দীনেশ গুপ্ত
১৯১১-১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই ডিসেম্বর (২০ অগ্রহায়ণ ১৩১৮ বঙ্গাব্দ) তদনীন্তন ঢাকা জেলার (অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মুন্সিগঞ্জ জেলা) যশোলঙে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সতীশচন্দ্র গুপ্ত ও মায়ের নাম বিনোদিনী দেবী। দীনেশ গুপ্তের ডাকনাম ছিল নসু। চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান।

তাঁর পিতা সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের চাকরির সূত্রে সতীশচন্দ্র গৌরীপুরে আসেন। এই সময় দীনেশ গৌরীপুরের 'জমিদারের ঠাকুর দালানের পাঠশালায় ' ভর্তি হন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি ঢাকার গ্যান্ডারিয়াতে দাদুর বাড়িতে থাকতে আসেন এবং  ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এই সময় ঢাকার ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের সাথে গোপনে কাজ করতে থাকেন। পরে তিনি দীনেশ বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স (বিভি)-এর সদস্য হন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

ম্যাট্রিক পাশ করার পর, তিনি মেদিনীপুরে কর্মরত তাঁর বড়োদাদা যতীশচন্দ্র গুপ্তের কাছে বেড়াতে আসেন। এখানে এসে স্থানীয় বিপ্লবীদের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধীদের বিচ্ছিন্ন অবস্থা দেখে, তিনি একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। মেদেনীপুরে এই কাজে কিছুটা অগ্রসর হলেও,   কিন্তু বিপ্লবী দলের নেতার নির্দেশে তিনি সেবার তাঁকে ঢাকায় ফিরে আসেন।  হয়েছিল বলে তিনি মেদিনীপুরে বিশেষ কিছুই পরে উঠতে পারেননি।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকে আইএসসি পরীক্ষা দিলেও, সংগঠনের কাজে বেশি সময় দিতে গিয়ে, পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেন নি। এরপর তাঁর পরিবারের লোকেরা তাঁকে মেদিনীপুরে গিয়ে পড়াশোনা করার ব্যবস্থা করেন। তিনি এখানে এসে মেদেনীপুর কলেজে ভর্তি হন। এই সময় দলের পক্ষ থেকে তাঁকে মেদিনীপুরে বিভির শাখা স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেদিনীপুরে এসে দল সংগঠন ও সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান তিনি। কলেজের কাছাকাছি একটি বাড়িতে তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স এর শাখা স্থাপন করতে তিনি উদ্যোগী হন। সে সময় মেদিনীপুরে বড়বাজারে অভয় আশ্রম নামের একটি দেশীয় পোশাকের দোকান ছিল। এছাড়া তিলক পাঠাগার নামক একটি গ্রন্থাগারে প্রচুর দেশপ্রেম মূলক বইপত্র আসতো। বিপ্লবী মতাদর্শে বিশ্বাসী কিশোর যুবকরা ভিড় জমাতেন সেখানে। দীনেশ গুপ্ত দলের সদস্য সংগ্রহৈর জন্য ওই পাঠাগারে নিয়মিত যাতায়াত শুরু করেন। মেদেনীপুর শহরের বল্লভপুর মহল্লায় একটি আখড়া বানিয়ে তিনি দেহচর্চার কাজও শুরু করেছিলেন। মেদিনীপুর কলেজ থেকে আই এ পাস করে পুনরায় ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন বি এ পড়ার জন্য ভর্তি হন।

সে সময় রায় কোম্পানি নামে একটি মদের দোকান ছিল ঢাকার রায়পুরে। একদিন স্বদেশীরা দোকানের সামনে রাস্তা অবরোধ করলে, পুলিস সুপার হডসন তার বাহিনী নিয়ে উপস্থিত হয় এবং ‍বিক্ষোভকারীদের মারধর শুরু করে। এই সময় সাইকেলে চেপে আসেন এবং রক্তাক্ত কর্মীদের দেখে অত্যন্ত উত্তেজিত স্বরে হডসনকে বলেন 'এদের মারধর করা আপনার এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে না।' শোনামাত্রই সাহেব রিভলভার তাক করে। অসীম সাহসী দীনেশ এ‍‌গিয়ে এসে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় বন্দুকের নলের সামনে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অস্ত্র খাপবদ্ধ করে হাডসন ফিরে যায়।

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে সুপতি রায় কলকাতা থেকে 'বাংলার গভর্নরের ওপর নেপাল নাগ ও দীনেশ গুপ্ত আক্রমণ চালাবে এমন নির্দেশ পাঠান। পরে সে প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এবং নেতারা রাইটার্স অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। সেসময় বিপ্লবীদের উপর অত্যাচার করার জন্য, জেলের ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসনের কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। এই কারণে বিপ্লবীরা সিম্পসনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। একই সাথে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় রাইটার্স ভবনে আক্রমণ করার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়।

