ব্রতচারী
লোক সাহিত্য গবেষক, সমাজসেবক, লেখক
গুরুসদয় দত্ত কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত একটি সমাজসেবামূলক আন্দোলন।এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হলো-
লোকসংস্কৃতির চর্চার নিজের দেশকে চেনা এবং নৃত্যগীত ও শরীর চর্চার মধ্য দিয়ে সুস্থ ও সবল দেহ ও মনের
বিকাশ ঘটানো।
ব্রত শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো- নিয়ম ও সংযম। আবার তপস্যা অর্থেও ব্রত শব্দ
ব্যবহার করা হয়। ধর্মানুশাসনে পূণ্যলাভ বা পাপক্ষয়ের জন্য যে নিয়ম ও সংযমের দ্বারা
তপস্যা করা হয়, তাকেও ব্রত বলা হয়। গুরুসদয় তত্ত্বের ব্রত ছিল স্বদেশবাসীর কল্যাণের
জন্য দেহ-মনের সংযম করার বিধি। এক কথায় এই ব্রত হলো স্বদেশে কল্যাণের জন্য
প্রতিজ্ঞামূলক জীবনাচরণের চর্চা। আর যিনি এই ব্রত গ্রহণ করবেন, তিনিই ব্রতচারী।
এরূপ মনোভাবের যে কেউ ব্রতচারী হতে পারেন। এখানে জাতি, ধর্ম, গাত্রবর্ণ, নারী,
পুরুষের বিভেদ নেই। এই অর্থে গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলন হলো
পূর্ণ-অসাম্প্রদায়িক। সর্বজনের কল্যাণের জন্য সর্বজনের জন্য প্রচেষ্টাই হলো
ব্রতচারী আন্দোলন।
ব্রতচারী আন্দোলনের লক্ষ্য পূরণের জন্য রয়েছে কিছু মন্ত্রসদৃশ বাণী। এ সকল বাণী
নৃত্যগীত এবং আবৃত্তির মধ্য দিয়ে পরিবেশিত হয় বটে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে আর আদর্শিকভাবে তা
গ্রহণ করতে হয়ে মনে-প্রাণে। তাই ব্রতচারীর নৃত্যগীত শুধুই নাচগানের আসর নয়। এর
ভিতরে রয়েছে সর্বজনের কল্যাণের জন্য সর্বজনের বাণী। এ সকল
বাণী নানা নামে ব্রতচারীদের কাছে উপস্থাপন করা হয়। যেমন-ভূমিপ্রেমের তিন,
বাংলাদেশের ব্রতচারীর ষোল পণ, ছয়টি অতিরিক্ত পণ, বাংলার ব্রতচারীর সতেরো মানা, শিশু
ব্রতচারীর বারো পণ, ব্রতচারীর ক্রমবৃদ্ধির কামনা, চতুর্বর্গ, সাধনা পর্যায়,
ব্রতচারীর পূর্ণ-বৃত্ত, পরহিতে শ্রম ব্রতচারীর দৈনিক অবশ্য-কৃত্য, ব্রতচারীর
বাক্-সংযম, ব্রতচারীর কণ্ঠ-সংযম, ব্রতচারীর মান-অপমান, ব্রতচারীর বেকারত্ব বর্জন,
ব্রতচারীর আত্মবিশ্বাস, ব্রতচারীর আদি নীতি, ব্রতচারীর অন্তঃশুদ্ধি, ব্রতচারীর
পঞ্চ-ব্রত, বাংলার ব্রতচারীর প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি।
[বিস্তারিত: দেখুন:
ব্রতচারী
প্রবেশ। গুরুসদয় দত্ত
ব্রতচারী, বাংলাদেশ]
ব্রতচারীর
উদ্ভব, ক্রমবিকাশ ও কার্যক্রম
ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা
গুরুসদয় দত্ত, পরাধীনতার গ্লানি অনুভব করেছিলেন
গভীরভাবে। তাই স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেসী আন্দোলন তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল
প্রবলভাবে। দেশসেবার ব্রত নিয়েই তিনি ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়
কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদান করেন এবং উক্ত অধিবেশনের ভলান্টিয়ার ইনচার্জ হয়ে বিশেষ কৃতিত্বের স্বাক্ষর
রেখেছিলেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার তাগিদে তিনি কংগ্রেসী আন্দোলন থেকে
নিজেকে সরিয়ে নেন। অত্যন্ত মেধাবী এই কৃতিপুরুষ দেশের তৎকালীন ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার উচ্চ
মাধ্যমিক স্তর শেষ করে, আইসিএস পরীক্ষার জন্য ইংল্যান্ড যান। সেখান থেকে কৃতিত্বের
সাথে আইসিএস এবং ব্যারিষ্টারি পাশ করে ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। এই সূত্রে
তিনি বিহারের মহকুমা শাসক হিসাবে নিযুক্ত হন। এটি ছিল ব্রিটিশ শাসকদের বঙ্গভঙ্গের
সিদ্ধান্ত এবং তা বাতিল করার জন্য বঙ্গবাসীর আন্দোলনের বছর। ব্রিটিশ সরকারের অধীনে
চাকুরিরত অবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে তাঁর পক্ষে এই আন্দোলনের সামিল হওয়া সম্ভব ছিল না।
প্রশাসনিক কাজে তাঁকে
বঙ্গদেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমায় কর্তব্য পালন করেছেন। কিন্তু প্রথাগত চাকুরিতেই তিনি
নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন নি। তিনি বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতির মধ্যে দেশের মানুষকে
জানতে চেষ্টা করেছন। এই কারণে ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির উপাদান সংগ্রহ করেছেন
অক্লান্তভাবে। তাঁর এই সংগ্রহের তালিকায় ছিল- চিত্রিত মৃৎপাত্র, নকশি কাঁথা, পটচিত্র, মাটির
পুতুল, শিল্পিত হাতপাখা, বালিশের আবরণ, বিনুনি বাঁধবার দড়ি, নানাধরণের
গ্রামীণ ভাস্কর্য, কারুকার্য করা দরজা, প্রাচীন মূর্তি ইত্যাদি। আর সংগ্রহ করেছেন
বিভিন্ন ধারার লোকসঙ্গীতের নমুনা। আর বাংলার লোকসম্পদ সম্পদ রক্ষার জন্য তিনি 'বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে সরোজনলিনী দেবীর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। সরোজনলিনী দেবীর কোনো
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। গুরুসদয় তাঁকে নিজের মতো করে গড়ে তুলেছিলেন। স্বামীর
সহযোগিতায় তিনি ঘোড়ায় চড়া, টেনিস খেলা, বেহালা বাজানো, শিকার করা ও স্বদেশী সঙ্গীত
শিখেছিলেন। কথিত আছে স্ত্রীর সাথে তিনি ঘোড়ায় চড়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে লোকজ
শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন। অল্পদিনের মধ্যে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হলে, তিনি তাঁর
স্ত্রীর স্মরণে গ্রামবাংলার মেয়েদের জন্য '‘সরোজনলিনী নারীমঙ্গল সমিতি’ গঠন করেন।
চাকুরীতে থাকাবস্থায় তিনি অনুভব করেছিলেন, ব্রিটিশ ভারতের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে
সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তোলার জন্য, দৈহিক ও মানসিকভাবে সক্রিয় এবং সবল হয়ে উঠতে হবে।
তাই তিনি নৃত্যভঙ্গিমায় দেশীয় সুরে গান বেঁধেছিলেন। মূলত নাচ-গানের ভিতর দিয়ে দেহ ও সাংস্কৃতিক চেতনা বিকশিত হবে-
এই ভাব থেকে তিনি তৈরি করেছিলেন ব্রতচারী নৃত্যগীতি। সরকারি চাকুরতে থাকাবস্থায় এসব
কাজ করা সম্ভব ছিল না, তাই তিনি তাঁর অনুগত শিষ্য আলীজী (নবনীধর বন্দ্যোপাধ্যায়)-এর
উপর ব্রতচারীর দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন। এইভাবে কিছুদিন কাজ করার পর, ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে
তিনি তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠিত 'বঙ্গীয় পল্লীসম্পদ রক্ষা সমিতি'র সদ্স্যদের নিয়ে
'ব্রতচারীর দল' গঠন করেন। তাঁর এই প্রতিষ্ঠিত দলটি পরে ব্রতচারী সমিতির
মাধ্যমে এই আন্দোলনের কার্যক্রম প্রচার করতে থাকে। এই সময় সমিতির কেন্দ্রীয়
কার্যালয় ছিল কলকাতার ১২ নং লাউডন স্ট্রিট। সেকালে অবিভক্ত বাংলার অনেক এলাকাতেই
এই সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর ভিতরে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা ব্রতচারী সমিতি,
কালীঘাট উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় ব্রতচারী সঙ্ঘ (কলকাতা) এই আন্দোলনকে সঞ্চালিত
করেছেন। এছাড়া সর্বভারতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সাউথ ইন্ডিয়া ব্রতচারী
সোসাইটি এবং সর্বভারতীয় ব্রতচারী সমাজ।
১৯৩৪ সালে ফরিদপুর ব্রতচারী সমিতির মূখপত্র হিসেবে 'ব্রতচারী বার্ত্তা' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন মৌলবি দলিলউদ্দীন আহম্মদ (খানসাহেব)। বাংলা ব্রতচারী সমিতির উদ্যোগে
১৯৩৬ সালে বাংলার শক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে
গুরুসদয় দত্ত চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এই বছরেই
কলকাতার উপকণ্ঠে জোকা নামক গ্রামে তাঁর নিজের ১০১ বিঘা জমিতে ‘ব্রতচারী গ্রাম’
প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। অক্লান্ত
পরিশ্রমে এবং দুরারোগ্য কর্কট রোগের কারণে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হতে থাকে।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের
২৫শে জুন গুরুসদয় দত্ত মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর
শিষ্যরা ব্রতচারী আন্দোলনকে চালিয়ে নিতে থাকেন এবং ‘ব্রতচারী গ্রাম’ প্রতিষ্ঠা
করেন।
১৯৪৭
খ্রিষ্টাব্দের পরে ব্রতচারী আন্দোলন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
অন্যাদিকে পশ্চিমবঙ্গে গুরুসদয় দত্তের শিষ্যরা এই আন্দোলন চালিয়ে নিতে থাকেন। সেখানে
ব্রতচারী গ্রাম ও চব্বিশ পরগণা থেকে
প্রকাশিত ও প্রচারিত দুইটি পুস্তিকা 'ব্রতচারী সখা' ও 'ব্রতচারী পরিচয়', প্রতি
ব্রতচারীদের পথনির্দেশ দিয়েছে। ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গে ব্রতচারী 'বিদ্যালয় শিক্ষা'র
অপরিহার্য অঙ্গ হয়েছে। কিন্তু সেখানে ব্রতচারীর বাঙালির ব্যাপক জাতীয়
আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠে নি।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে সদ্য
স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে, বাঙালি জাতীয়তাবোধের উদ্দীপ্ত নবীন প্রজন্মের জন্য
ব্রতচারীকে আদর্শ হিসেবে অনেকে ভেবেছিলেন এবং ব্রতচারী আদর্শকে চারদিকে ছড়িয়ে
দেওয়ার জন্য গুছিয়ে নিচ্ছিলেন, সে সময় আঘাত এসেছিল ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর
হত্যার মধ্য দিয়ে। একদিকে বাঙালি জাতীয়তাবোধের বিরোধ শক্তির আত্মপ্রকাশ, অন্যদিকে
স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির উত্থান- উভয় মিলে বাঙালি জাতীয়তাবোধে বিশ্বাসীদের কোণঠাসা
করে ফেলেছিল। ফলে শুধু ব্রতচারী নয়, এই জাতীয় সকল কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।
এরই ভিতরে
ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে অনেকে নিজেদের মতো করে চেষ্টা করে গেছে। এর ভিতরে
ব্রতচারীর ভিত্তিক বাঙালির ব্যাপক জাতীয়
আন্দোলনের বিষয়টি নিয়ে সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, পটুয়া কামরুল হাসান, মোঃ
রোকনউদ্দীন প্রমুখে সংস্কৃত-কর্মীরা ভেবেছিলেন। ব্রতচারীর আদর্শে ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে
২৪ জুলাই, ১১০ লেক সার্কাসে 'নালন্দা' বিদ্যালয়ের ভাড়াবাড়ির দোতলায় ব্রতচারীর ক্লাস
শুরু হয়েছিল। এখানে প্রতি বৃহস্পতিবার মোঃ রোকনউদ্দীন ব্রতচারী প্রশিক্ষণ দিতেন। এই
সময় ছায়ানট এবং উদীচীর অনেকে এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই প্রশিক্ষণ শুরু
হয়েছিল- ব্রতচারী নৃত্যগীত 'চল্ কোদাল চালাই'-এর দিয়ে। এই বছরের শেষে বড় মাপের
প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনার জন্য 'কেন্দ্রীয় ব্রতচারী নৃত্যোৎসব পরিষদ' গঠিত হয়। এই
পরিষদের সভাপতি ছিলেন সন্জীদা খাতুন। সে সময় ভারতের 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি' থেকে
ব্রতচারী সখাসহ কিছু বই সংগ্রহ করা হয়। এই সময় বাংলার ব্রতচারী সমিতির সভাপতি কমলেশ
চ্যাটার্জি 'বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন'-এর কাজে ঢাকায় এলে এসেছিলেন।
তাঁর সাথে বাংলাদেশের ব্রতচারী কর্মীদের আলোচনা শেষে, কলকাতা থেকে ব্রতচারীর
প্রশিক্ষক পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে, কলকাতা থেকে এসেছিলেন
প্রধান প্রশিক্ষক অহীন্দ্রভূষণ সাহা। এঁর সাথে ছিলেন তপন পাল আর ইলা ব্যানার্জি।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ থেকে ২৯ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের 'সরকারি শিশু পরিবার' আবাসিক
বিদ্যালয়ের বালক শাখায় প্রথম প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন হল। এই সময় দিনাজপুর, রংপুর,
বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, গাজীপুর থেকে শতাধিক
শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন এই প্রশিক্ষণ শিবিরে। সাতদিনের প্রশিক্ষণ শেষে
বিশিষ্টজনদের বক্তৃতার পরে ব্রতচারী নৃত্যগীত পরিবেশন হয়েছিল। এবং সবশেষে
শিক্ষার্থীদের হাতে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞানপত্র তুল দেওয়া হয়েছিল।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার কেন্দ্রীয় প্রস্তুতি পরিষদ থেকে বাংলাদেশে 'ব্রতচারী' গঠিত
হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে ঢাকার ব্রতচারী সমিতি থেকে আটকজন কলকাতার উপকণ্ঠে অবস্থিত
'জোকা' গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে যায়। আগেই বলা হয়েছে যে, ব্রতচারী আন্দোলনের
প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত 'জোকা'তে তাঁর ভূসম্পত্তিতে 'ব্রতচারী গ্রাম' তৈরি করবার
ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এই গ্রামে প্রশিক্ষণের
ব্রতচারীরা আসেন। ভারত সরকার স্কুলে স্কুলে ব্রতচারী শিক্ষার নিয়ম প্রচলন করে
দিয়েছেন, তাই চাকরির তাগিদে এই গ্রামে তাদের আসতেই হয় অন্ততঃ সনদপত্র পাওয়ার জন্য। ২০০৪
খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে, প্রতিবৎসর বহু শিক্ষক 'জোকা' গ্রামে প্রশিক্ষণের জন্য যান।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে
'ব্রতচারী'-র দ্বিতীয় প্রশিক্ষণ শিবির হয়েছিল টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের নালস্নাপাড়াস্থ
'বেলায়েত হোসেন বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়' মাঠে। এই প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিল মূলত উঁচু
ক্লাসের শিক্ষার্থীরা। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল কিছু ব্রতচারী কর্মী। প্রশিক্ষণ শেষে
নৃত্যগীত সমৃদ্ধ সমাপনী অনুষ্ঠান দেখে একদিকে স্থানীয় মানুষ বিস্মিত হয়েছিল।
অন্যদিকে মুগ্ধ করেছিল, কায় মনে বাঙালি হওয়ার আদর্শ অনুভব করে।
২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে খুলনার বটিয়াঘাটা অঞ্চলের এক গ্রামের
'জলমা-চক্রাখালী হাই স্কুলে' কেন্দ্রের তৃতীয় প্রশিক্ষণ শিবির হয়। এ শিবিরে
যোগ দিয়েছিলেন'বাংলার ব্রতচারী সমিতি'র অহীন্দ্রভূষণ সাহা এবং ঢোলবাদক পারঙ্গম আশোক রাউত। এই
প্রশিক্ষণ শিবিরে জয়পুরহাট, খুলনা, ঢাকা, শেরপুর, টাঙ্গাইল থেকে অনেকে শিক্ষার্থী
এসেছিলেন। মূলত এই প্রশিক্ষণের পর খুলনা অঞ্চলের বহু স্কুলে ব্রতচারী চর্চা
ছড়িয়ে পড়েছে।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে সিলেটে কুলাউড়ার লংলা চা বাগানের 'ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউণ্ডেশান
স্কুলে' বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই
সময়
প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন পশ্চিম বাংলার অহীন্দ্রভূষণ সাহা এবং অশোক রাউত।
এছাড়া বাংলাদেশের দুইজন প্রশিক্ষকও এঁদের সাথে ছিলেন। এই বছরে 'ব্রতচারী'-র নিজস্ব
একজন প্রশিক্ষক বিয়ানিবাজারে গিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছিলেন।
২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে গুরুসদয় দত্তের একশো পঁচিশ বছরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে 'বাংলার
ব্রতচারী সমিতি' এক বিশাল আয়োজন করে। ওই উৎসবে বিশ জনের একটি দল 'জোকা'র প্রশিক্ষণ
এবং জন্মোৎসবে যোগ দিয়েছিল। এছাড়া ব্রতচারী সমিতি, বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনায়
গুরুসদয় দত্তের জন্মস্থান বীরশ্রী গ্রামের স্কুলে অনুষ্ঠান করে এবং স্মারক মশাল
জ্বালিয়ে নিয়ে সিলেটের তরুণ দল ঢাকার অভিমুখে যাত্রা করেছিল। এই সময় ঢাকা, শেরপুর,
নালস্নাপাড়া থেকে আগত শিক্ষার্থীরা এর সাথে যুক্ত হয়েছিল। এরা সম্মিলিতভাবে
ব্রতচারী গান গাওয়ার পর, নৈশ কোচে বেনাপোল সীমান্তে যায়। সীমান্তে
পশ্চিমবঙ্গের ব্রতচারীরা বাংলাদেশীদের ফুলে ফুলে শুভেচ্ছা জানিয়ে বরণ করে
নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বিশ জনের একটি দল
'জোকা'র প্রশিক্ষণ এবং জন্মোৎসবে যোগ দিয়েছিল। এই আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠান
হয়েছিল ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকে যোগদান
করেছিলেন চন্দনা মজুমদার, নির্মলচন্দ্র মজুমদার ও বিমানচন্দ্র বিশ্বাস। এই বছরের
ডিসেম্বর মাসে, বাংলাদেশ থেকে কিছু প্রশিক্ষক ব্রতচারী গ্রামের প্রশিক্ষণ শিবিরে
অংশগ্রহণ করেছিলেন।
২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ থেকে ১০ জুন ময়মনসিংহের 'মুকুল নিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়ে' অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ প্রশিক্ষণ শিবির। এ বছর 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি' থেকে প্রশিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন অহীন্দ্রভূষণ সাহা, আশোক রাউত, মমতা চ্যাটার্জি ও ইলা ব্যানার্জি। এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের শেরপুর, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, নালস্নাপাড়ায় ব্রতচারীরা। এছাড়া ময়মনসিংহের বাইরে থেকে এসেছিলেন জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার শিক্ষার্থীরা।
বর্তমানে বাংলাদেশে ব্রতচারী আন্দোলনের আশানুরূপ প্রসার ঘটে নি। অনেকে মনে করেন, যদি ভারতের মতো বাংলাদেশে ব্রতচারী অন্তত স্কুল পর্যায়ে বাধ্যতামূলক শিক্ষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলেই এর যথাযথ প্রসার ঘটবে।