হীরালাল সেন
(১৮৬৬-১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলা চলচ্চিত্রের আদি পরিচালক।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের মানিকগঞ্জের বগুজারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতার নাম চন্দ্রমোহন সেন এবং মাতা বিধুমুখী। হীরালালের পিতামহ গোকুলকৃষ্ণ মুনশি ছিলেন ঢাকার জজ আদালতের নামকরা আইনজীবী।
পরে তিনি কোলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসাবে যোগ দেন। পিতা মাতার আট সন্তানের মধ্যে হীরালাল ছিলেন দ্বিতীয়।
তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়েছিল মানিকগঞ্জ মাইনর স্কুলে। সে সময়ের শিক্ষাপ্রথার সূত্রে তিনি মৌলভী সাহেবের কাছে ফারসী ভাষা শিখেছিলেন।
১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থানীয় স্কুল থেকে মাইনর পরীক্ষা পাস করে ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ভর্ত্তি হন।
পরে পিতার সাথে কলকাতায় যান এবং কলেজে ভর্তি
হন।
এই সময় তিনি চলচ্চিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন
এবং এই কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া আর অগ্রসর হয় নি।
১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় 'The Flower of Persia'
(পারস্যের ফুল) নামে একটি অপেরার স্টার থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। এই অপেররা সাথে অধ্যাপক স্টিভেনসনের একটি নাতিদীর্ঘ ছবি দেখানো হয়েছিল। এই ছবিটি দেখার পর তিনি একটি ছবি তৈরির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি স্টিভেনসনের কাছ থেকে ক্যামেরা ধার নিয়ে
ওই অপেরার একটি নাচের দৃশ্য গ্রহণ করেন। পরে এটিকে সম্পাদনা করে চলচ্চিত্রের রূপ দেন। এই ছবিটির তিনি নামকরণ করেছিলেন
A Dancing Scene From the Opera, The Flower of Persia
।
হীরালাল সেন তাঁর এই প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের পর, এই বিষয়ে আরও উৎসাহী হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর ভাই মতিলাল সেনের সহায়তায়
লন্ডনের ওয়ারউইক ট্রেডিং কোম্পানীর চার্লস আরবানের থেকে তিনি
একটি 'Urban Bioscope'
কিনে নেন।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে মতিলাল সেনকে সাথে নিয়ে তিনি 'রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানী'র গোড়াপত্তন করেন।
১৮৯৩ থেকে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি চল্লিশটিরও বেশি ছোটবড় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এ সব চলচ্চিত্রের
বেশিরভাগই ছিল অমরেন্দ্রনাথ দত্তের কলকাতার ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ বিভিন্ন থিয়েটারের দৃশ্য। এ ছাড়া ১৯০১ থেকে ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে মধ্যে
ক্লাসিক থিয়েটারের পক্ষে তিনি স্বতন্ত্র কিছু চলচ্চিত্র তৈরি করেন। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছবি ছিল- ভ্রমর, হরিরাজ, বুদ্ধদেব ইত্যাদি।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'আলিবাবা ও চল্লিশ চোর' (Alibaba and the Forty Thieves),
নামক পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র তৈরি করেছিলেন। তবে এ চলচ্চিত্রটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন
ক্লাসিক থিয়েটারে অভিনীত 'আলিবাবা চল্লিশ চোর'-অবলম্বনে। এই ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না।
এসব চলচ্চিত্রের বাইরে তিনি তৈরি করেছিলেন কিছু বিজ্ঞাপন-চিত্র। বিজ্ঞাপন চিত্রের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিল-
'জবাকুসুম হেয়ার অয়েল' আর 'এডওয়ার্ডস টনিক'-এর বিজ্ঞাপন-চিত্র।
হীরালাল ভারতবর্ষে প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাণের পথ দেখিয়েছিলেন করেছিলেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে সেপ্টেম্বর
কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের একটি প্রতিবাদ সভা হয়েছিল। এই প্রতিবাদ সভার ছবি তিনি গ্রহণ করে
একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছিলেন। এর নাম ছিল-
"Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905"
। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত এ তথ্যচিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল —
"আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা"। এই বছরে তিনি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র
Grand Patriotic Film
তৈরি করেছিলেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নির্মাণ করেছিলেন-
The Visit Film
। এই ছবিটি তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করেছিল।
শেষ জীবনে হীরালাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং আর্থিক দুর্গতিতে পড়েন। এই রোগে তিনি ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে এক অগ্নিকাণ্ডে তাঁর নির্মিত সকল ছবি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
১৯০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি হেমাঙ্গিনী দেবীকে বিবাহ করেন। এঁদের প্রথম পুত্র বৈদ্যনাথ সেন ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন।
তৃতীয় সন্তান কন্যা প্রতিভা সেন। প্রতিভা সেনের বিয়ে হয়েছিল ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা বিখ্যাত আদিনাথ সেনের পুত্র নরনাথ সেনের সাথে।
এই নরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের
স্ত্রী ছিলেন কিংবদন্তির নায়িকা
সুচিত্রা সেন ।