গুরুসদয় দত্ত
(১৮৮২-১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ)
লোক সাহিত্য গবেষক, সমাজসেবক, লেখক এবং ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।

১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার (তৎকালীন করিমগঞ্জ মহকুমা) বীরশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা রামকৃষ্ণ দত্ত চৌধুরী ছিলেন সম্ভ্রান্ত জমিদার। গুরুসদয় দত্ত নিজে পারিবারিক উপাধি 'চৌধুরী' ব্যবহার করতেন না। এই কারণে তিনি গুরুসদয় দত্ত নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।

সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার বিরশ্রী গ্রামের মাইনর স্কুলে গুরুসদয় দত্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি সিলেট শহরের একটি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে- মেধানুসারে তিনি আসাম প্রদেশে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এফ. এ পরীক্ষা দেন এবং মেধানুসারে প্রথম স্থান অর্জন করেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আইসিএস শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এই সময় তিনি আইন নিয়ে লেখাপড়া করেন। আইন পরীক্ষাতেও তিনি প্রথম স্থান লাভ করেছিলেন। উল্লেখ্য এই পরীক্ষায় তিনি মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করেন।

কৃতিত্বের সাথে আইসিএস এবং ব্যারিষ্টারি পাশ করে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। এই সূত্রে তিনি বিহারের মহকুমা শাসক হিসাবে নিযুক্ত হন। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসকদের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত এবং তা বাতিল করার জন্য বঙ্গবাসীর আন্দোলনের বছর। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকুরিরত অবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে তাঁর পক্ষে এই আন্দোলনের সামিল হওয়া সম্ভব ছিল না।

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সরোজনলিনী দেবীর তাঁর বিয়ে হয়। কথিত আছে স্ত্রীর সাথে তিনি ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে লোকজ শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিহার থেকে বাংলায় বিচারবিভাগের কাজে বদলি করা হয়। এরপর ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুমিল্লা, ঢাকা ও বরিশাল জেলার বিচারবিভাগে কাজ করেছিলেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে বদলি করা হয় বীরভূম জেলার কালেক্টর হিসাবে। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সপরিবারে তিনি চলে যান জাপানে। জাপান থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন এবং বাকুড়ার জেলাশাসক হিসাবে নিয়োগ পান। এই সময় তিনি তাঁর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে সমবায় প্রথায় চাষাবাদ, স্বদেশী মেলা ও মহিলা সমিতি গঠন করে সমাজ সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেন।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে. তিনি স্ত্রীর স্মরণে 'সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি' গঠন করেন।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে হাওড়া জেলার জেলাশাসক হিসাবে কাজে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানেই ‘গ্রামের ডাক’ নামে একটি পত্রিকার প্রচলন করেন। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'হাওড়া জেলা কৃষি ও হিতকারী সমিতি'। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে হাওড়াতে লিলুয়ার রেলশ্রমিকদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনি তীব্র নিন্দা করেন। তার এই প্রতিক্রিয়ায় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সমালোচনা হয়। তাই তাকে হাওড়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রোমে এক কৃষি সম্মেলনে যোগ দেন।  দেশে ফিরে তিনি ময়মনসিংহ জেলার জেলাশাসক হিসাবে বদলি হন। সেই বছরেই আবার তিনি ইংলন্ডে যান। সেখানে ইংলন্ডের লোকগীতি ও লোকনৃত্য রক্ষা সমিতির অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন। ফিরে এসে গঠন করেন 'ময়মনসিংহ লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমিতি' গঠন করেন। এই সময় মহাত্মা গান্ধীর লবণ আইন অমান্য আন্দোলন চলছিল ময়মনসিংহে। এই আন্দোলন দমন করার জন্য তিনি সেই আন্দোলনে তিনি কোন লাঠি বা গুলি চালানোর নির্দেশ দেন নি। ফলে ব্রিটিশ সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে বীরভূমে বদলি করে।

