পারশ্যের সুফিবাদী কবি।
ইমাম
গাজ্জালির
অনুসরণে তিনি সুফিবাদী গজল রচনা করেছেলেন। তবে প্রথম পরিশীলিত রুবাই রচনার পথ
দেখিয়েছিলেন তিনি। এর নমুনা পাওয়া যায়, তাঁর উৎকৃষ্ট রুবাই-সংকলন মোখতার নামা-তে।
রহস্যময় কবিতা রচনার জন্যও বিখ্যাত। গজল বা রুবাই রচয়িতার চেয়ে বাংলাদেশ তাঁকে
সুফিবাদী আউলিয়া হিসেবে শ্রদ্ধা করা হয়।
তাঁর পূর্ণ নাম আবু হামিদ বিন আবু বাকর ইব্রাহিম। ফারিদ উদ-দিন নামে সর্বাধিক
পরিচিত।
তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। ইরানের বিখ্যাত
পণ্ডিত ফোরুযানফারের গবেষণায় তিনি উল্লেখ করেছেন, আত্তার ১১৫২ খ্রিষ্টাব্দে নিশাপুরের কাদকান শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১২৮২ খ্রিস্টাব্দে মোঙ্গল সৈনিকের হাতে নিহত হন। অপর দিকে ইরানের খ্যাতিমান সাহিত্য-ইতিহাসবিদ সাইদ নাফিসির বর্ণনা মতে, তিনি ৫৩৭ হিজরি মোতাবেক ১১৪৩
খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
তবে অধিকাংশ গবেষকদের মতে- তিনি ১১৪৫-৪৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
তাঁর জন্মের সময় তাতারদের হত্যাযজ্ঞে সমগ্র পারস্য এক বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছিল।
প্রাচীন ইরানী জীবনীগ্রন্থাদিতে তাঁর পিতার নাম পাওয়া যায় মাহমুদ ইবরাহিম বিন ইসহাক। কোনো কোনো গ্রন্থে তাঁর পিতার নাম ইউসুফ বলেও উল্লেখ পাওয়া যায়।
তাঁর পিতার পেশা ছিল
ঔষধ বিক্রয়।
পিতার মৃত্যুর পর তিনি পিতার পেশাকেই বেছে নিয়েছিলেন।
অল্প বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফিক্হ, তাফসির, চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি বিদ্যায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন এবং পৈত্রিক পেশা হিসেবে ‘আত্তারি’ অর্থাৎ ভেষজ চিকিৎসা এবং সুগন্ধি বিক্রয়ের পেশাকেই স্বীয় পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। সে কারণেই তিনি
নিজের নামের চেয়ে তাঁর পেশাগত উপাধি ‘আত্তার’ (ভেষজ চিকিৎসক বা সুগন্ধি বিক্রেতা) নামেই সমধিক পরিচিত
ছিলেন।
১৭ বছর বয়স পর্যন্ত নিশাপুরের প্রাচীন শহরেই কাটান এবং মৃত্যুর আগের বাকি জীবন তিনি নিশাপুরের নতুন শহর ‘শাদইয়াখ’-এ অতিবাহিত করেন।
চিকিৎসাবিদ্যায় তিনি এতটাই সুনাম অর্জন করেন যে, বহু দূর
দূরান্ত থেকে তার বাড়ি তথা চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগীরা এসে ভিড় করত। তাঁর সুফি
সাধনার আগ্রহ সৃষ্টির পিছনে নানা ধরনের গল্প প্রচলিত আছে। এর ভিতরে-
এগুলোর মধ্যে আব্দুর রহমান জামীর বর্ণনাই সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। জামী তাঁর নাফাহাতুল উন্স্ গ্রন্থে
লিখেছেন- একদিন ফরিদউদ্দিন তাঁর চিকিৎসাকেন্দ্রে রোগী দেখায় ব্যস্ত ছিলেন। এমন সময় সেখান দিয়ে এক দরবেশ যাচ্ছিলেন।
তিনি বেশ ক’বার ‘শাইউল্লাহ’ ‘শাইউল্লাহ’ বলে আত্তারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ব্যর্থ হন।
এরপর দরবেশ বললেন, ‘হে খাজা, তুমি কীভাবে মৃত্যু কামনা কর?’ জবাবে আত্তার বললেন, ‘যেভাবে তুমি মৃত্যু কামনা কর।’ দরবেশ বললেন, ‘তুমিও আমার মতো করে মৃত্যু কামনা কর?’ আত্তার বললেন, ‘হ্যাঁ।’ একথা শুনেই দরবেশ তাঁর সাথে থাকা কাঠের পাত্রটি
নিজের মাথার রেখে দোকানের সামনে সটান শুয়ে পড়ে বললেন, ‘আল্লাহ।’ এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এই দৃশ্য অবলোকন করে
আত্তারের মনের অবস্থা সম্পূর্ণ বদলে যায়। তৎক্ষণাৎ তিনি চিকিৎসাকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে এবং জগৎসংসারের সাথে সব রকমের সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণরূপে নিজেকে আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োগ করেন।
অবশ্য ফারসি সাহিত্যের অনেক গবেষকই জামীর এই বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন।
কারণ, আত্তারের তাজকেরাতুল আওলিয়া গ্রন্থের তথ্য থেকে জানা যায়- শৈশবকাল
থেকেই আত্তার আধ্যাত্মিকতার প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি ছিলেন তাঁর পিতার শিষ্য কুতুব
উদ্দিন হায়দারের শিষ্য। বাল্যকালেই আত্তার কুতুব উদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সুফি
সাধনায় দীক্ষা লাভ করেন। তবে ইসলামে বৈরাগ্যবাদের স্থান নেই বিধায় তিনি চিকিৎসা পেশা
এবং আধ্যাত্মিক সাধনা সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। চিকিৎক পেশায় থাকার সময়ে তিনি তাঁর আসরার নামে এবং এলাহি নামে
গ্রন্থ দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। কালক্রমে একপর্যায়ে
যখন তিনি সংসার জীবন তথা পার্থিব জীবনের মায়ামুক্ত হয়ে পার্থিব সব সম্পর্ক ছিন্ন
করে সম্পূর্ণরূপে আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। সম্ভবত এই সময়েই জামীর গ্রন্থে
বর্ণিত পূর্বোক্ত দরবেশের ঘটনাটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে ইসলামী সুফি দর্শনে অনুরক্ত হয়ে চিকিৎসা ব্যবসা ত্যাগ
করে সুফি দর্শন শিক্ষণ এবং প্রচলনের জন্য দেশত্যাগ করে নানা স্থান ভ্রমণ করেন। এই
সফরে তিনি বাগদাদ, বসরা, কুফা, মক্কা, মদিনা, দামেস্ক, খোয়ারিজম, তুর্কিস্তান এবং ভারতে, সুফি শায়খদের সাথে সাক্ষাত করেন।
১২২১ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোলরা নিশাপুর অধিকার পর, ব্যাপক
গণহত্যা চালায়।
এই সময় তিনি মঙ্গোলদের হাতে নিহত হন। মতান্তরে
তিনি মঙ্গোলদের হাতে
১২৮২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
সূত্র: