গণনাট্য সংঘের সাংস্কৃতিক উল্লেখযোগ্য কর্মীদের বর্ণানুক্রমিক তালিকা

  • অমর শেখ
  • উৎপল দত্ত
  • উদয়শংকর
  • ঋত্বিক ঘটক
  • কলিম শরাফী
  • কায়ফি আজমী
  • খলিল ফরিয়াদি
  • খাজা আহমেদ আব্বাস
  • জগদীশ ফরিয়াদ
  • জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র
  • টেরা সিং চান
  • তৃপ্তি মিত্র
  • দ্বিজেন চৌধুরী
  • দিলীপ রায়
  • দেবব্রত বিশ্বাস
  • নিরঞ্জন সিং মান
  • পংকজকুমার মল্লিক
  • পরেশ ধর
  • পৃথ্বীরাজ কাপুর
  • বিজন ভট্টাচার্য
  • বিনয় রায়
  • বিষ্ণু দে
  • মনোরঞ্জন ভট্টাচার
  • রবিশংকর, পণ্ডিত
  • রাজেন্দ্র রঘুবংশী
  • শম্ভু ভট্টাচার্য
  • শম্ভু মিত্র
  • শান্তি বর্ধন
  • শোভা সেন
  • শচীন দেব বর্মণ
  • সফদার মীর
  • সলীল চৌধুরী
  • সাজ্জাদ জহির
  • সুচিত্রা মিত্র
  • সুজাতা মুখার্জী
  • সুধী প্রধান
  • সুনীল চ্যাটার্জী
  • সুরপতি নন্দী
  • স্নেহাংশু আচার্য,
  • হীরেন মুখার্জী
  • হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
  • হেমাঙ্গ বিশ্বাস
গণনাট্য সংঘ
ইংরেজি : Indian People's Theatre Association বা IPTA

ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা। শুরুর দিকে এর সদস্য ছিলেন ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, পৃথ্বীরাজ কাপুর, বিজন ভট্টাচার্য, খাজা আহমেদ আব্বাস, সলীল চৌধুরী, পণ্ডিত রবিশংকর, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, নিরঞ্জন সিং মান, এস. টেরা সিং চান, জগদীশ ফরিয়াদি, খলিল ফরিয়াদি, রাজেন্দ্র রঘুবংশী সফদার মীর প্রমুখ।

এর শুরু হয়েছিল প্রগতি লেখক সমিতি সংঘ-এর মাধ্যমে। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ইতালিতে এবং ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীতে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে ফ্যাসিবাদীরা অন্য জাতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকেই ইতালির মুসেলিনী এবং জার্মানীর হিটলার-এর মাধ্যমে জাতি বিদ্বেষ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এই সময় সাড়াবিশ্বের সমাজবাদী বুদ্ধিজীবী রম্যাঁ রল্যাঁ, গোর্কি, বারবুঁস, আইনস্টাইন, আদ্রে জিঁদ প্রমুখ প্রতিবাদ করেছিলেন এবং একটি আন্তর্জাতিক লেখক সংঘ গড়ে তোলেন। এরই আদর্শে ভারতীয় লেখকরা গড়ে তোলেন 'প্রগতি লেখক সংঘ'।

লণ্ডনে প্রবাসী হীরেন মুখার্জী ও সাজ্জাদ জহির ফ্যাসিজমের আগ্রাসন ও বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনার প্রতিরোধ গড়ে ওঠা নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। এঁরা ভারতে ফিরে প্রগতি লেখক সংঘের একটি ইস্তাহার রচনা করেন। পরে এই লেখক সংঘের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন তরুণ লেখক, সাংবাদিক, গীতিকার, নাট্যকার ও কিছু প্রবীণ সাহিত্যিক।

১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে লক্ষ্ণৌ-তে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন মুন্সি প্রেমচাঁদ। এই সংঘের অন্যতম উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন হীরেন মুখার্জী, সাজ্জাদ জহির, মুলক্‌রাজ আনন্দ, জওহরলাল নেহেরু, সরোজিনী নাইডু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রেমচন্দ্র প্রমুখ।