নতুন করে আবার বীরভূমে এসে তিনি 'লিজ ক্লাব এমেচার মিউজিক্যাল সোসাইটি' গঠন করে লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির অনুসন্ধান শুরু করেন। এই সূত্রে তিনি সহজ ভাষায় সহজ লোকসুরে গান লেখা শুরু করেন। চাকুরীতে থাকাবস্থায় তিনি অনুভব করেছিলেন, ব্রিটিশ ভারতের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য, দৈহিক ও মানসিকভাবে সক্রিয় সবল হয়ে উঠতে হবে। তাই তিনি নৃত্যভঙ্গামায় দেশীয় সুরে গান বাঁধলেন। মূলত নাচ-গানের ভিতর দিয়ে দেহ ও সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত হবে- এই ভাব থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন ব্রতচারী নৃত্যগীতি। সরকারি চাকুরতে থাকাবস্থায় এসব কাজ করা সম্ভব হয় নয়, তাই তিনি তাঁর অনুগত শিষ্য আলীজী (নবনীধর বন্দ্যোপাধ্যায়)-এর উপর ব্রতচারীর দায়িত্ব অর্পণ করেন। এছাড়া এই সময়ে তিনি বীরভূমের বিলুপ্তপ্রায় রায়বেশে নাচকে তিনি পুনরাবিষ্কার করেন। পরে তা তাঁর ব্রতচারী আন্দোলনের যুক্ত করে নেন।

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি গঠন করেন 'বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি'। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের এই সমিতির পক্ষ থেকে একটি লোকনৃত্য প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেন। এই সমিতির ৬ই ফেব্রুয়ারির একটি সভায় তিনি ‘ব্রতচারী’ আন্দলনের ঘোষণা দেন।  এই সময় সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নং লাউডন স্ট্রিট। পরে সেকালের অবিভক্ত বাংলার অনেক এলাকাতেই এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

 ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য হন। এই বছরে দিল্লীতে তিনি ব্রতচারী নাম পরিবর্তন করে 'সর্বভারতীয় লোকনৃত্য ও লোকগীতি সমিতি' নাম দেন। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে এই নাম বদল করে, নতুন নাম দেন  'বাংলার ব্রতচারী সমিতি' এবং একই সাথে এই নামটি সরকারিভাবে নথিভূক্ত করেন। এই বছরেই ফরিদপুর ব্রতচারী সমিতির মূখপত্র হিসেবে 'ব্রতচারী বার্ত্তা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এছাড়া  বাংলা ব্রতচারী সমিতির উদ্যোগে ১৯৩৬ সালে 'বাংলার শক্তি' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।

 ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যাণ্ডের লোকনৃত্য উৎসবে যান। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি একটি বড় দল নিয়ে হায়দ্রাবাদে মহাত্মা গান্ধী ও সুভাষ বসুর উপস্থিতিতে একটি ব্রতচারী অনুষ্ঠানে অংশ নেন।

চাকরির সুবাদে তাঁকে বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এই সূত্রে তিনি বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকশিল্প এবং সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি এসব অঞ্চল থেকে লোকজ শিল্পকর্ম সংগ্রহ করেছেন। তাঁর এই সংগ্রহের তালিকায় ছিল- চিত্রিত মৃৎপাত্র,  নকশি কাঁথা, পটচিত্র, মাটির পুতুল,  শিল্পিত হাতপাখা, বালিশের আবরণ, বিনুনি বাঁধবার দড়ি, নানাধরণের গ্রামীণ ভাস্কর্য, কারুকার্য করা দরজা, প্রাচীন মূর্তি ইত্যাদি।

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের কলকাতার উপকণ্ঠে জোকা নামক গ্রামে ১০১ বিঘা জমিতে ‘ব্রতচারী গ্রাম’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই বছরের অক্টোবর মাসে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। অক্লান্ত পরিশ্রমে এবং দুরারোগ্য কর্কট রোগের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুন তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গুরুসদয় দত্তের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি