গজল
সুরাঙ্গের বিচারে গজল আধাশাস্ত্রীয় সঙ্গীত। আর বিষায়ঙ্গের বিচারে গজল হতে পারে শৃঙ্গার, ইসলামী অধ্যাত্ম দর্শন, ব্যক্তিগত উপলব্ধিজাত মরমী কিম্বা ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনার গান।
শব্দ-উৎসের বিচারে গজল
غزل
আরবি
শব্দ। মূলত আরবি ভাষাভাষী অঞ্চলে গজলের সূচনা হয়েছিল মেয়েলি রোমান্টিক গান হিসেবে।
গজল শব্দের একটি অর্থ হলো ঘোরানো বা প্যাঁচালো। মহিলার তাঁদের
অবসর সময়ে রোমান্টিক বা শৃঙ্গারধর্মী হাস্যকৌতুক প্রকাশ করতেন রূপকতা বা হেঁয়ালিতে
মেশা ছড়ায়। এই বিশেষ ধরনের ছড়াকে বলা হতো গজল। ফলে এসব হেঁয়ালিপূর্ণ ছড়া তথা গজল হয়ে
উঠেছিল আলো-ছায়ায় মেশা রহস্যময়। কালক্রমে আরবের কবিদের দ্বারা এই গজল সমৃদ্ধতর হয়ে
উঠছিল ছন্দ ও রূপকতায় মেশা রহস্যময় কবিতা।
প্রাক্-ইসলামী যুগের শেষার্ধে আরবি ভাষার বিভিন্ন কবিদের রচনা মাধ্যমে আরব-উপদ্বীপ ছাড়াও মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে গজল ছড়িয়ে পড়েছিল। পারশ্যে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হওয়ার সূত্রে রোমান্টিক কবিতা হিসেবে ফার্সি ভাষায় গজলের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায়, বিশেষ করে উর্দু, পশতু, উর্দু, হিন্দি এবং বাংলাতে গজল রচিত হয়েছিল ফার্সি গজলের সূত্রে।
মধ্যপ্রাচ্য, পারশ্য এবং ভারতের বাইরে উৎকৃষ্ট গজলের চর্চা হয়েছে জার্মানিতে।
জার্মানির প্রখ্যাত কবি ফ্রেডরিখ রুকের্ট
(Friedrich
Rückert, 1788–1866)। সময়ের বিচারে তিনি
মির্জা গালিব সমসাময়িক। এর কাছাকাছি সময়ে গজল রচনা করে খ্যতি লাভ করেছিলেন জার্মান
কবি অগাস্ট ভন প্লাতেন ((
August von Platen,
1796–1835) । এর বাইরে ইংরেজি এবং
বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় গজল রচনা করে ভারতীয়-আমেরিকান কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন
আগা শহিদ আলি (১৯৪৯-২০০১ খ্রিষ্টাব্দ)।
খ্রিষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে আরব দেশীয় গজল নামক প্রণয়সঙ্গীত পারশ্যে সুফিবাদের ভাবধারার বিশেষ ধরনের কাব্যগীতিতে পরিণত হয়। এই ধারার গজলের সূত্রপাত ঘটেছিল পারশ্যের প্রখ্যাত কবি ও দর্শনিক
ইমাম গাজ্জালির,
(১০৫৮-১১১১ খ্রিষ্টাব্দ) মাধ্যমে। গাজ্জালির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পারশ্যের কবি
ফরিদ
উদ্দিন আত্তার (১১১০-১২২০ খ্রিষ্টাব্দে) এবং কবির হাকীম শানাই (১১৩১-১১৪১ খ্রিষ্টাব্দ) গজল রচনা করেন। পারশ্যের গজল বিকাশে এই জন প্রখ্যাত কবিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়।
খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে এই ধারার গজলকে ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে দেন
পারশ্যের কবি রুমি (১২০৭-১২৭৩ খ্রিষ্টাব্দ) ও হাফিজ (১৩২৫-১৩৯০ খ্রিষ্টাব্দ)। পারশ্যের বাইরে আজারবাইজানের কবি মুহাম্মদ বিন সুলায়মান (১৪৯৪-১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দ) খ্যতি লাভ করেছিলেন গজল রচনা করে। তিনি আজেরি, ফার্সি এবং আরবিতে তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন, কিন্তু তার রচনার মূল ক্ষেত্র ছিল তুর্কি ভাষা দ্বারা প্রভাবিত আজেরি নামক উপভাষায়। এই সূত্রে তিনি অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম কবি হিসেবে সম্মান লাভ করেছিলেন।
ভারতবর্ষে গজলের অনুপ্রবেশ ঘটে পারশ্যের গীতিকারদের মাধ্যমে।
ভারতবর্ষে ফার্সি ভাষায় গজল রচনা করে খ্যাতি লাভ
করেন
আমির খসরু
(১২৫৩-১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ)। মূলত তিনি ছিলেন নিজামউদ্দীন আউলিয়ার
শিষ্য। তিনি স্থানীয় কাওয়াল গানের সুর ও ছন্দ অবলম্বনে খেয়াল এবং গজলের নতুন রূপ
দিয়েছিলেন। তিনি রচনা করেছিলেন গজল, রুবাই, মদনভী, কাসিদা, মর্সিয়া ইত্যাদি কবিতা।
১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি বংশোদ্ভুত গিয়াসউদ্দীন বলবন দিল্লীর সিংহাসনে
অধিষ্ঠিত হন। এর কিছুদিন পরে খসরু এই সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। অল্প বয়সে
কবিতা রচনা করে তিনি শিক্ষিত সমাজে এবং রাজ দরবারে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ১২৭১
খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তুহফাতুস-সিঘ্র' রচনা করেন।
এটি ছিল
কাশিদা
শ্রেণির রচনা। তাঁর গজলের উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন,
পারশ্যের প্রখ্যাত কবি ও দার্শনিক
শেখ সাদি
(১২১৩-১২৯১ খ্রিষ্টাব্দ)
। উল্লেখ্য, তিনি নিজেও গজল রচনা করেছিলেন।
এছাড়া বিশেষ করে রুমি এবং
হাফেজ শিরাজি গজল উত্তর-পশ্চিম ভারতের উর্দু ও পশতুভাষীদের কাছে অন্যতম কাব্যসঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল।
এই ধারার প্রথম উল্লেখযোগ্য কবি ওয়ালি মোহাম্মদ ওয়ালি (১৬৬৭-১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তবে উর্দু ভাষার চিরায়ত গজল
-এর স্থপতি হিসবে উল্লেখ করা হয় তিনজজন কবিকে। এঁরা হলেন মির তাকি মির (১৭২৩-১৮১০ খ্রিষ্টাব্দ)। খাওয়াজ মির দাদ (১৭২১-১৭৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং মির্জা মুহাম্মদ রাফি সাওদা (১৭১৩-১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ)।
এরপরের উল্লেখযোগ্য গজল রচয়িতা হিসেবে খ্যতি লাভ করেছিলেন খাওয়াজ হায়দার আলি আতিশ (১৭৭৮-১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দ), মির্জা গালিব (১৭৯৭-১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ), মোহাম্মদ ইব্রাহিম জক (১৭৮৯-১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে)। মোগল শাসনামলে উর্দু গজল রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন মোমিন খান মোমিন (১৮০০-১৮৫১)।
পরবর্তী সময়ে উর্দু ভাষায় রোমান্টিক গজল রচনা করে খ্যতি লাভ করেছিলেন দাঘ দেলবি (১৮৩১-১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দ) ও মাওলানা হাসাত মোহানি (১৮৭৫-১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ)।
আর উর্দু ভাষায় আধুনিক গজলের সূত্রপাত ঘটান মোহাম্মদ ইকবাল (১৮৭৭-১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দ)। তবে তিনি উর্দুর পাশাপশি ফার্সি ভাষাতেই গজল রচনা করেছিলেন। ইকবালের পরে উর্দু ভাষায় আধুনিক গজলকে সমৃদ্ধ করেছেন জিগার মোরাদাবাদি (১৮৯০-১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ), ফিরাক গোরখপুরি (১৮৯৬-১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দ), মাখদুম মহিউদ্দিন (১৯০৮-১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দ), ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ (১৯১১-১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ), জান নাসির আখতার (১৯১৪-১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ), মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব (১৯১৯-২০০১ খ্রিষ্টাব্দ), সৈয়দ নাসির রাজা কাজমি (১৯২৫-১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ), মুনির আহমেদ (১৯২৮-২০০৬ খ্রিষ্টাব্দ), জান এলিয়া (১৯৩১-২০০২ খ্রিষ্টাব্দ), আহমদ ফারাজ (১৯৩১-২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ)।
