কোনও লিঙ্গ বা চিহ্ন নাই, যাহা দ্বারা অনুমান করা চলে।
/। তৃতীয় অধ্যায়। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদ।

৪.
তিনি সর্বত্র গিয়াছেন, তিনি জ্যোতির্ময়, অশরীরী, ক্ষতরহিত, স্নায়ুহীন, শুদ্ধ ও অপাপবিদ্ধ। তিনি সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ, সর্বোপরি বিদ্যমান এবং স্বয়ম্ভূ। তিনি নিত্যকাল ব্যাপীয়া লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে বিষয়সমূহের বিধান করিয়াছেন। ॥ ৮। ঈশ উপনিষদ।

৫. ব্রহ্ম এক এবং গতিহীন হয়েও মন অপেক্ষা অধিকতর বেগবান, দেবতা বা ইন্দ্রিয়সকল এঁকে পান না, কারণ ইনি সবার আগে গমন করেন। ব্রহ্ম বা আত্মা সকল শক্তিকে অতিক্রম করে যান, এই ব্রহ্মে অধিষ্ঠিত থেকে প্রাণশক্তি জগতের সমস্ত শক্তিকে ধারণ করেন। ৪। ঈশ উপনিষদ।

সব মিলিয়ে উপনিষদের আলোকে ব্রহ্ম সম্পর্কে যে সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়, তা হলো–
১. ব্রহ্ম হচ্ছেন এক এবং অদ্বিতীয় সত্তা।
২. এই ঈশ্বর দ্বারা এই চলমান বিশ্বচরাচর আচ্ছাদিত। ৩. তিনি নিজ দশা থেকে পরিবর্তিত হন না। এই কারণে ঈশ উপনিষদে এঁকে অনেজৎ বা অকম্প (ন এজৎ [কম্পিত হওয়া]) বলা হয়েছে। এবং অচল হয়েও ইনি প্রচণ্ড বেগবান। এই প্রবল গতিময়তার জন্যই তিনি বেগবান।
৪. তিনি দূরে, নিকটে, সবার অন্তরে আছেন। সর্বত্র আছেন বলেই বলেই তিনি সর্বত্র বিরাজমান এবং প্রবল গতিকে অনুসরণ করে উপলব্ধ করা যায় না বলেই তাঁকে অচল মনে হয় এবং সর্বত্র আছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
৫. তিনি জ্যোতির্ময় এবং অশরীরী। অশরীরী শব্দটি আত্মার স্বরূপ অর্থে উপস্থান করা হয়েছে। এই কারণে ব্রহ্ম সাধারণ পার্থিব দৃষ্টি ক্ষমতার বিচারে অদৃশ্য।
৬. তিনি বিপুল। কারণ তিনি এতই বিস্তৃত যে, মন বা কল্পনা দিয়েও তাঁকে উপলব্ধি করা যায় না।
৭. তিনি একই সাথে প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত। কারণ সকল কিছুর ভিতর দিয়ে ব্রহ্ম প্রকাশমান বলেই তিনি স্পষ্ট। তাই শুধু দৃশ্যমান বস্তু, শব্দময় সত্তা ভাবনার দ্বারা জ্ঞাত বিষয় দিয়ে ব্রহ্মকে উপলব্ধির চেষ্টা করা যায় মাত্র,কিন্তু পূর্ণব্রহ্মকে চেনা যায় না। কিছু উপলব্ধির দ্বারা আবেশিত হয়ে অনেকেই ব্রহ্মকে চেনার ধাঁধায় পড়ে যান। তিনি কেন উপনিষদের দ্বিতীয় খণ্ডের ৩ সংখ্যক শ্লোকে এ বিষয়ে বলা হয়েছে- জ্ঞানবান ব্যক্তির কাছে তিনি অবিজ্ঞাত এবং জ্ঞানহীনের কাছে তিনি জ্ঞাত।
৮. তিনি অক্ষয়। কারণ তিনি ক্ষতরহিত এবং ক্ষয় নাই। তাই তাঁর বিনাশ নাই। উপনিষদে তাই তাঁকে অব্যয়, অক্ষয়, অক্ষর প্রভৃতি নামে পাওয়া যায়।
৯. তিনি পরম আরাধ্য,তাই তিনি অর্হ।
উপনিষদের বিচারে ব্রহ্মের প্রার্থনাসূচক ধ্বনি হলো– ওম। পূজারীরা যে অর্থে বা উদ্দেশ্যেই এই ধ্বনি উচ্চারণ করেন, তা ব্রহ্মের স্মরণকে বুঝায়। তিনি আধ্যাত্মিক,আধিদৈবিক, আধিভৌতিক দুঃখের অতীত।
ব্রহ্ম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমুদয় উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। এই সৃষ্টির আদিতে তিনি প্রথমে একজন সৃষ্টির দেবতা তৈরি করলেন। এই দেবতাকে উপনিষদে উল্লেখ করা হয়েছে- ব্রহ্মা নামে। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের ১৮ সংখ্যক শ্লোকে বলা হয়েছে– যিনি সৃষ্টির প্রথমে ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করিয়াছেন, যিনি তাঁহার উদ্দেশ্যে বেদবিদ্যা প্রেরণ করিয়াছেন, আত্মবিষয়ক বুদ্ধির প্রকাশময় সেই পরমেশ্বরের নিকট মুক্তিকামী আমি শরণাপন্ন হইয়াছি। মহাভারতের মতে–প্রথমতঃ এই বিশ্বসংসার কেবল ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত ছিল। অনন্তর সমস্ত বস্তুর বীজভূত এক অণ্ড প্রসূত হইল। ঐ অণ্ডে অনাদি, অনন্ত, অচিন্তনীয়, অনির্ব্বচনীয়, সত্যস্বরূপ, নিরাকার, নির্ব্বিকার, জ্যোতির্ময় ব্রহ্মা প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ঐ অণ্ডে ভগবান্ প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করিলেন। [সৃষ্টিবর্ণন, অনুক্রমণিকাধ্যায়, আদিপর্ব, মহাভারত]

পরে প্রজাপতি ব্রহ্মা ব্রহ্মের নির্দেশেই বিশ্বচরাচরের সকল কিছু তৈরি করেন অন্য দিকে ব্রহ্ম থেকে অন্যান্য দেবতারা উৎপন্ন হন, এবং জগতের কল্যাণের জন্য এঁরা নিয়োগ পান। দেবতাদের অনেকেই ব্রহ্মার স্বরূপ জানতেন না। তাই নিজেদের ক্ষমতায় অত্যন্ত গর্বিত ছিলেন। এই প্রসঙ্গে ঈষোপনিষদের তৃতীয়-চতুর্থ খণ্ডে এই বিষয়ের একটি বিবরণ আছে। একবার দেবতাদের গৌরব বৃদ্ধির জন্য ব্রহ্মা অসুরদের বিরুদ্ধে দেবতাদের জয়ী করেন। যুদ্ধ জয়ের পরে, দেবতারা নিজেদের ক্ষমতাকে বড় করে দেখা শুরু করলেন। ব্রহ্ম এই বিষয়টি উপলব্ধি করে, যক্ষের রূপ ধরে দেবতাদের সম্মুখে আবির্ভূত হন। দেবতারা বিস্মিত হয়ে একে একে যক্ষের পরিচয় নেওয়ার জন্য যান। এই যাত্রায় প্রথমে যান অগ্নি। ব্রহ্ম অগ্নির ক্ষমতা জানতে ইচ্ছা করলে, অগ্ন জানান- আমি প্রসিদ্ধ দেবতা অগ্নি, আমি জাতবেদা (যিনি সৃষ্ট সকল পদার্থকে জানেন, এক অর্থে সর্বজ্ঞ)। এছাড়া অগ্নি জানান যে, তিন সকল পদার্থ দগ্ধ করতে পারেন। ব্রহ্ম অগ্নির সামনে এক টুকরা তৃণ রেখে তা দগ্ধ করার জন্য বলেন। অগ্নি বহু চেষ্টা করে, তা দগ্ধ করতে পারলেন না। এরপর বায়ুকে তাঁর ক্ষমতা দেখাতে বললে, তিনি একখণ্ড তৃণকে উড়াতে পারলেন না। ইন্দ্র আত্মগর্ব ত্যাগ করে, তাঁর কাছে গেলে, তিনি অন্তর্হিত হন। পরে উমা রূপিণী বিবেক-বুদ্ধির সাহায্যে ইন্দ্র উপলব্ধি করেন যে, ব্রহ্মই সকল শক্তির উৎস।

কঠ উপনিষদের প্রথম অধ্যায়েরর দ্বিতীয় বল্লরীর ৪৪ সংখ্যক শ্লোকে ব্রহ্মের স্বরূপকে সংক্ষেপে 'ওম' প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ৪৫ সংখ্যক শ্লোকে উল্লেখ আছে- 'এই অক্ষরটি (ওঙ্কার) সর্বগত ব্রহ্ম, এই অক্ষরটিই (ওঙ্কার) সর্বাতীত ব্রহ্ম, এই অক্ষরটিকে (ওঙ্কারকে) জানিয়া যে যাহা চায় সে তাহাই পায়।'

বিষ্ণুপুরাণের প্রথম অংশের দ্বিতীয় অধ্যায়ে সকলের ঈশ্বর বলা হয়েছে। তিনি হিরণ্যগর্ভরূপে জগতের সৃষ্টি, বিষ্ণুরূপে পালন এবং শঙ্কররূপে সংহার করেন।