হেমাঙ্গ বিশ্বাস
(
১৯১২-১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ)
গীতিকার, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ১৪ই জানুয়ারি (২৭ অগ্রহায়ণ ১৩১৯) হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার পশ্চিম মিরাশী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরকুমার বিশ্বাস ছিলেন জমিদার। মায়ের নাম সরোজিনী দেবী।

স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে হবিগঞ্জের মিডল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। এরপর পিতার ইচ্ছায় তিনি ডিব্রুগড় শ্রীমুক্তানন্দ স্বামীর আশ্রমে যান। এই সময় ডিব্রুগড়ের জরজ ইনস্টিটিউটে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পাঠ শেষ করেন। ১৯২৮-২৯ খ্রিষ্টাব্দে হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। এই স্কুল থকে এন্ট্রান্স পাস করে ৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শ্রীহট্ট মুরারিচাঁদ কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় তিনি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং এই কারণে তিনি কলেজ থেকে বিতারিত হন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে আইন অমান্য আইনে গ্রেফতার হন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের তিনি হবিগঞ্জ ও সিলেট কারাগারে বন্দী থাকেন। এই বছরেই তিনি মুক্তি লাভের পর পুনরায় গ্রেফতার হন। এবারে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হলে, ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেলে থাকার সময় তিনি গান্ধীবাদী রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে। দেহলী ও হিজ্‌লী জেলে থাকার সময়  তিনি কিছু মার্কসাবাদী বন্দীদের সংস্পর্শে, এই রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এই সময়  হিন্দুস্তান টাইমস পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সোভিয়েত সংবিধান পড়ে মার্কসাবাদকে আদর্শ নীতি হিসেবে গ্রহণ করেন। এছাড়া যক্ষ্মা হাসপাতালে গোর্কি মা এবং মরিস হিন্ডুজের 'হিউম্যানিটি আপরুটেড' পাঠ করে মুগ্ধ হন।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কারণে তিনি মুক্তি পান ।
১৯৩৬-৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ-এর কাছে বলশেভিক পার্টির সদস্য হওয়ার জন্য চিঠি লেখেন। এই বছরে তিনি প্রগতি লেখক সংঘের আদর্শে সিলেট 'সাহিত্যচক্র' তৈরির উদ্যোগ নেন।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কৃষক আন্দোলনে যোগদানের জন্য গান রচনা করেন।  এই বছরে তিনি সিলেটে ফিরে আসেন।
কৃষক আন্দোলনে যোগদান এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত হওয়ার জন্য, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জমিদার পিতা তাঁকে বহিষ্কার করেন। এই সময় দলের নির্দেশে তিনি সিলেটের গ্রামঞ্চলে সাংগঠনিক কাজ করেন। এই বছরে তিনি রচনা করেন 'কাস্তেটারে দিও জোরে শান'। এই বছরেই তাঁর প্রচেষ্টায় সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াড গঠিত হয়।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার প্রগতিশীল লেখক শিল্পীদের আমন্ত্রণে তিনি প্রথম কলকাতায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর উদ্যোগে এবং জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়ালের সহযোগিতায় সিলেট গণনাট্য সংঘ তৈরি হয় । এই বছরে
বোম্বাইয়ে (অধুনা মুম্বাই) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ফ্যাসিবিরোধী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য একটি সাধারণ সংঘ তৈরি করার কথা বলা হয়। এরই ভিতর দিয়ে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা সংক্ষেপে আই.পি.টি.এ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। তবে সুরমা ভ্যালি কালচারাল স্কোয়াডে অংশগ্রহণের জন্য, গণনাট্য সংঘ-এর প্রথম অনুষ্ঠানে যোগদান করতে পারেন নি।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ প্রতিষ্ঠিত হয় অসম প্রাদেশিক গণনাট্য সংঘ। এই সংঘের সভাপতি হয়েছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়াল এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।
 
১৯৪৮ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। এই সময় তিনি গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপন করেন। এই বছরেই তিনি রচনা করেন- মাউন্টব্যাটন মঙ্গলকাব্য'।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদে গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই বছরে ডিব্রুগড়ের নালিয়াপুলে শান্তি সম্মেলন ও অসম গণনাট্য দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে পুলিশের বাধায় সভা পণ্ড হয়ে যায়। পুলিশে গুলিতে দুটি মেয়েকর্মীর মৃত্যু হয়। এই সময় হেমাঙ্গ বিশ্বাস একটি বাথরুমে আত্মগোপন করে ১০ মাস অতিবাহিত করেছিলেন। পরে গোপনে কলকাতা চলে যান।

১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় তিনি গ্রেফতার হন। তবে অসুস্থতার জন্য কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তি পান।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে গুহাটিতে গণনাট্যের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়। উভয় সম্মেলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় গণনাট্যের সপ্তম সম্মেলন হয়। এই সভায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে অসম প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কমুনিউষ্ট পার্টির উদ্যোগে চীন যাত্রা করেন। প্রায় আড়াই বছর চীনে থাকার পর, ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় ফিরে আসেন। এই বছরে তিনি রাণু দত্তকে বিয়ে করেন। এরপর এঁরা কলকাতা ও হুগলির শিয়াখালা গ্রামে বসবাস করা শুরু করেন।

১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে আসামে বাঙালি-অহমিয়া দাঙ্গা শুরু হলে, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও ভূপেন হাজারিকা দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এই বছরে তিনি রচনা করেন 'হারাধন রঙমন'। এছাড়া প্রকাশিত হয় 'Witnessing China with Eyes' নামক গ্রন্থ।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর রচিত- সীমান্ত প্রহরী' নামক গ্রন্থ। এই বছরেই কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ-এর সুপারিশে তিনি সোভিয়েত কনসালেটে চাকরি পান।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে কমিউনিষ্ট পার্টি বিভাজিত হলে- তিনি কোনো পক্ষেই যোগদান করেন নি।
১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন 'কল্লোল; নামক নাটক।
১৯৬৭-৬৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মাসিক বসুমতী পত্রিকায় 'মুর্শিদ' ছদ্মনামে তাঁর লেখা ছাপা হ‌ওয়া শুরু হয়।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে নকশাল আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে তিনি নকশাল পন্থীদের সমর্থন করেন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে অসমিয়া কাব্যগ্রন্থ 'কুলখুড়ার চোতাল' প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর নেতৃত্বে গঠিত হয় 'মাস সিঙ্গার্স'।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সোভিয়েত কনসালেটের চাকরি ত্যাগ করেন। এই বছরে তিনি ডাঃ কেটনিস মেমোরিয়াল কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে চীনে যান।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন- 'আবার চীন  দেখের এলাম'। অহমিয়া ভাষায় রচনা করেন- আকৌ চীন চাই আহিলো গ্রন্থের প্রথম খণ্ড।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় অহমিয়া ভাষায় রচনা করেন- আকৌ চীন চাই আহিলো গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড এবং বাংলাতে 'চীন থেকে ফিরে' নামক গ্রন্থ।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দ তিনি গানের দল নিয়ে ঢাকা ভ্রমণ করেন। ৫ ও ৬ই মার্চ তাকে ঢাকায় গণ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯৮৩ অসমিয়া গ্রন্থ 'শিল্পী জীবন জ্যোতিপ্রকাশ' প্রকাশিত হয়। এই বছরে অহমিয়া ও বাঙালির মধ্যে দাঙ্গা শুরু হলে- তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করে দাঙ্গা রোধ করতে ব্যর্থ হন।

১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ডাকে গণনাট্য সঙ্ঘ পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের সূত্রে আগ্রাতে সম্মেলন আহবান করা হয়।  এই অনুষ্ঠানে তাঁর যোগ দিয়েছিলেন- কায়েফি আজমি, দীনা পাঠক, একে হাঙ্গল, রাজেন্দ্র রঘুবংশী, করুণা, সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, নগেন কাকতি দিলীপ শর্মা প্রমুখ।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে গণনাট্য সংঘের রাজ্য সম্মেলন, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সভাপতি বির্বাচন করে।  এই বছরের নভেম্বর মাসে হায়দ্রাবাদে সর্বভারতীয় নবম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে তিনি 'Peolples Music: A new Questions' শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন, সমাদৃত হন। এই সম্মেলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৬-৮৭ খ্রিষ্টাব্দে, অনুষ্টুও পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে আত্মজীবনী 'উজান গাঙ বাইয়া' তিন পর্বে প্রকাশিত হয়।
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তিনি 'মাস সিঙ্গার্স'-এ অংশগ্রহণ করেন।

১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।