এই সুত্রে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ৮ই ডিসেম্বর দীনেশ তাঁর দুই সঙ্গী বিনয় বসু এবং বাদল গুপ্ত-সহ ইউরোপীয় পোশাকে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করেন এবং সিম্পসনকে গুলি করে হত্যা করেন। রাইটার্স বিল্ডিং-এর কে কোথায় বসে, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবী প্রফুল্ল দত্ত । এইসময় অপর বিপ্লবী জীতেন সেন ডালহৌসির দিঘির ধারে অপেক্ষায় ছিলেন। গুলির আওয়াজ পেলেই তিনি চলে যাবেন আলিপুর চিড়িয়াখানার নির্দিষ্ট স্থানে। যেখানে রসময় শূর ও আরও কয়েকজন বিপ্লবী অপেক্ষা করছেন। এরা প্রথমে সিম্পসনের ঘরে ঢুকে তাকে হত্যা করে। এই সময় গুলির শব্দ শুনে বিচার বিভাগের সেক্রেটারি নেলসনের দরজার বাইরে উঁকি দিলে, বিপ্লবীরা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। নেলসনের পায়ে গুলি লাগে। এরপর বিপ্লবীরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বারান্দা দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন। এই সময় এদের গুলিতে আহত হয় বাংলা সরকারের প্রধান সেক্রেটারি টাউসেন্ড, অ্যালবিয়ান, প্রেস্টিস। চার্লস টেগার্ট, মিস্টার গর্ডন, মিস্টার বার্ট বিরাট পুলিস বাহিনী নিয়ে হাজির হয়। সেই সাথে যোগদান করে গোর্খা বাহিনী।  

এক সময় এদের গুলি ফুরিয়ে গেলে, বিপ্লবীরা একটা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। জীবন্ত ধরা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে বাদল পটাশিয়াম সায়ানাইড খায়। কিন্তু বিষে যদি প্রাণ না যায়, সেই ভেবে একই সাথে রিভলভার দিয়ে গলার নিচে গুলি করে। তার আগে দীনেশ জ্ঞান হারিয়েছে। তিনিও বিষপান করেছেন, গুলি চালিয়েছেন নিজের দেহে। অন্যদিকে বিনয় এবং দিনেশ নিজেদের রিভলবার দিয়ে পরস্পরের মাথায় গুলি করেন। পুলিশ আহত অবস্থায় বিনয়কে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ডিসেম্বরের ১৩ই ডিসেম্বর বিনয় মৃত্যুবরণ করেন। দীনেশ আঘাত থেকে বেঁচে ওঠেন। সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং খুনের জন্য অভিযুক্ত করে পুলিশ মামলা করে। বিচারে আদালত ফাঁসির আদেশ দেয়।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই জুন আলিপুর কারাগার থেকে তাঁর বৌদিকে চিঠিতে লিখেছিলেন-
'ভারতবাসী আমরা নাকি বড় ধর্মপ্রবণ। ধর্মের নামে ভক্তিতে আমাদের পণ্ডিতদের টিকি খাড়া হইয়া উঠে। তবে আমাদের মরণের এত ভয় কেন? বলি, ধর্ম কি আছে আমাদের দেশে? যে দেশে দশ বছরের মেয়েকে পঞ্চাশ বৎসরের বৃদ্ধ ধর্মের নামে বিবাহ করিতে পারে, সে দেশে ধর্ম কোথায়? সে দেশের ধর্মের মুখে আগুন। যে দেশে মানুষকে স্পর্শ করিলে মানুষের ধর্ম নষ্ট হয়, যে দেশের ধর্ম আজই গঙ্গার জলে বিসর্জন দিয়া নিশ্চিন্ত হওয়া উচিত। সবার চাইতে বড় ধর্ম মানুষের বিবেক। সেই বিবেককে উপেক্ষা করিয়া আমরা ধর্মের নামে অধর্মের স্রোতে গা ভাসাইয়া দিয়াছি। একটা তুচ্ছ গোরুর জন্য, না হয় একটু ঢাকের বাদ্য শুনিয়া আমরা ভাই ভাই খুনোখুনি করিয়া মরিতেছি। এতে কি ভগবান আমাদের জন্য বৈকুণ্ঠের দ্বার খুলিয়া রাখিবেন, না খোদা বেহস্তে আমাদিগকে স্থান দিবেন?'
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই জুলাই আলিপুর কারাগারে ফাঁসির দণ্ড যখন কার্যকর করা হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ডালহৌসি স্কয়ারের নাম পালটে রাখা হয়, বিবাদী বাগ (বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ)।
সূত্র: