দিলীপ কুমার রায়
(১৮৯৬-১৯৮০)
সঙ্গীতজ্ঞ।

১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জানুয়ারিতে ভারতের পশ্চিম বাংলার নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। এঁর পিতা ছিলেন বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। মায়ের নাম সুরবালা দেবী। তাঁর একমাত্র বোনের নাম মায়া দেবী।
১৯০৩ খ্রিষ্টব্দে তিনি মাতৃহীন হন।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মাতামহ বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের কাছে প্রতিপালিত হন। কিশোর বয়সে দিলীপকুমার সঙ্গীতজ্ঞ বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখন্ডের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন।

দিলীপকুমারের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ হলে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অঙ্কে প্রথম শ্রেণিতে অনার্সসহ বি,এ পাস করেন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লেখাপড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অঙ্কে ট্রাইপসের প্রথম ভাগ পাস করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গণিতে-এ ট্রাপোস প্রথম ভাগ পাশ করেন।  ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতে ফিরে আসেন।

বিলেতে থাকার সময় তিনি পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সাথে পরিচিত হন। এই সময় তিনি পিয়ানো বাজানো শিখেছিলেন। তিনি ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের সংমিশ্রণে একটি নতুন ঢং-এর গানের প্রবর্তন করেন। যা ‘দৈলিপী ঢং’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে বাবা দ্বিজেন্দ্রলালের গানের স্বরলিপি প্রকাশ করে তার ভূমিকায় দিলীপকুমার লিখেছিলেন, 'স্বরলিপি দেখে গান শিক্ষা সম্বন্ধে আমার একটা কথা বলবার আছে। সেটা এই, যে কোনো গানের মধ্যে রসসঞ্চার করতে হলে শুষ্ক হুবহু অনুকরণে হয় না। কোনো গানকে প্রাণে মূর্ত করে তুলতে হলে তাকে নিজের সৌন্দর্য অনুভূতি অনুসারে একটু আধটু বদলে নিতেই হয়।” দিলীপকুমার গানকে নিজের মতন করে ভেঙে-গড়ে নেওয়ার জন্য তাতে মিশিয়েছিলেন কীর্তনের আখর রীতি। এই সময় তিনি অতুলপ্রসাদ ও নজরুল ইসলামের গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে জার্মান ও ইতালীয় সঙ্গীত শেখার জন্য বার্লিন যান। বিদেশে থাকাকালীন তিনি পিয়ানো শেখার পাশাপাশি ফ্রেঞ্চ, জার্মান এবং ইতালীয় ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন৷ বিদেশে থাকার সময় দিলীপ কুমারের সাক্ষাৎ হয় রোমা রোল্যাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, হারমান হেসের সঙ্গে। তিনি সুইজ়ারল্যান্ডের লুনাগোতে আমন্ত্রিত হয়ে ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে বক্তৃতা দিতে গেছিলেন।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর  দিলীপকুমার রায়, ইউরোপ ভ্রমণ শেষে কলকাতায় ফিরে আসেন। ২৮ ডিসেম্বর (২৯ অগ্রহায়ণ ১৩৩৪) কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্‌স্টিটিউট হলে তাঁকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠানে দিলীপকুমার রায়ের উদ্দেশ্যে নজরুল তাঁর স্বরচিত কবিতা 'সুরের দুলাল' পাঠ করেন। পরে এই কবিতাটিতে সুররোপ করে গানে পরিণত করেন। কলকাতায় থেকে পড়াশোনাকালীন দিলীপ কুমার হিন্দুস্তানী ওস্তাদি সঙ্গীতের প্রতি মুগ্ধ হন। পদাবলী সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল খগেন্দ্রনাখ মিত্র ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু। খগেন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণাতেই দিলীপ রায় কীর্তন গানে আকৃষ্ট হন এবং তাঁর অনুপ্রেরণাতেই নবদ্বীপচন্দ্র ব্রজবাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।  দেশে ফিরে আসার পর তিনি আবদুল করিম খাঁ, ফয়েজ খাঁ, পণ্ডিত ভাতখণ্ডে প্রমুখ ওস্তাদের কাছে রাগ সঙ্গীতের তালিম গ্রহণ করেন।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় মার্গ সঙ্গীতে পারদর্শিতা লাভের জন্য সারা ভারত ভ্রমণ করেন। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে সঙ্গীত সন্বন্ধে বক্তৃতা করতে ইউরোপ যান।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অরবিন্দের পণ্ডিচেরী আশ্রমে বসবাস করেন। এই সময়, সঙ্গীতের ন্যায় যোগসাধনাও তাঁর জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ, নজরুল, হিমাংশু দত্ত, নিশিকান্ত প্রমুখ গীতিকারের গান স্বকণ্ঠে গেয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরের অনড় রীতি ভেঙে তাতে একটা বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে অনুমতি মেলে নি বলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া ছেড়ে দেন।

তাঁর গানের রেকর্ড সংখ্যা প্রায় একশ। ভারত সরকার কর্তৃক প্রেরিত সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইউরোপের বহু দেশসহ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও মিশরে সঙ্গীতের উপর বক্তৃতা দান করেন। দেশে ফিরে বন্ধু জি, ভি, মেহতার আমন্ত্রণে পুণায় গিয়ে তাঁর গৃহে বাস করতে থাকেন। ক্রমে সে বাসগৃহটি তাঁর চেষ্টায় শ্রীহরিকৃষ্ণ মন্দিরে পরিণত হয়। সেখানে তিনি সন্ন্যাসীর ন্যায় জীবন যাপন করতেন।

আধুনিক সঙ্গীতের সমালোচনার অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো– অঘটনের শোভাযাত্রা, অনামী, নন্দ ও জলাতঙ্ক, বার ভ্রাম্যমাণ, আমার বন্ধু সুভাষ, আশ্চর্য, উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল, গীতমঞ্জরী, গীতসাগর, ছায়ার আলো, তরঙ্গ রোধিবে কে, তীর্থঙ্কর, দুধারা, দোলা, দ্বিচারিণী, দ্বিজেন্দ্রগীতি, পত্রাবলী, বহুবল্লভ, ভাগবতী কথা, ভিখারিণী, ভূস্বর্গ চঞ্চল, ভ্রাম্যমাণের দিনপঞ্জিকা, মধুমুরলী, মনের পরশ, রঙের পরশ, রাজকন্যা, সাদা কালো, সাঙ্গীতিকী, সুরবাহার, হাসির গানের স্বরলিপি ইত্যাদি।

তিনি সঙ্গীত রত্নাকর উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে সঙ্গীত নাটক একাডেমীর সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ৭ই জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

তাঁর রচিত গ্রন্থ