হিন্দির সাথে উর্দু ভাষার প্রচুর মিল রয়েছে। সেই কারণে অনেক উর্দু কবি হিন্দিতেও গজল রচনা করেছেন।
এক্ষেত্রে কবিরা অনেক সময়ই হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য ফরমায়েসি গজল রচনা করেছেন। মূলত জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের শিল্পীরা এঁদের রচিত গজলকে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। উর্দুর পাশাপাশি হিন্দিতে গজল রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন কমার জালালাবাদি (১৯১৯-২০০৩), সাহির লুধিয়ানভি (১৯২১- ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দ), মাজরুহ সুলতানপুরি (১৯১৯-২০০০ খ্রিষ্টাব্দ)।
গজল কাব্য এবং গজল গানের রূপক শব্দাবলী
গজল কাব্যের সূচনা আরব উপদ্বীপের আরবি ভাষাভাষী বিভিন্ন গোত্রের মহিলার
ভিতরে প্রচলিত হেয়ালি থেকে গজলের উদ্ভব হলেও এর উৎকর্ষ রূপ তৈরি হয়েছে আরবের বাইরে।
বিশেষ বহুবছর ধরে ফার্সি গজল উৎকর্ষতর রূপ লাভ করেছিল পারশ্যে। ধীরে রোমান্টিক
গজলের বিষয়গত রূপান্তর ঘটেছিল ফার্সি ভাষায়। বিশেষ করে পারশ্যের সুফিবাদী দর্শেনের
বিকাশের ধারায় পারশ্যের কবিরা শৃঙ্গার রসের গজলকে ভক্তিরসে সিক্ত করেছিলেন। তাঁর
হেঁয়ালি রোমান্টিক শব্দকে রহস্যময় আধ্যাত্মিক শব্দে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন। এমনিতেই
সুফিবাদী দর্শনে আধ্যাত্মিক ভাবনাকে রূপকতার আশ্রয়ে উপস্থাপন করে রহস্যময় করে তোলা
হয়েছিল। এর সাথে রোমান্টিক ভাবধারার মিশানোর ফলে গজল আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছিল।
কতিপয় রূপক শব্দাবলী
-
বেহুঁশ:
সাধারণ অর্থ নেশাগ্রস্থ অবস্থায় সাধারণ বোধবুদ্ধি লোপ।
সুফিবাদী দর্শনে, আল্লাহর প্রেমে মাতোয়ারা হওয়া।
-
শরাব:
সাধারণ অর্থ মদ, মদিরা, মদ্য, শরাব, সুরা।
-
সাকি:
সাধারণ অর্থ. সুরা পরিবেশনকারী তরুণ বা তরুণী।
সুফিবাদী দর্শনে সুফি সাধকদের ধর্মগুরু। গজল কাব্য বা গানে
অনেক সময় সাকি শব্দটি
হজরত মুহম্মদ
(সাঃ) -কে ইসলাম ধর্মের আদি ধর্মগুরু
হিসেবে- সাকি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলা গানে গজল
বাংলা গজল গানের প্রাণ পুরুষ হলেন
কাজী
নজরুল ইসলাম।
কিন্তু কালানুক্রমের বিচারে প্রথম বাংলা গজল রচনা করেছিলেন
লক্ষ্ণৌ প্রবাসী
অতুলপ্রসাদ
সেন। সম্ভবত উর্দু-গজল শুনে তিনি গজল সুরাঙ্গের গান রচনা
করেছিলেন। অনেকে মনে করেন- তাঁর রচিত প্রথম গজল- 'কত গান তো হল গাওয়া'। শেরযুক্ত এ
গানের সুরের গজলের সুরশৈলী পাওয়া যায়। সুরাঙ্গের বিচারে যে কোন গান বিষায়াঙ্গের গান
গজল হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু বাণী এবং শব্দচয়নের বিচারে গজলের আদি বৈশিষ্ট্য রূপক
শব্দের ব্যবহার, দ্ব্যর্থার্থে রহস্যময়। সে বিচারে অতুলপ্রসাদের রচিত গজলকে বলা যায়
আধা-গজল শ্রেণির গান। গজলের অন্যতম ধারা সুফিবাদের অধ্যাত্মদর্শন, শব্দের
দ্ব্যর্থকতা, রহস্যময়তার নিদর্শন অতুলপ্রসাদের গানে পাওয়া যায় না। এই বিচারে
নজরুল ইসলামের গান যথার্থ গজল হিসেবে বিবেচনায় আনতেই
হয়।
অতুলপ্রসাদ
সেনের রচিত উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গজল হলো-
- কত গান তো হল গাওয়া
[তথ্য]
- কে গো তুমি বিরহিণী,আমারে সম্ভাষিলে
[তথ্য]
- জল বলে, চল্ মোর সাথে চল
[তথ্য]
- ভাঙা দেউলে মোর কে আইলে আলো হাতে
[তথ্য]
- রাতারাতি করল কে রে ভরা বাগান ফাঁকা
[তথ্য]
নজরুলে গজল কাব্য ও গজল গান
ক্রমশ...