গাজ্জালি, ইমাম
১০৫৮ -১১১১ খ্রিষ্টাব্দ
পারশ্যের র্মতত্ত্ববিদ, আইনবিদ, যুক্তিবিদ, দার্শনিক ও রহস্যবাদী।

তাঁর পূর্ণ নাম আবু হামিদ মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ তুসী আল-গাজ্জালি। সংক্ষেপে গাজ্জালি বলা হয়। সম্মানসূচক নাম হিসেবে ইমাম গাজ্জালি বলা হয়।

আনুমানিক ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দ (৪৫০ হিজরি) ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মোহাম্মদ আল-গাজ্জালী। ফার্সি গাজ্জাল শব্দের আভিধানিক অর্থ সুতা কাটা। কোনো কোনো মতে ইমাম গাজ্জালীর বংশের লোকেরা সম্ভবত সুতার ব্যবসা করতেন, তাই তাদের বংশ উপাধি গাজ্জালী নামে পরিচিত।

শৈশবে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। তাঁর তার শৈশব কেটেছিল তুস নগরীতে।  কিশোর বয়সে ইসলামী আইনশাস্ত্রের শিক্ষালাভ করেন জর্জানে। এরপর ধর্মতত্ত্বের শিক্ষাগ্রহণ করেন নিশাপুরের আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইন-এর কাছে। এই সময় তিনি অপর শিক্ষাগুরু আবু আলি ফরমাদি এবং  আবুল-কাসেম কোরাকানি কাছে শিক্ষালাভ করেন। এই শিক্ষাগুরুদের বেশিরভাগই ১০৮৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্য মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তিনি নানা গ্রন্থাদি পাঠ করে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠতে থাকেন। ইতিমধ্যে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই সুবাদে  ঢাজালি সালজুক উজির কৃজা নেয়াম-আল-মোলক -এর দরবারে পণ্ডিত হিসেবে যোগদান করেন।

১০৯১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তৎকালীন বাগদাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি মুসলিম দর্শন, ফিকাহ, ইলমুল কালাম (ধর্মতত্ত্ব) বিষয়ে পাঠদান করতেন।
এখানে তাঁর ধর্মতত্ত্ব ও অন্যান্য অধ্যাপকদের কুপ্রচারণায় বিরক্ত হয়ে ১০৯৫ শিক্ষকতা ত্যাগ করেন। এরপর তিনি
নিযামিয়া মাদ্রাসার অধ্যাপনা ছেড়েদেন এবং সৃষ্টি রহস্যের সন্ধানে নানা স্থানে ভ্রমণ করে।

এই যাত্রায় তিনি প্রথম দামেস্কে যান। সেখানে তিনি নাসর মাকদেসিকে ধর্মশিক্ষা দেন। এরপর তিনি জেরুজালেমে যান এবং ১০৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হেবরনে অবস্থিত ইব্রাহিম নবীর সমাধি পরিদর্শন করেন। কথিত আছে- এখানেই তিনি শপথ করেছিলেন যে তিনি আর কখনও সরকারের কাছ থেকে অর্থ নেবেন না, আর কখনও কোনও শাসকের সেবা করবেন না এবং আর কখনও শিক্ষাগত বিতর্কে প্রবেশ করবেন না।

এই বছরেই তিনি জেরুজালেম থেকে মদিনা ও মক্কা আসেন। এরপর তিনি মিশরের আলকজান্দ্রিয়ায় যান। ১০৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিরিয়ায় ফিরে আসেন।

১১০৬ খ্রিষ্টাব্দে নেহাম-আল-মোল্কের পুত্র ফহর-আল-মোলক, খোরাসানের সালজুক সুলতান সানজারের উজির হন। তিনি নিসাপুরে শিক্ষাবক্তৃতায় ফিরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। আব্রাহামের সমাধিতে তিনি যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা ভঙ্গ করে, তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন এবং নিশাপুরে তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে পর্যন্ত শিক্ষা দান করেছিলেন।

এরপর অল্প কিছুদিন বাগদাদে কাটিয়ে পর তিনি তাঁর জন্মস্থান তুস-এ ফিরে আসেন। এই সময় তাঁকে সরকারের পক্ষ থেকে যে মাসোহারা দেওয়া হতো, তা ত্যাগ করেন। সরকারী প্রভাবাধীনে পরিচালিত শিক্ষায়তনসমূহে কাজ করার অনুরোধ করা হলে- দুর্নীতিগ্র্থ এ প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। এরপর তিনি তাঁর জন্মস্থান তুসে নিজের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন। তাঁর এই কার্যক্রম পূর্ণতালাভের আগেই - ১১১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ ডিসেম্বর (৫০৫ হিজরি) জন্মভূমি তুস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন। ইরানের অপর বিখ্যাত কবি ফেরদৌসীর সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।

গ্রিক দর্শনের সঙ্গে ইসলামী দর্শনের যে বিরোধ ছিল- সেখানে গাজ্জালি  ছিলেন মুসলমানদের কর্ণধার। তাঁর সময়ে শরিয়ত ও মারিফতের মধ্যে ব্যাপক দ্বন্দ্ব ছিল। তিনি এ দ্বন্দ্বকে দূর করে উভয় দর্শনকে সাম্যে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরবে প্রচলিত গজল নামক প্রণয়সঙ্গীত পারশ্যে সুফিবাদের ভাবধারার বিশেষ ধরনের কাব্যগীতিতে পরিণত হয়েছিল। এই ধারার গজলের সূত্রপাত ঘটেছিলেন ইমাম গাজ্জালি।

ইমাম গাজ্জালি প্রায় চারশ'র অধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার অধিকাংশ বইগুলোতে ধর্মতত্ব, দর্শন ও সুফিবাদ আলোচনা পাওয়া যায়। তাঁর রচিত কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থের নাম নিচে দেওয়া হলো-

১. এহইয়া উলুমুদ্দীন
২. তাহাফাতুল ফালাসিফা
৩. কিমিয়ায়ে সা’আদাত
৪. হাকিকাতুর রুহু
৫. দাকায়েকুল আখবার
৬. আসমাউল হুসনা
৭. ফাতাওয়া
৮. মিশকাতুল আনোয়ার
৯. আসরার আল মোয়ামেলাতুদ্দিন
১০. মিআর আল ইলম
১১. মুনক্বীয
১২. মুকাশাফা'তুল কুলুব
১৩. আল ইক্বতিসাদ ফিল ই'তিক্বাদ
১৪. মিনহাজুল আবেদীন
১৫. বিদায়াতুল হেদায়াহ


সূত্র: