ফিরোজা বেগম
বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮শে জুলাই (১২ই শ্রাবণ) গোপালগঞ্জ জেলার রাইতল ঘোনাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল (বৃটিশ সরকারের কৌঁসুলি। তিনিই প্রথম মুসলমান সরকারি কৌঁসুলি) এবং মায়ের নাম বেগম কওকাবুন্নেসা।

প্রাথমিক খেলাপড়া শেষ করেছিলেন স্থানীয় স্কুলে এবং বাড়িতে। কলের গান শুনে তিনি গান গাওয়া শুরু করেন। তাঁদের পরিবার রক্ষণশীল না হলেও শিক্ষক রেখে গান শেখানোর তাগিদ পরিবার থেকে আসে নি। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে তিনি কলকাতায় বেড়াতে যান। সেখানে বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তিনি গান শুনিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করতেন। এমনি এক আসরে তিনি কাজী নজরুল ইসলামকেও গান শোনান। এই প্রসঙ্গে ফিরোজা বেগম স্মৃতিচারণে বলেন "আসলে আমি তখন অনেক ছোট। তাছাড়া এমন পরিবেশে যাইনি কখনো। তাই তাঁকে তো চেনার কথাও নয়। নজরুলের ছবি পাঠ্যবইতেও দেখিনি। কারণ তখনও তাঁর ছবি বইতে ছাপা হয়নি। ফলে আমার মধ্যে আলাদা কোন অনুভূতি হয়নি। সম্ভ্রান্ত মুসলমান পরিবারের একজন মেয়ে গান গাইছে, গান গাইতে চায়, এটা জেনে দারুণ খুশি হয়েছিলেন নজরুল। আমার গান শুনে বলেছেন, 'এ গান তুমি শিখলে কেমন করে?' বলেছি, কালো কালো রেকর্ড শুনে নিজে নিজেই শিখেছি। এটা শুনে কেবল তিনি নন, উপস্থিত সবাই অবাক হয়েছেন।"





স্বামী কমলদাশ গুপ্তের সাথে

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে ১২ বছর বয়সে বিখ্যাত গ্রামোফোন কোম্পানি এইচএমভি থেকে ৭৮ আরপিএম ডিস্কে নিয়ে তাঁর প্রথম রেকর্ড বের হয়। এই সময় তিনি গান শিখেছিলেন চিত্তরায়ের কাছে। এই রেকর্ডের একদিকে ছিল 'মোর আঁখিপাতে', অন্যদিকে ছিল 'মরুর বুকে জীবনধারা কে বহাল'। কিছুদিন পর কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে উর্দু গানের রেকর্ড হয়। এ রেকর্ডের গান ছিল- 'ম্যায় প্রেম ভরে, প্রীত ভরে শুনাউ' আর 'প্রীত শিখানে আয়া'।

এর কিছুদিন পর তাঁর বড় বোন এবং ভগ্নীপতি দিল্লী থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন এবং বালিগঞ্জের বসবাস শুরু করেন। এই বাসায় থেকে কলকাতায় এসে গান শেখার সুযোগ হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আবার তাকে কিছুদিন কলকাতা ছাড়তে হয়। কলকাতায় তিনি গান শিখেছিলেন চিত্ত রায় এবং কমল দাশগুপ্তের কাছে। নজরুল সঙ্গীতের পাশাপাশি তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিলেন পঙ্কজ মল্লিকের কাছে। অন্যদিকে লোকসঙ্গীতের তালিম নেন আব্বাসউদ্দিন এবং পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের কাছে।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গীত নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড বের হয়। গানটি ছিল -'আমি গগন গহনে সন্ধ্যাতারা'।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে সুরকার, গায়ক ও গীতিকার কমল দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় ফিরে আসেন।
১৯৬৮-৬৯ ইসলামাবাদ রেডিওর উদ্বোধন। গান গাইতে হবে ফিরোজা বেগমকে। তাঁকে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু ফিরোজার এক কথা, 'আগে আমি বাংলা গাইব তারপর উর্দু। নইলে যাব না।' তখনকার তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন ঐ শর্তেই রাজি। তিনি গাইলেন- 'ও ভাই খাটি সোনার চেয়ে খাটি আমার দেশের মাটি'। সত্তরে দেশ ফুঁসছে আর সে সময় করাচীতে ইএমআই পাকিস্তানে তিনি 'জয়, জয়, জয় বাংলার জয়' আর 'জন্ম আমার ধন্য হল মাগো' এই বাংলা গানগুলো রেকর্ড করেন।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জুলাই তাঁর স্বামী কমল দাশগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের  ৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে কিডনি জটিলতায় ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

সন্তানাদি: তিন সন্তান - তাহসিন, হামীন ও শাফীন রয়েছে। হামিন ও শাফিন - উভয়েই রকব্যান্ড দল মাইলসের সদস্য।

পুরস্কার ও সম্মাননা

এ ছাড়াও জাপানের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান সিবিএস থেকে গোল্ড ডিস্ক, ২০১১ সালে মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন। ১২ এপ্রিল ২০১২ তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের কাছ থেকে "বঙ্গ সম্মান" পুরস্কার গ্রহণ করেন।



সূত্র

সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদকঃ অঞ্জলি বসু, ৪র্থ সংস্করণ, ১ম খণ্ড, ২০০২, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, পৃ. ৭৭

http://www.mediatimes24.com/news/microapps/1533/12/detail.aspx

http://www.somewhereinblog.net/blog/porshi/29569041

http://www.prothom-alo.com/