১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রগতি লেখক সংঘের দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন সুধী প্রধান, নীরেন্দ্র রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিনয় ঘোষ, সরোজ দত্ত, সুবোধ চৌধুরী, অরুণ মিত্র, চিন্মোহন সেহানবীশ, বুদ্ধদেব বসুসহ আরও অনেকে। 'প্রগতি লেখক সংঘ'-এর ঘোষণায় বলা হয়
'ভারতের নবীন সাহিত্যকে বর্তমান জীবনের মূল সমস্যা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সামাজিক পরাঙ্মুখতা, রাজনৈতিক পরাধীনতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে।... যা কিছু আমাদের নিশ্চেষ্টতা, অকর্মণ্যতা, যুক্তিহীনতার দিকে টানে তাকে আমরা প্রগতি বিরোধী বলে প্রত্যাখ্যান করি। যা কিছু আমাদের বিচার বুদ্ধিকে উদ্বুদ্ধ করে, সমাজ ব্যবস্থাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে পরীক্ষা করে আমাদের কর্মিষ্ঠ, শৃঙ্খলাপটু ও সমাজের রূপান্তরক্ষম করে, তাকে আমরা প্রগতিশীল বলে গ্রহণ করবো।'

এই সময় কলকাতা এবং কলকাতার বাইরে এই সংঘের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে। এর বাইরে আরও কিছু সংঘ গড়ে উঠের। এর কাছাকাছি সময়ে ঢাকাতে প্রতিষ্ঠিত হয় 'প্রগতি লেখক সংঘ'-এর শাখা। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে গঠিত হয় 'লীগ এগেইনস্ট ফ্যাসিজম এন্ড ওয়ার'। এছাড়া ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র-ছাত্রী 'ইয়ুথ কালচারাল ইন্সটিটিউট' নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনের প্রযোজনায় কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। এর ভিতরে অন্যতম নাটক ছিল
সুবোধ ঘোষের কাহিনী অবলম্বনে অঞ্জনগড়, সুনীল চ্যাটার্জীর কেরানী এবং ইংরেজীতে ইন দ্য হার্ট অব চায়না। এ সময়ে ফ্যাসিবিরোধী ইতালি ও জাপান জার্মানি লেখক ও বুদ্ধিজীবীদের সাথে মিলিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবিরোধী মৈত্রী তৈরি করে।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে জাপান ব্রহ্মদেশ আক্রমণ করে। এই পটভূমিতে ব্যাপকতর ভারতীয় সংগঠনগুলো ভারতীয় জনগোষ্ঠীর কাছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পোঁছে দিয়ে তাদেরকে প্রাণোদ্দীপনায় উজ্জীবিত করার চেষ্টায় করতে থাকেন। এর সাথে যুক্ত হন সে সময়ের উদীয়মান সাহিত্যিক, সাংবাদিক, নাট্যকার, সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, লোকশিল্পীসহ শিল্পের সকল শাখায় কর্মীবৃন্দ। এ সময়ে রাজনৈতিক সংগঠন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও সাংস্কৃতিক কর্মক্রমের মধ্য দিয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে জনগণের সচেতনতা সৃষ্টির প্রতি বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়। এই সূত্রে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বাইয়ে (অধুনা মুম্বাই) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে ফ্যাসিবিরোধী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য একটি সাধারণ সংঘ তৈরি করার জন্য। এরই ভিতর দিয়ে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা সংক্ষেপে আই.পি.টি.এ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। এর উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন কায়ফি আজমী, শান্তি বর্ধন, প্রেমধাবন, বলরাজ সাহনী, শংকর, শৈলেন্দ্র, পৃথ্বিরাজ কাপুর, অমর শেখ প্রমুখ। আর বাংলার প্রাদেশিক কমিটিতে মনোনীত হন সুনীল চ্যাটার্জী, দিলীপ রায়, সুধী প্রধান, বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, সুজাতা মুখার্জী, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, স্নেহাংশু আচার্য, বিষ্ণু দে, বিনয় রায় প্রমুখ।

এরপর বাংলাতে প্রায় সকল প্রগতিশীল শিল্পীরাই এর সাথে যুক্ত হন। এঁদের ভিতরে ছিলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, দ্বিজেন চৌধুরী, সুচিত্রা মিত্র, সুরপতি নন্দী, শচীন দেব বর্মণ, পংকজকুমার মল্লিক, কলিম শরাফী, তৃপ্তি মিত্র, শোভা সেন, উদয়শংকর, শম্ভু ভট্টাচার্য-সহ শিল্পের সকল শাখার কৃতি মানুষেরা।

ভারতীয় গণনাট্য সংঘের নানাবিধ উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল নাটকের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, শোষণের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। এই আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধ লেখক শিল্পী নাট্যকর্মীরা এগিয়ে আসেন এবং নতুন নতুন নাটক রচিত ও মঞ্চস্থ হয়। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে মঞ্চস্থ হয় পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত বিজন ভট্টাচার্য রচিত নাটক 'আগুন'। এ নাটকটি  'নাট্য ভারতী'র মঞ্চে (বর্তমান গ্রেস সিনেমা) অভিনীত হয়। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় বিজন ভট্টাচার্যের 'জবানবন্দী'। একই সময়ে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের হোমিওপ্যাথি অভিনীত হয়। এই ধারার অন্যতম নাটক ছিল ১৯৪২ খ্রিষ্টব্দের আগস্ট বিপ্লব-এর প্রক্ষাপটে 'নবান্ন'। নবান্ন অভিনীত হয় ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ অক্টোবর।

১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তেভাগা আন্দোলনে কমুউনিষ্ট পার্টির প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ছিল। সেই সূত্রে গণনাট্য সংঘের নাট্যকার, অভিনেতা, গীতিকার, কণ্ঠশিল্পীরা গণজাগরণে উদ্দীপনা জুগিয়েছিল।
 
১৯৪৭ খ্রিষ্টব্দে ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয় উপমহাদেশ।
এই বছরে প্রতিষ্ঠিত হয় অসম প্রাদেশিক গণনাট্য সংঘ।  এই সংঘের সভাপতি হয়েছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ আগরওয়াল এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হেমাঙ্গ বিশ্বাস।

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদে গণনাট্য সংঘের সর্বভারতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই বছরে ডিব্রুগড়ের নালিয়াপুলে শান্তি সম্মেলন ও অসম গণনাট্য দ্বিতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে পুলিশের বাধায় সভা পণ্ড হয়ে যায়। পুলিশে গুলিতে দুটি মেয়েকর্মীর মৃত্যু হয়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে গুহাটিতে গণনাট্যের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রাদেশিক সম্মেলন হয়। উভয় সম্মেলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বাইতে অনুষ্ঠিত হয় সর্বভারতীয় গণনাট্যের সপ্তম সম্মেলন হয়। এই সভায় হেমাঙ্গ বিশ্বাসের নেতৃত্বে অসম প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে।


পাকভারত বিভাজনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল বাংলাদেশে। দেশবিভাগের জন্য অনেকেই দেশান্তরি হন। কমিউনিষ্ট পার্টির প্রতি খড়্‌গ হস্ত কংগ্রেস সরকারের অত্যাচারের ভয়ে নাট্যকার বা শিল্পী গণনাট্য সংঘ ত্যাগ করেন। কলিম শরাফির মতো অনেকে কলকাতা ত্যাগ করে, পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন। ধীরে ধীরে গণনাট্য সংঘের কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায়. ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের ডাকে গণনাট্য সঙ্ঘ পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের সূত্রে আগ্রাতে সম্মেলন আহবান করা হয়।  এই অনুষ্ঠানে তাঁর যোগ দিয়েছিলেন- কায়েফি আজমি, দীনা পাঠক, একে হাঙ্গল, রাজেন্দ্র রঘুবংশী, করুণা, সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, নগেন কাকতি দিলীপ শর্মা প্রমুখ।

১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে গণনাট্য সংঘের রাজ্য সম্মেলন, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে সভাপতি বির্বাচন করে।  এই বছরের নভেম্বর মাসে হায়দ্রাবাদে সর্বভারতীয় নবম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে তিনি 'Peolples Music: A new Questions' শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন, সমাদৃত হন। এই সম্মেলনে হেমাঙ্গ বিশ্বাস সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।


তথ্যসূত্র
১. মানসী জামান, বাংলা নাটক (১৯৪০-৬০); আর্থ-সামাজিক দৃশ্যপট, কলকাতা, ১৯৮৬
২. নিরঞ্জন অধিকারী, বাংলাদেশে গণসঙ্গীত চর্চা, জাতীয় গণসঙ্গীত উৎসব, ২০০০ উপলক্ষে প্রকাশিত সুভেনির
৩. সুধী প্রধান, গণ-নব-সৎ গোষ্ঠী নাট্যকথা, কলকাতা, ১৯৯২
৪. সজল রায় চৌধুরী, গণনাট্য কথা, কলকাতা, ১৯৯০ 
৫. পুলিন দাস, বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা নাটক, ২য় খণ্ড কলকাতা ১৩৯৮ বঙ্গাব্দ
৬. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, কলকাতা, ১৯৭১
৭. ড. দীপকচন্দ্র, বাংলা নাটকে আধুনিকতা ও গণচেতনা, কলকাতা, ১৯৮২